Thursday, April 23, 2020

করোনা-কালে মুসলমানের আকীদাহ : একটি প্রয়োগিক পাঠ

আশরাফ উদ্দীন খান

বর্তমান বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রকোপ বিস্তার লাভ করে চলেছে। নিকট ও দূর অতীতের মানবজাতির ইতিহাসে এই ধরণের মহামারীর প্রাদুর্ভাব খুব বেশী দেখা দেয়নি। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে প্রথম পর্যায়ে এই ভাইরাসের কথা বিশ্ববাসী জানতে পারে। চীনের উহান শহরের একটি বাজার থেকে এই ভাইরাস প্রথম প্রকাশ পায় –যেমনটি বলা হচ্ছে এবং এরপর অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক দেশে এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পরে। সেই অর্থে এই বছরকে করোনা-বছর ও এই কালকে করোনা-কাল হিসাবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। 

‘আকীদাহ’ শব্দটি একটি আরবি শব্দ, যার সাধারণ অর্থ ‘বিশ্বাস’ আর পরিভাষায় বুঝানো হয়ে থাকে ‘ইমান ও ইমানের সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, যেমন আল্লাহর পরিচয়, তাঁর সিফাত বা গুণাবলী, তাঁর আফয়াল বা কার্যাবলী, নবুওয়াত, রিসালাত, আখেরাত, গাইবিইয়াত বা অদৃশ্যবিষয় ইত্যাদি’। ইলমুল আকীদাহ হচ্ছে সেই শাস্ত্র যেখানে এই সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে। ফিকাহ শাস্ত্রের সম্পর্ক যেমন মুসলমানের আমল ও কর্মের সাথে তেমনি ইলমুল আকীদাহ এর সম্পর্ক হচ্ছে মুমিনের ইমান ও বিশ্বাসের সাথে। 

করোনাভাইরাসের এই যুগে, এই মহামারীকে কেন্দ্রকরে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। যা নিয়ে সাধারণ মানুষ যেমন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে, তেমনি ধর্মীয় আলেম সমাজের পক্ষ থেকেও তার উত্তর দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে উত্থাপিত প্রশ্নসমূহ যদি নির্ধারণ করা যায় তাহলে মোটামুটি সেগুলো হবে এই : 

  • এই ভাইরাস এক মানুষ থেকে আরেক মানুষে সংক্রমণ হয়ে থাকে, -এমন ধারণা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, ‘সংক্রমণ’ বলতে কোন কিছু নেই’ তাহলে এই পরস্পর বিরোধী উভয় ধারণার ব্যাখ্যা কি হবে?   
  • এই ভাইরাস আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আযাব, আর আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে আল্লাহর কাছে দোয়া-তাওবা-ইস্তিফগার করা দোয়ার সাথে জাগতিক উপায়-উপকরণ গ্রহণ করার যুক্তি ও জরুরত কতটুকু?  
  • ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে গণ-জামায়েত এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, সেখানে মাদ্রাসা বন্ধের বিষয়, মসজিদে জামাত অনুষ্ঠিত করা না করার বিষয় এসে যাচ্ছে। ফলে এর একটি ধর্মীয় সমাধান জরুরী হয়ে যাচ্ছে
  • যদি তাকদিরে থাকে তাহলে হাজার চেষ্টা করেও এই বিপদ থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। কথা সত্য, কিন্তু এইজন্য কি আমাদেরকে এই ভাইরাসের ক্ষতি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্য কোন কিছু করতে হবে না? এই ধরণের আরো প্রশ্ন ও বিতর্ক আমাদের সামনে আসছে, এর উত্তর ও সমাধান কি? 

উপরে উল্লেখিত বিষয় ও এই ধরণের আরো কিছু বিষয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সামনে প্রকাশ পাচ্ছে। সেই সকল বিষয়ের কিছু দিক বা অংশ ফিকাহ শাস্ত্রের সাথে সম্পর্কিত হলেও, সেটা হচ্ছে ব্যবহারিক দিক, কিন্তু তাত্ত্বিক দিক বা দার্শনিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের বিষয়টি ইলমুল আকীদাহ এর সাথেই সম্পর্কিত। তাই উত্থাপিত প্রশ্নসমূহকে একটি শিরোনামে একত্রিত করে আলোচনা করার জরুরত অনুভুত হয়েছে। সেই অনুভূতি থেকেই ‘করোনা-কালে মুসলমানের আকীদাহঃ একটি প্রয়োগিক পাঠ’ শিরোনামে এই আলোচনার অবতারণা করা হয়েছে। 

আলোচনার শুরুতে মুসলমানের আকীদাহ বা বিশ্বাসের কিছু মৌলিক বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করার পরে, নিম্মে উল্লেখিত বিষয়সমূহ নিয়ে অতি সংক্ষেপে আলোচনা পেশ করা হবে। উদ্দিষ্ট বিষয়সমূহ হচ্ছে : 

  • আল্লাহর সুনান, আয়াত, পরীক্ষা  ও করোনাভাইরাস 
  • বিপদ-বিপর্যয় কেন আসে? 
  • কাযা-কদরের প্রতি ইমানের অর্থ 
  • আসবাব গ্রহণ করা না করা 
  • তাওয়াক্কুল ও তায়াকুল
  • কিছু ভুল ধারণা 
  • ভুল ধারণা সৃষ্টি হওয়ার কারণ 

প্রথমেই আলোচনা করছি মুসলমানদের আকীদাহ বা ইমানের কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে।  

 

  • মুসলমানদের আকীদাহ কিছু মৌলিক বিষয় 

 

আলোচনার শুরুতে এমন কিছু বিষয় উল্লেখ করা জরুরী, যা ইলমুল আকীদাহ শাস্ত্রে মৌলিক ধারণা বা বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সেই সকল বিষয়ের উল্লেখযোগ্য কিছু হচ্ছেঃ 

আল্লাহ তায়ালা এই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা ও মালিক

إن ربكم الله الذي خلق السماوات والأرض في ستة أيام ثم استوى على العرش يغشي الليل النهار يطلبه حثيثا والشمس والقمر والنجوم مسخرات بأمره ألا له الخلق والأمر تبارك الله رب العالمين.

“নিঃসন্দেহ তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে, অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন, তিনি ঢেকে দেন দিনকে রাত দিয়ে, রাত দিনকে তালাশ করে দ্রুত, আর সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি নিয়োজিত তাঁর আদেশে। জেনে রেখ, তাঁরই হাতে সৃষ্টি ও আদেশ। বরকতময় আল্লাহ, বিশ্বজগতের প্রতিপালন”। (সুরা আ’রাফঃ ৫৪) 

আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন, কেউ তাঁকে বাঁধা প্রদান করতে পারে না

أولم يروا أنا نأتي الأرض ننقصها من أطرافها والله يحكم لا معقب لحكمه وهو سريع الحساب.

“তারা কি দেখে না যে, আমি জমিনকে সংকোচন করে আনছি বিভিন্ন দিক থেকে, আল্লাহই আদেশ প্রদান করেন, তাঁর আদেশ রদকরার কেউ নেই, তাঁর হিসাব দ্রুত” (সুরা রা’দঃ ৪১) 

আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম 

وهو الغفور الودود. ذو العرش المجيد. فعال لما يريد.  

“তিনিই দয়াশীল, প্রেমময়। আরশের অধিপতি, চির-সন্মানিত। যা ইচ্ছা তাই করেন”। সুরা বুরুজঃ ১৪-১৬) 

বিশ্বজগতের কোন কিছু তাঁর ইলম ও কুদরতের বাইরে নয়  

وعنده مفاتح الغيب لا يعلمها إلا هو ويعلم ما في البر والبحر وما تسقط من ورقة إلا يعلمها ولا حبة في ظلمات الأرض ولا رطب ولا يابس إلا في كتاب مبين.

“আর তাঁর কাছেই গায়েবের চাবিকাঠি, যা তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। এবং তিনি অবগত আছেন যা জলে ও স্থলে রয়েছে। এবং একটি পাতা পর্যন্ত পড়ে না, কিন্তু তিনি তা জানেন, এবং জমিনের অন্ধকারে কোন দানা নেই, এবং নেই কোন ভেজা ও শুকনা কোন কিছু কিন্তু তা রয়েছে সুস্পষ্ট কিতাবে” (সুরা আনয়াম ৫৯) 

বিশ্বজগতের ভাল-মন্দ সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত

قل اللهم مالك الملك تؤتي الملك من تشاء وتنزع الملك ممن تشاء وتعز من تشاء وتذل من تشاء بيدك الخير إنك على كل شيء قدير. 

“বলুন, হে আল্লাহ, ক্ষমতা দানকারী, আপনি ক্ষমতা দান করেন যাকে ইচ্ছা, ক্ষমতা চিনিয়ে নেয় যার থেকে ইচ্ছা, যাকে ইচ্ছা সন্মানিত করেন এবং যাকে ইচ্ছা অসন্মানিত করেন, আপনার হাতেই সকল কল্যাণ, নিঃসন্দেহ আপনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান” (সুরা আলে-ইমরানঃ ২৬) 

উপরে উল্লেখিত বিষয়সমূহ পেশ করার কারণ এটাই যে, আমরা যখন ইলমুল আকীদাহ নিয়ে যে দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচনা করি না কেন, আমাদের সামনে মৌলিক কিছু বিষয় অবশ্যই থাকতে হবে। সেই সকল মৌলিক বিষয়ের জ্ঞান ও ধারণা চিন্তায় রেখেই আমরা এখানে আকীদাহ সম্পর্কিত কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি। 

 

  • আল্লাহর সুনান, আয়াত, ইবতিলা-পরীক্ষা ও করোনাভাইরাসঃ  

 

এই বিশ্বজগত আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। সেই সকল নীতিমালাকে পরিভাষায় ‘আল্লাহর সুন্নত বা সুনান’ বলা হয়ে থাকে। তেমনি এই বিশ্বজগতে যা কিছু ঘটছে তার সবকিছু আল্লাহর সুনানের অন্তর্ভুক্ত। ‘সুনান’ এর সাধারণ অর্থ হচ্ছে নীতিমালা। পরিভাষায় বলা হয় :  

هي الطريقة المتبعة في معاملة الله تعالى للبشر بناء على سلوكهم وأفعالهم وموقفهم من شرع الله وأنبيائه وما يترتب علي ذلك من نتائج في الدنيا والأخرى.

“আল্লাহর সুনান হচ্ছে মানবজাতির আচার, কর্ম ও আল্লাহর শরীয়ত ও তাঁর নবী-রাসুলদের সাথে তাদের আচরণের ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যে পদ্ধতিতে ‘মুয়ামালা’ করে হয়ে থাকে, এবং এর ভিত্তিতে দুনিয়া ও আখেরাতে যে ফলাফল অর্জিত হয়ে থাকে” (ডঃ আব্দুল কারিম যাইদান) 

আল্লাহর তায়ালা তাঁর সুনান সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের আয়াতে এরশাদ করেনঃ  

استكبارا في الأرض ومكر السييء ولا يحيق المكر السييء إلا بأهله فهل ينظرون إلا سنة الأولين فلن تجد لسنة الله تبديلا ولن تجد لسنة الله تحويلا.

“পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে ও কূট ষড়যন্ত্রের কারণে, আর কূট ষড়যন্ত্র তার পরিকল্পনাকারীদেরকেই পাকড়াও করে। তারা কি পুর্ববর্তীদের (ব্যাপারে আল্লাহর) সুন্নতের অপেক্ষায় আছে, তাহলে আপনি আল্লাহর সুন্নতের কোন পরিবর্তন পাবেন না এবং কস্মিনকালেও আপনি আল্লাহর সুন্নতের কোন ব্যতিক্রম পাবেন না” (সুরা ফাতির ৪৩) 

এই শিরোনামের দ্বিতীয় শব্দটি ছিল ‘আয়াত’ যার অর্থ নিদর্শন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদেরকে আল্লাহর শক্তি, নীতি, কুদরত ইত্যাদির পরিচয় পেশ করার জন্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ‘আয়াত’ বা নিদর্শন উপস্থাপন করে থাকেন। যাতে চিন্তাশীল মানুষ এই আয়াতসমূহ দেখে ও প্রত্যক্ষ করে আল্লাহর পরিচয় ও তাওহীদ সম্পর্কে অবগত হতে পারে, হিদায়েত লাভ করতে পারে। এই সম্পর্কে কুরআনের আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে : 

سنريهم آياتنا في الآفاق وفي أنفسهم حتى يتبين لهم أنه الحق أولم يكف بربك أنه على كل شيء شهيد.

“শীঘ্রই আমি তাদেরকে দেখাবো আমার আয়াতসমূহ বিশ্বজগতে (দিগন্তে) ও তাদের নিজেদের মধ্যে, যাতে তাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায় যে তিনিই সত্য। আপনার প্রতিপালকের জন্য কি এটা যথেষ্ট নয় যে, তিনি সব বিষয়ে সাক্ষী” (সুরা হা-মীম সিজদা ৫৩) 

আর তৃতীয় শব্দটি ছিল ‘ইবতিলাহ’ যার সাধারণ অর্থ হচ্ছে পরীক্ষা করা। আল্লাহ তায়ালা ইবতিলাহ সম্পর্কে এরশাদ করেন : 

ولنبلونكم بشيء من الخوف والجوع ونقص من الأموال والأنفس والثمرات وبشر الصابرين. الذين إذا أصابتهم مصيبة قالوا إنا لله وإنا إليه راجعون. 

“আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, তাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী” (সুরা বাকারাহ ১৫৫-১৫৬)। 

উল্লেখিত এই তিনটি পরিভাষার পরিচয় পেশ করার পরে, আমরা যদি করোনা মহামারী নিয়ে চিন্তা করে দেখি তাহলে বুঝতে পারবো যে, এই মহামারী আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আয়াত বা নিদর্শন, যার মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, মানুষ যতই শক্তি ও প্রযুক্তি অর্জন করুক না কেন, মানবজাতি নিজের ভবিষ্যৎ, নিজের নিরাপত্তা পরিপুর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হতে পারে না। 

আজকে আমরা বিশ্বের সকল শক্তিকে এই সামান্য একটি ভাইরাসের সামনে চরমভাবে অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে ও নিজেদের অপারগতা স্বীকার করতে দেখছি। কেউ কেউ ইতিমধ্যে –প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে- স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, মানবীয় শক্তি হিসাবে আমাদের পক্ষে যা করার ক্ষমতা ছিল আমরা তার সবটুকু ইতিমধ্যে করেছি। এর বেশী কিছু করার আমাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। এখন আমাদেরকে সমাধানের জন্যে একমাত্র আসমানের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া বা অদৃশ্য কোন শক্তির তরফ থেকে অলৌকিক কোন সমাধান ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। 

আবার এটাও বলা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে মানব জাতিকে সতর্ক করার জন্যে, জগতের মধ্যে শক্তির মাত্রা ঠিক রাখার জন্যে এই ধরণের সুন্নত প্রকাশ করে থাকেন। আজকে দেখা যাচ্ছে যে যাদেরকে শক্তিশালী জাতি হিসাবে মনে করা হত তারা যে পরিমাণ নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছে, অন্য যাদেরকে তেমন শক্তিশালী মনে করা হত না তারা কিন্তু এই বিপদে নিজেদেরকে নিরাপত্তার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে কিছুটা সক্ষম হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার একটি বিশেষ সুন্নত হচ্ছে ‘সুন্নাতুত-তাদাফু’। এক জাতির মাধ্যমে আরেক জাতিকে আল্লাহর তায়ালা এই দুনিয়াতে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। কুরআনের আয়াত : 

الذين أخرجوا من ديارهم بغير حق إلا أن يقولوا ربنا الله ولو لا دفع الله الناس بعضهم ببعض لهدمت صوامع وبيع وصلوات ومساجد يذكر فيها اسم الله كثيرا ولينصرن الله من ينصره إن الله لقوي عزيز.

“যাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ী থেকে অন্যায়ভাবে বহিস্কার করা হয়েছে শুধু এই অপরাধে যে, তারা বলে আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ। আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে (খৃষ্টানদের) গির্জা, (ইহুদীদের) উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেত, যেগুলাতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহর সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী শক্তিধর” (সুরা হাজ্জ ৪০) 

আবার করোনা মহামারীকে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ইবতিলাহ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে মানবজাতিকে পরীক্ষা করা উদ্দেশ্য। এই পরীক্ষার সামনে যারা নিজেদের ধর্যের প্রমাণ দিতে পারবেন, এবং ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী আচরণ করতে সক্ষম হবেন তাদেকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এর উত্তম প্রতিদান দান করবেন, তাদেরকে পুরস্কিত করবেন, আর যারা সেটা করতে সক্ষম হবেনা তাদেরকে ধরা হবে যে তারা এই ইবতিলাহতে উত্তীর্ণ হতে পারল না। 

 

  • বিপদ-বিপর্যয় কেন আসে? 

 

দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে ও বিভিন্ন সময়ে বিপর্যয়, দুর্যোগ নেমে আসে –এটা একটি স্পষ্ট বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই বিপদ ও বিপর্যয়ের কারণ কি? বিপদ-বিপর্যয় অবতীর্ণ হওয়ার কারণ বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে ভিন্নতা রয়েছে। কারো নিকট এটা নিছক প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা দুর্যোগ, আর আমরা –মুসলমানদের- মতে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত আযাব। যেটা আল্লাহর ক্রোধের বহির্প্রকাশ হয়ে থাকে। যা আল্লাহর দ্বীন থেকে মানুষের দূরে সরে যাওয়া, পাপাচার, অন্যায়, জুলুম-অতাচারের কারণে আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী মানুষের উপর আপতিত হয়ে থাকে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনঃ 

ظهر الفساد في البر والبحر بما كسبت أيدي الناس ليذيقهم بعض الذي عملوا لعلهم يرجعون. 

“জলে-স্থলে বিপর্যয় প্রকাশ পেয়েছে, মানুষের কৃতকর্মের কারণে, যাতে তিনি তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের ফল ভোগ করাবেন, সম্ভাবত তারা ফিরে আসবে”। (সুরা রোমঃ ৪১) 

وما أصابكم من مصيبة فبما كسبت أيديكم ويعفو عن كثير.

“তোমরা যে বিপদের শিকার হয়েছ তা তোমাদের কৃতকর্মের কারণে, আর তিনি অনেক কিছু ক্ষমা করে দেন”। (সুরা শুরা ৩০) 

একটি হাদীসের ভাষ্য : 

“يا معشر المهاجرين خمس إذا ابتليتم بهن ـ وأعوذ بالله أن تدركوهن ـ لم تظهر الفاحشة في قوم قط حتى يعلنوا بها إلا فشا فيهم الطاعون والأوجاع التي لم تكن مضت في أسلافهم الذين مضوا، ولم ينقصوا الميكال والميزال إذا أخذوا بالسنين وشدة المؤونة وجور السلطان عليهم، ولم يمنعوا زكاة أموالهم إلا منعوا القطر من السماء ولو لا البهائم لم يمطروا، ولم ينقضوا عهد الله وعهد رسوله إلا سلط الله عليهم عدوا من غيرهم فأخذوا بعض ما في أيديهم، وما لم تحكم أئمتهم بكتاب الله ويتخيروا مما أنزل الله إلا جعل الله بأسهم بينهم”.

“হে মুহাজির সম্প্রদায়, তোমাদের মধ্যে পাঁচটি জিনিস দেখা দিলে (পাঁচটি আযাবের আশংকায় থেকো) – আর আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থণা করি যাতে তোমরা এই অবস্থার সম্মুখীন না হও : 

১) যখন কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে অশ্লীলতা প্রকাশ পায় এবং তা তাদের মাঝে প্রকাশ্য হয়ে যায়, তখন তাদের মধ্যে এমন মহামারী ও রোগ-ব্যাধি প্রকাশ পায় যা তাদের পুর্ববর্তীদের মধ্যে ছিল না 

২) যখন কোন সম্প্রদায় ওজনে কম দিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন তাদের উপর দুর্ভিক্ষ, জীবনযাপনের কষ্ট ও ক্ষমতাশীলদের অত্যাচার নেমে আসে 

৩) যখন কোন সম্প্রদায় যাকাত দিতে অস্বীকার করে তখন তারা আসমানের বৃষ্টি থেকে মাহরুম হয়, যদি পশু-পাখি ও চতুষ্পদ জন্তু না থাকত তাহলে তাদের উপর এক ফোঁটা বৃষ্টিও হত না  

৪) যখন কোন সম্প্রদায় আল্লাহর অঙ্গীকার ও তাঁর রাসুলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর এমন শত্রু চাপিয়ে দেন যারা তাদের হাতের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়

৫) যখন কোন সম্প্রদায়ের শাসকগণ আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী শাসন করে না, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা গ্রহণ করে না তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্যে সমস্যা তৈরি করে দেন

(হাদীসটি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাঃ থেকে বর্ণিত, ইমাম ইবনে মাজাহ উল্লেখ করেছেন) 

এই সকল আয়াত ও উল্লেখিত হাদীসের মর্মকথার বিপরীতে বেশ কিছু আয়াতে বর্ণনা এসেছে যে, আল্লাহ তায়ালা বান্দাদেরকে ইমান ও নেক আমলের কারণে ভাল অবস্থা, বরকত ও সমৃদ্ধি দান করেন। সামনের দুটি আয়াতের দিকে খেয়াল করি :   

ولو أن أهل القرى آمنوا واتقوا لفتحنا عليهم بركات من السماء والأرض ولكن كذبوا فأخذناهم بما كانوا يكسبون.

“যদি জনপদের অধিবাসীরা ইমান আনে ও তাকওয়া অবলম্বন করে তাহলে আমি তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিবো আসমান ও জমিনের বরকতসমূহ। কিন্তু তারা মিথ্যা মনে করল, ফলে আমি তাদেরক পাকরাও করলাম তাদের কৃতকর্মের কারণে”। (সুরা আ’রাফ ৯৬) 

وضرب الله مثلا قرية كانت آمنة مطمئنة يأتيها رزقها رغدا من كل مكان فكفرت بأنعم الله فأذاقها الله لباس الجوع والخوف بما كانوا يصنعون.

“আল্লাহর একটি দৃষ্টান্ত পেশ করছেনঃ একটি জনপদ (যার অধিবাসী ছিল) ইমানদার ও প্রশান্ত, সকল স্থান থেকে অনায়াসে তার রিজিক উপস্থিত হত, (কিন্তু) তারা আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করল ফলে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষুধা ও ভয়ের চাদর তাদেরকে পরিয়ে দিলেন, তাদের কৃতকর্মের কারণে” (সুরা নাহল ১১২) 

উল্লেখিত আয়াত ও হাদীসসমূহের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয় যে, দুনিয়ার বিপদ-আপদ ও বিপর্যয়-দুর্যোগ আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, মানুষের অন্যায়, অত্যাচার, পাপাচার ইত্যাদির কারণে যা আল্লাহ তায়ালা অপছন্দ করেন, আবার আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে ভাল অবস্থা দান করা হয় তাদের ইমান ও নেক আমলের কারণে। এটাই মুসলমানদের বিশ্বাস

 

  • কাযা-কদরের প্রতি ইমানের অর্থ 

 

ইসলামী আকীদাহতে একটি মৌলিক বিষয় হচ্ছে কাযা-কদরের উপর বিশ্বাস বা ইমান স্থাপন করা। ‘কাযা’ ও ‘কদর’ শব্দদুটি আভিধানিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রদান করলেও এবং পারিভাষিকভাবেও শব্দদুটির দুটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করা হলেও, চূড়ান্ত পর্যায়ে শব্দদুটি অভিন্ন অর্থ বুঝায়। 

সংক্ষেপ ও সহজে ‘কাযা-কদর’ এর অর্থ হচ্ছে তাকদির বা ভাগ্যলিপি, অর্থাৎ এটা বিশ্বাস করা যে, আমাদের জীবনে ও এই জগতে ভাল-মন্দ যা কিছু হয়ে থাকে তা আল্লাহ তায়ালা পুর্ব থেকেই লেখে রেখেছেন, এবং তাঁর ইচ্ছায় ও আদেশেই এই সকল ঘটনা ঘটে থাকে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :  

لا يعزب عنه مثقال ذرة في السماوات ولا في الأرض ولا أصغر من ذلك ولا أكبر إلا في كتاب مبين.

“আসমানসমূহ ও যমীনে অনু পরিমাণ কিংবা তদপেক্ষা ছোট অথবা বড় কিছুই তাঁর অগোচরে নেই, বরং সবই সুস্পষ্ট কিতাবে রয়েছে।” (সুরা সাবাঃ ৩)   

ما أصاب من مصيبة في الأرض ولا في أنفسكم إلا في كتاب من قبل أن نبرأها إن ذلك علي الله يسير لكيلا تأسوا على ما فاتكم ولا تفرحوا بما آتاكم والله لا يحب كل مختال فخور.

“পৃথিবীতে এবং তোমাদের (জীবনের) মধ্যে যে কোন বিপদই আসুক, তা রয়েছে একটি কিতাবের মধ্যে, যা আমি পৃথিবী সৃষ্টির আগেই লিপিবদ্ধ করে রেখেছি। নিঃসন্দেহে এটা আল্লাহর জন্য সহজ। যাতে তোমরা অনুশোচনা না করো যা হাত ছাড়া হয়ে গিয়েছে তার জন্য, এবং (অধিক) খুশি না হও যার তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন তা পেয়ে। আর আল্লাহ অহংকারী ও গর্বকারীকে পছন্দ করেন না” (সুরা হাদীদ  ২২-২৩)  

কাযা-কদরের প্রতি ইমানের চারটি স্তর রয়েছে, যা হচ্ছে :  

১) ইলমের স্তর   অর্থাৎ এই ইমান বা বিশ্বাস রাখা যে আল্লাহ তায়ালা আসমান-জমিন তথা সমগ্র বিশ্বজগতের সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন 

২) লিপিবদ্ধকরণের স্তর অর্থাৎ এই ইমান রাখা যে, আল্লাহ তায়ালা সমস্ত সৃষ্টিজীবের ভাল-মন্দ সবকিছু ‘লাওহে মাহফুজে’ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন 

৩) ইচ্ছা ও মাশয়িইতের স্তর অর্থাৎ এই ইমান রাখা যে, জগতে যা কিছু হচ্ছে ও ঘটছে তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা ও মাশিয়াতের দ্বারাই হচ্ছে ও ঘটছে

৪) সৃষ্টির স্তর অর্থাৎ এই ইমান রাখা যে, আল্লাহ তায়ালা এই জগতের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, মানুষের সকল কর্মের সৃষ্টিকর্তাও তিনি 

কাযা-কদরের বিষয়টি বান্দার ইমানের সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়, যাকে ‘অন্তরের আমল’ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। আল্লাহ আমাদের জন্যে কি লেখে রেখেছেন তা আমাদের জানা নেই, তবে ভাল-মন্দ আমাদের সামনে স্পষ্ট। তাই বান্দা হিসাবে আমাদের উচিত ভাল কাজ করা ও মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকে। 

কাযা-কদরের কারণে মানুষ কোন কাজ করতে বাধ্য নয়, বরং মানুষকে আল্লাহ তায়াল ইখতিয়ার দান করেছেন, যা ইচ্ছা সেটা করার। তবে আল্লাহর অনুমতি ও ইচ্ছা ছাড়া কোন কাজ হতে পারে না। মানুষ যখন কোন কাজ করতে ইচ্ছা করে ও চেষ্ঠা করে তখন আল্লাহ বান্দাকে সেই কাজ করার শক্তি দান করেন। মানুষ যদি কোন কাজ করতে ইচ্ছা না করে তাহলে আল্লাহ তাঁকে সেই কাজ করতে বাধ্য করেন না। 

মানুষকে যে দ্বীনের প্রতি আমল করার আদেশ দেওয়া হয়েছে, আল্লাহর নাফরমানি করতে নিষেধ করা হয়েছে। এবং নেককাজ করার কারণে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে আর মন্দ কাজের কারণে শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। মানুষের মধ্যে যদি ইচ্ছা ও স্বাধীনতা না থাকে, মানুষ যদি অন্য কোন মাধ্যমে কোন একটি নির্দিষ্ট কাজ করতে বাধ্যও হয়ে থাকে তাহলে এই আদেশ-নিষেধ ও পুরস্কার-তিরস্কারের কোন অর্থ থাকে না। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :  

وقل الحق من ربكم فمن شاء فليؤمن ومن شاء فليكفر إنا أعتدنا للظالمين نارا… 

“বলুন, সত্য আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে, সুতরাং যার ইচ্ছা সে যেন ইমান আনে, আর যার ইচ্ছা সে যেন কুফুরি করে, আমি তৈরি করেছি জালিমদের জন্য জাহান্নাম…” (সুরা কাহাফ ২৯)

এইজন্যে মানুষ যদি কোন অন্যায় কাজ করে কাযা-কদরের অজুহাত পেশ করা থাকে তাহলে সেই অজুহাত ও যুক্তি শরিয়াতের দৃষ্টিতে ও যুক্তির নিরিখে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যারা নিজেদের কুফুরি করার পক্ষে আল্লাহর ইচ্ছা বা তাকদিরের যুক্তি পেশ করেছে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের আয়াতে এরশাদ করেছেন :  

وقالوا لو شاء الرحمن ما عبدناهم ما لهم بذلك من علم إن هم إلا يخرصون.

“তারা (কাফেররা) বলেঃ যদি রহমান ইচ্ছা করতেন তাহলে আমরা তাদের (মুর্তিদের) ইবাদত করতাম না। এই সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই, তারা শুধু ধারণা করে কথা বলছে” (সুরা যুখরুফ ২০)

এর মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা কাযা-কদরের দ্বারা মানুষকে কোন কিছু করতে বাধ্য করেননি, বরং তিনি তাদেরকে স্বাধীনতা ও ইখতিয়ার দান করেছেন এবং এই স্বাধীনতা ও ইখতিয়ারি হচ্ছে পুরস্কার ও শাস্তি অর্জনের ভিত্তি বা মুল কারণ। 

আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে আব্বাস রাঃ কে শিক্ষা দিতে এরশাদ করেছেনঃ 

…واعلم أن الأمة لو اجتمعت على أن ينفعوك بشيء لم ينفعوك إلا بشيء قد كتبه الله لك، وإن اجتمعوا على أن يضروك بشيء لم يضروك إلا بشيء قد كتبه الله عليك. رفعت الأقلام وجفت الصحف.

“…মনে রেখো যদি সমগ্র উম্মত একত্রিত হয় কোনভাবে তোমার উপকার করতে তাহলে তারা তোমার সেই পরিমাণই উপকার করতে পারবে যা আল্লাহ তোমার জন্যে লিখে রেখেছেন, কিংবা তারা যদি একত্রিত হয় কোনভাবে তোমার ক্ষতি করতে তাহলে তারা তোমার শুধুমাত্র সেই পরিমাণই ক্ষতি করতে পারবে যা আল্লাহ তায়ালা তোমার বিপক্ষে লিখে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে আর নথি শুকিয়ে গেছে”।

 

  • আসবাব গ্রহণ করাঃ 

 

আল্লাহ তায়ালা এই দুনিয়াকে ‘দারুল-আসবাব’ হিসাবে তৈরি করেছেন। এখানে সবকিছু আসবাব বা উপায়-উপকরণের মাধ্যমেই সম্পাদিত হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা সবকিছুকে পানি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, দুনিয়াতে মানব সৃষ্টির একটি ব্যবস্থা রেখেছেন, সবকিছুর মধ্যে একটি নির্ধারিত স্বভাব ও ধর্ম স্থির করেছেন, সবকিছুর জন্যে একটি নির্ধারিত সময় ও মৌসুম রেখেছেন। এই সবকিছুর মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া বা বিশ্বজগতকে একটি শৃঙ্খলা বা নিয়মনীতির মাধ্যমে পরিচালিত করে থাকেন। 

দুনিয়াতে হযরত আদম আঃ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত কী পরিমাণ মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তার হিসাব একমাত্র তিনিও জানেন। এই সকল মানুষের সৃষ্টির ব্যবস্থা এক ও অভিন্ন, শুধুমাত্র দুনিয়ার প্রথব মানব আদম আঃ ও আমাদের মা হাওয়া আঃ এর সৃষ্টি আর হযরত ইসা আঃ এর সৃষ্টি সেই ব্যবস্থার বাইরে এসে সৃষ্টি করা হয়েছে। 

আল্লাহর রাসুলের জীবন জাগতিক আসবাব-উপায়-উপকরণ গ্রহণ করার উদাহরণে ভরপুর। আল্লাহর রাসুল যখন হিজরত করেন, তখন তিনি পুরাপুরি জাগতিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আল্লাহর রাসুল ক্ষুধার কারণে কষ্ট ভোগ করেছেন, তিনি কাফেরদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন, যুদ্ধের মায়দানে যুদ্ধের পোশাক পরিধান করেছেন। এই সকল বিষয় দ্বারা বুঝা যায় যে, তিনি জাগতিক আসবাব থেকে দূরে থাকেননি। 

এর বিপরীতে তাঁর সমগ্র জীবনে কিছু মুজিযার উদাহরণ দেখা যায়। সেগুলো সংখ্যা ঠিক কি পরিমাণ ছিল, সেটা স্পষ্টভাবে বলতে না পারলেও এতটুকু বলা যায় যে, সেই সংখ্যা তাঁর জীবনের সাধারণ কাজ ও অভ্যাসের সামনে নিতান্ত সামান্য ছিল।

আসবাবের প্রকারভেদ 

আসবাব দুই ধরণের। জাগতিক আসবাব, আবার আধ্যাত্মিক আসবাব। জাগতিক আসবাব বলতে বুঝায়, যা যে কোন মানুষ ব্যবহার করতে পারে, আর আধ্যাত্মিক আসবাব দ্বারা বুঝানো হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি আশা পোষণ করা, আল্লাহর কাছে দোয়া করা, কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন ধরণের আমল, নেক কাজ করা ইত্যাদি। হাদীসে এরশাদ করা হয়েছে ‘দুর্বল মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করার কারণে আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহকারীর রিজিক বৃদ্ধি করে দেন’, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার মাধ্যমে জীবনে বরকত অর্জিত হয়ে থাকে’। 

কিন্তু এখানে একটি বিষয় খেয়াল করা দরকার যে, আল্লাহ তায়ালা একেকটি কাজের জন্যে উপযুক্ত আসবাব নির্ধারণ করে দিয়েছেন আর আধ্যাত্মিক আসবাব বলে সে সকল আসবাব উল্লেখ করা হয়েছে তা সকল ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যায় বা ব্যবহার করা উচিত। 

জুলকারনাইন সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনঃ 

إنا مكنا له في الأرض وآتيناه من كل شيء سببا. فأتبع سببا.

“আমি তাঁকে জমিনে ক্ষমতা দান করেছিলাম এবং তাঁকে আমি দান করেছিলাম সবকিছুর উপায়-উপকরণ। অতঃপর তিনি একটি উপকরণ অনুসরণ করলেন”। (সুরা কাহাফ ৮৪-৮৫) 

আল্লাহ তায়ালা ইসরাইলের বাদশা তালুত সম্পর্কে কুরআনের আয়াতে এরশাদ করেনঃ 

… قال إن الله اصطفاه عليكم وزاده بسطة في العلم والجسم والله يؤتي ملكه من يشاء والله واسع عليم. 

“… তিনি বললেন নিঃসন্দেহ আল্লাহ তাঁকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তাঁকে উপযুক্ত জ্ঞান ও শারীরিক শক্তি দান করেছেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর রাজত্ব দান করেন আর আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও মহাজ্ঞানী” সুরা বাকারাহ, ২৪৭) 

এই দুটি আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা কোন মানুষের মাধ্যমে কোন কাজ করানোর ইচ্ছা করলে তাঁর মধ্যে সেই কাজের আসবাব, শক্তি ও যোগ্যতা সৃষ্টি করেন। আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে ‘কুন’ শব্দের মাধ্যমেই সবকিছু করতে পারেন, কিন্তু তিনি আসবাবের মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছা সম্পন্ন করে থাকেন। 

আসবাব গ্রহণ করার একটি উত্তম ও ব্যবহারিক উদাহরণ হচ্ছে সামনের হাদীসে বর্ণিত ঘটনাটি। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একবার এক বেদুইন সাহাবী এসে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমার উট রশি দিয়ে বেঁধে এরপর তাওয়াক্কুল করবো, না ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবো? জবাবে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করলেনঃ 

اعقلها وتوكل 

“বাঁধো এবং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করো”।

এই আদেশের মাধ্যমে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর রাসুল তাঁকে আসবাব গ্রহণ করতে বলেছেন এবং সেই সাথে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে বলেছেন। শুধু আসবাবের উপর ভরসা করতে যেমন নিষেধ করা হয়েছে আবার তেমনি আসবাব বর্জন করে শুধুমাত্র তাওয়াক্কুল করা থেকেও নিষেধ করা হয়েছে। 

 

  • তাওয়াক্কুল ও তায়াকুলঃ 

 

ইসলামী শরিয়াতে তাওয়াক্কুল একটি গুরুত্বপুর্ণ ইবাদাত, অন্তরের ইবাদত। তাওয়াক্কুলের অর্থ আল্লাহর উপর ভরসা করা। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন : 

“যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে তিনিই তার জন্য যথেষ্ঠ”। (সুরা তাগাবুন, ৩)

আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওয়াক্কুলের ফযিলত সম্পর্কে এরশাদ করেন :  

من قال عند خروجه من بيته بسم الله توكلت على الله ولا حول ولا قوة إلا بالله يقال له هديت ووقيت وكفيت، فيقول الشيطان لشيطان آخر: كيف لك برجل قد هدي وكفي ووقي؟

“ঘর থেকে বের হওয়ার সময় যে ব্যক্তি বলবে, বিসমিল্লাহ, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করলাম, লা হাওলা ওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ, তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছ, নিরাপত্তা লাভ করেছ এবং তোমাকে যথেষ্ট দেওয়া হয়েছে। তখন এক শয়তান আরেক শয়তানকে উদ্দেশ্য করে বলে, এমন ব্যক্তির কি ক্ষতি করতে পারবে যাকে হিদায়েত দান করা হয়েছে, যথেষ্ঠ দান করা হয়েছে ও নিরাপত্তা দান করা হয়েছে ! ”। 

শায়েখ ইবনে বায রাঃ তাওয়াক্কুল সম্পর্কে এক জায়গায় বলেন, “তাওয়াক্কুলের ভিত্তি দুটি জিনিস। এক, আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং এই ঈমান রাখা যে, তিনিই সবকিছু করেন, সবকিছু সৃষ্টি করেন, তাঁর ইচ্ছাই কার্যকর, অন্য কারো নয়। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে আসবাব গ্রহণ করা, আসবাব বর্জন করা তাওয়াক্কুল নয়। যে আসবাব বর্জন করে, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করার দাবী করবে, সে শরীয়ত ও আকলের বিপরীত কাজ করল”। 

আসবাব গ্রহণ করার সাথে সাথে আল্লাহর উপর ভরসা করার নাম হচ্ছে তাওয়াক্কুল। আর কেউ যদি উপযুক্ত আসবাব গ্রনণ না করে, শুধুমাত্র মুখে তাওয়াক্কুল করার দাবী করে, তাহলে সেটা তাওয়াক্কুল হয় না, বরং সেটা হয়ে থাকে ‘তাওয়াকুল’। 

 

  • কিছু ভুল ধারণা 

 

‘সংক্রামক রোগ বলে কোন কিছু নেই’ –এমন একটি ধারণা মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত আছে। যেহেতু মুসলমানদের বিশ্বাস যে জগতের সবকিছু একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছায় ও অনুমতিতে হয়ে থাকে, তাই সেই বিশ্বাস থেকে তাদের কেউ কেউ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, একজনের দেহের রোগ আরেকজনের দেহে সংক্রমণ হতে পারে না। 

এই ধারণা ও বিশ্বাস প্রমাণ করতে যে হাদীসের ভাষ্য উল্লেখ করা হয়ে থাকে, সেই হাদীসের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ যা আলোচনা করেছেন তা থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, হাদীসটি থেকে সংক্রমণের ধারণা যেভাবে নিষেধ করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে, হাদীসটি মূলত সেই অর্থ প্রদান করে না।

لا عدوى ولا طيرة ولا هامة ولا صقر، ولا نوء ولا غول، ويعجبني الفأل.

“কোন সংক্রমণ নেই, কোন কুলক্ষনণ নেই, পেঁচা ও সফর মাসের (কোন ভাল-মন্দ বলতে) কিছু নেই, নক্ষত্র ও মরুভূমির জীন (এর আলাদা কোন শক্তি নেই)। ‘ফাল’ (সুলক্ষণ) আল্লাহর রাসুল পছন্দ করতেন”। 

শায়েখ ইবনে বায রাঃ এই হাদীস সম্পর্কে একটি প্রশ্নের জবাবে বলেন, “হাদীসটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত। হাদীসটির অর্থ জাহেলী যুগের মানুষেরা যে ধরণের বিশ্বাস পোষণ করতো সেই বিশ্বাসকে বাতিল করা হয়েছে। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, কোন রোগ নিজে নিজে স্বভাবজাত ভাবেই একে অপরের মধ্যে সংক্রমণ হয়ে থাকে। তাই আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, এই ধরণের বিশ্বাস একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং এই জগত-জীবনের একমাত্র নিয়ন্ত্রণকারী আল্লাহ তায়ালা। উপস্থিত সাহাবীদের মধ্য থেকে কেউ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, কোন সময় দেখা যায় যে, মরুভূমিতে সুস্থ উট ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু তার সাথে যদি চর্মরোগী উটের সাক্ষাত হয়, তাহলে সেই সুস্থ উটও চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। এর উত্তরে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “তাহলে প্রথম উটের মধ্যে এই রোগ কিভাবে শুরু হল?” অর্থাৎ প্রথম উটের মধ্যে যিনি এই রোগ দিয়েছেন, দ্বিতীয় উটের মধ্যেও তিনিও দিয়েছেন। এরপর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সামনে স্পষ্ট করলেন যে, একত্রিত হওয়ার কারণে কখনো কখনো অসুস্থের দেহ থেকে সুস্থের দেহে রোগ সংক্রমণ হতে পারে, যদি আল্লাহ তায়ালার অনুমতি ও ইচ্ছা থাকে। তাই অন্য আরেক হাদীসে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

لا يورد ممرض على مصح.

“অসুস্থ উট যেন সুস্থ উটের সাথে না রাখা নয়”

আরেক হাদীসে তিনি এরশাদ করেছেনঃ

فر من المجذوم فرارك من الأسد

“কুষ্ঠরোগী থেকে পালাও, যেমন সিংহ থেকে পালাও”। 

আলোচনার মূলকথা এটা যে, রোগ-ব্যাধি স্বভাবজাত ভাবেই একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে সংক্রমণ করতে পারে না, বরং বিষয়টি আল্লাহ তায়ালার হাতে। তিনি যদি ইচ্ছা করেন, তাহলে অসুস্থ ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমণ হতে পারে, আবার তিনি যদি ইচ্ছা না করেন তাহলে তা হতে পারে না। তবে মুসলমানদেরকে আদেশ দেওয়া হয়েছে তারা যেন যথার্তভাবে সতর্কতা অবলম্বন করে। 

(https//binbaz.org.sa/fatwas/29004)

অন্য হাদিসে নবীজি বলেছেন, 

إذا سمعتم الطاعون بأرض فلا تدخلوها، وإذا وقع بأرض وأنتم فيها فلا تخرجوا منها.

হযরত উসামা বিন যাইদ রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ “যদি কোন অঞ্চলে মহামারী হওয়ার কথা জানতে পারো, তাহলে সেখানে যেও না, আর যদি তোমাদের অঞ্চলে মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটে তাহলে সেখান থেকে বের হও না”। 

 

  • ভুল ধারণা সৃষ্টি হওয়ার কারণ 

 

করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে এই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্যে কিছু ভুল বিশ্বাস ও আচরণ সৃষ্টি হওয়ার পিছনে বেশ কিছু কারণ ও উৎস রয়েছে। তার বিশেষ কিছু কারণ ও উৎস হচ্ছে নিম্মে উল্লেখ করা হল। 

আল্লাহর সুনান সম্পর্কে অবগত না হওয়া 

আগেও বলা হয়েছে যে, আমাদের সামনে একদিকে রয়েছে আল্লাহর কুদরত, আর আরেক দিকে রয়েছে আল্লাহর সুন্নত। আল্লাহর কুদরত সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। আমরা অবগত আছি যে, আল্লাহ তায়ালা সবকিছু করতে সক্ষম, মুমিনদের সাহায্য আল্লাহর উপর ‘হক’। কিন্তু সেই কুদরতের সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালার কিছু সুনান রয়েছে, এই জগত পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্ধারিত সুনান কাওনিয়াহ অনুসরণ করা হয়ে থাকে –সেই সম্পর্কে আমরা উদাসীন আছি। 

হযরত ইবরাহীম আঃ এর আগুনের মধ্যেও নিরাপদ থাকার ঘটনা আমরা সবাই জানি, এবং ঘটনাটিকে আল্লাহর কুদরতের প্রমান হিসাবে আমরা সবাই বিশ্বাস করে থাকি। এটা আল্লাহর কুদরত। এই কুদরতের বাইরে আল্লাহ তায়ালা আগুনের মধ্যে বিশেষ শক্তি, স্বভাব বা ধর্ম সৃষ্টি করা রেখেছেন যা হচ্ছে পুড়িয়ে দেওয়ার শক্তি। এটা হচ্ছে আল্লাহর সুন্নত। খুব সামান্য সময়ের জন্যে এবং আল্লাহর বিশেষ হিকমতের উদ্দেশ্যে দুনিয়ার সকল বস্তু তাদের নিজস্ব স্বভাব ও ধর্মের বিপরীত কাজে নিয়োজিত হয়েছে। 

আল্লাহর সাহায্য অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট সঠিকভাবে অনুবাধব না করা 

পবিত্র কুরআনে যে সকল নবী-রাসুলের আলোচনা এসেছে, সে সকল আলোচনার একটি মৌলিক দিক ছিল এটা যে, নবী-রাসুলগণ তাদের কওমের মাঝে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পেশ করেছেন, তাদের সেই দাওয়াত একদল মানুষ গ্রহণ করে ঈমান এনেছেন, শরিয়তের অনুসরণ করেছেন আর আরেকদল মানুষ সেই দাওয়াত অস্বীকার করেছে এবং প্রেরিত নবী ও তাঁর অনুসারীদের বিরোধিতা ও তাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে। এরপর সেই নবীর জীবদ্দশায় আল্লাহ তায়ালা আযাব অবতীর্ণ করেছেন, ফলে দাওয়াত অস্বীকারকারীরা ধ্বংস হয়েছে আর ইমান আনয়নকারীগণ মুক্তি লাভ করেছেন এবং আল্লাহ তায়ালা তাদের মাধ্যমে দুনিয়া আবাদের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। 

হযরত নুহ আঃ এর ঘটনা উদাহরণ হিসাবে স্বরণ করি, যারা তাঁর দাওয়াত অস্বীকার করেছিল আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মহাপ্লাবন দ্বারা ধ্বংস করে দেন, আর যারা তাঁর দাওয়াত কবুল করেন তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিশতির মাধ্যমে হিফাজত করেন এবং এই দুনিয়াকে নতুনভাবে আবাদ করেন। কুরআনের আয়াত, 

قيل يا نوح اهبط بسلام منا وبركات عليك وعلى أمم ممن معك وأمم سنمتعبهم ثم يمسهم منا عذاب أليم. 

“বলা হলঃ হে নুহ, (কিশতি থেকে) অবতরণ করো আমার পক্ষ থেকে শান্তি নিয়ে, আর তোমার উপর বরকত বর্ষিত হোক এবং যারা তোমার সাথে আছে তাদের উপর, আর কিছু জাতি তাদেরক আমি অচিরেই কিছু ভোগ-বিলাস দান করবো, এরপর তাদেরকে আমার পক্ষ থেকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে”। (সুরা হুদ ৪৮) 

এখানে আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের ধ্বংস করে দিয়েছেন আর মুমিনবান্দাদের হিফাজত করেছেন। এখান থেকে আমরা এই সিদ্ধান্ত বা ইবরত হাসিল করি যে, আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের ধ্বংস করবেন আর মুমিনদের হিফাজত করবেন। কিন্তু এখানে যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করার বিষয় সেটা এই যে, এই  স্থানের স্বাভাবিক দাবীই ছিল নবীর দাওয়াত অস্বীকারকারীদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া। কারণ এখানে নবী-রাসুলদের দাওয়াতের সত্যতা এবং তারা যে ওয়াদা দিয়ে এসেছেন, সেই ওয়াদা সত্য করে দেখানোর উদ্দেশ্য ছিল। এবং এই ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের জামাতকে অলৌকিকভাবেই হিফাজত করেছেন, যা ছিল জাগতিক উপায়-উপকরণের বাইরের উপকরণ, যাতে আল্লাহর অসীম কুদরত-শক্তি প্রকাশ পেয়ে থাকে।

আল্লাহ তায়ালা যে প্রেক্ষাপটে নবী-রাসুলদের তাদের কওমের বিরুদ্ধে সাহায্য করেছেন, সেই প্রেক্ষাপটকে খুব সুক্ষভাবে আমরা চিহ্নিত ও নির্ধারণ করে, সেই প্রেক্ষাপটের সাথে জীবন ও জগতের অন্যান্য সাধারণ বিপদ-আপদের মাঝে পার্থক্য নির্ধারণ করার ব্যাপারে একটা সাধারণ সচেতনতা ও দর্শন নির্ধারণ করতে আরো বেশী স্পষ্ট হওয়ার দরকার ছিল। 

কিছু উপমাকে কেন্দ্র করে বিশ্বাস স্থাপন করাঃ 

অনেক সময় বলা হয়ে থাকে যে, মসজিদ বা মাদ্রাসা হচ্ছে, নূহ আঃ এর কিশতির মত, যারা এখানে উপস্থিত হবে, তারা বিপদে নাজাত লাভ করবে আর যারা এখান থেকে দূরে থাকবে তারা ধ্বংসের মুখে পড়বে। 

এই ধরণের উপমা পেশ করার মধ্যে কোন আপত্তি দেখি না। তবে এই ধরণের উপমা সাধারণ মানুষের চিন্তায় ভুল বার্তা সৃষ্টি করে থাকে। নূহ আঃ এর কিশতির ব্যাপারে আমাদের চিন্তায় যে বিষয়টি বদ্ধমূল হয়ে আছে, সেটা এই যে, চূড়ান্ত বিপদের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা এই কিশতির মাধ্যমে এক শ্রেণীর মানুষকে হিফাজত করেছেন, সুতরাং যুগে যুগে যারাই এই কিশতি-সদৃশ কোন স্থানে অবস্থান করবেন তাদেরকেও তিনি হিফাজত করবেন। এই বিশ্বাসকে আমরা অস্বীকার করার কোন যুক্তি দেখি না, কারণ যারা মসজিদ, দ্বীনী মাদ্রাসার সাথে সম্পর্ক রাখে, তারা অবশ্যই আল্লাহর পথে চলার চেষ্ঠা করেন আর যারা আল্লাহর পথে চলার চিন্তা ও চেষ্ঠা করবে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে অবশ্যই সাহায্য করবেন। 

বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে যদি কাউকে বলা হয় যে, বিপদ থেকে বাঁচার একটি অবলম্বন হিসাবে মসজিদে না গিয়ে ঘরেই ফরজ নামাজ আদায় করো, তাহলে তাঁর চিন্তায় আসবে যুগে যুগে  মসজিদেই আমরা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করার জন্য উপস্থিত হয়েছি, এই মসজিদ হচ্ছে আমাদের জন্যে নূহ আঃ এর কিশতি। কাজেই সেদিন যেমন কিশতিতে আরোহণ করে নূহ আঃ এর অনুসারী মুমিনবান্দাগণ মাহফুজ ছিলেন, আজকের এই বিপদে আমরাও মসজিদে আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর হিফাজত অর্জন করবো ইনশা আল্লাহ। 

অতিরঞ্জন ও আবেগি বক্তব্যকে শরীয়তের দলীল হিসাবে গ্রহণ করা 

অনেক সময় দেখা যায়, সমাজের গ্রহণযোগ্য মানুষের কিছু অতি আবেগি ও অতিরঞ্জিত বক্তব্য তাদের অনুসারীদের মধ্যে বিশেষ ক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে। কেউ হয়ত বললেন যে, যারা নিয়মিত অজু করে ও নামাজ আদায় করে, তাদেরকে এই বিপদ স্পর্শ করতে পারে না। এই ধরণের বক্তব্যের ভিত্তি আবেগ ছাড়া আর কোন কিছু কি হতে পারে? এটা ছিল নিছক ব্যক্তির ব্যক্তিগত অনুভূতি। কিন্তু ব্যক্তিগত অনুভূতি আর শরিয়াতের দলীল যে দুটি আলাদা জিনিস, সেই বিষয়টি আমরা খেয়াল রাখি না। 

স্বপ্নকে দলীল মনে করা

আমাদের সাধারণ মানুষের কিছু বিশ্বাস ও আচরণের পিছনে নিজের বা কারো স্বপ্ন ভিত্তি বা দলীল হিসাবে কাজ করে। অনেক সমস্যার সমাধান আমরা স্বপ্নে পেয়েছি বলে দাবী করে থাকি। স্বপ্নে আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাকে বিশেষ ইশারা প্রদান করা হয়ে থাকে –যেটা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু শরীয়তের কোন বিষয়ে স্বপ্ন কোন অবস্থাতেই দলীল হিসাবে কাজ করতে পারে না। শরিয়তের দলীল কুরআন-সুন্নাহ। 

অলসতাকে তাকদিরের নামে বৈধ করা 

আল্লাহ তায়ালা  অনেক বিপদ থেকে মুক্তির পথ মেহনতের মধ্যে রেখেছেন। কিন্তু দেখা যায় যে, অনেক ক্ষেত্রে আমরা মেহনত করতে আগ্রহী হই না, বা মেহনত না করে অলসতা করতে বেশী পছন্দ করি বা আরামবোধ করে থাকি। কিন্তু মানুষ যে কোন আচরণের বৈধতা প্রমাণ করার জন্য কিছু ‘সনদ’ বা ভিত্তি গ্রহণ করে থাকে। তাই দেখা যায়, অনেক সময় আমরা আমাদের অলসতাকে ‘তাকদিরে যা আছে তাই হবে’ প্রলেপ দিয়ে বৈধ করার চেষ্ঠা করে থাকি। 

প্রত্যেক কাজ ও সমাধান অর্জনের জন্যে আল্লাহ তায়ালা কিছু আসবাব নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সেই আসবাব গ্রহণ করে মেহনত করা জরুরী। কিন্তু আমরা মেহনত থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখার জন্য বা মেহনত আমাদের জন্য আরামদায়ক নয় বলে সেই কষ্ট বা সমস্যাকে মেনে নিয়ে থাকি, আর মুখে বলতে থাকি আল্লাহ তায়ালা যা তকদিরে লিখে রেখেছেন তাই হবে, কেউ তা বদলাতে পারবে না। তার কথা সত্য –আল্লাহ তায়ালা যা লিখে রেখেছেন তা কেউ বদলাতে পারবে না, কিন্তু এই সত্য কথাটিকে একটি অসত্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। 

উপসংহার

আলোচনার শেষে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাচ্ছি। মনে করুন বিপর্যয় যদি করোনাভাইরাস দ্বারা সৃষ্টি না হয়ে অন্য কোন মাধ্যমে সৃষ্টি হত। যেমন ধরুন ঘরের বাইরে যদি গরম বা লু-হাওয়া প্রবাহিত হত, বা গরম পানির বৃষ্টি হত তাহলে সেই অবস্থাতে কেউ কি কষ্ট স্বীকার করে মসজিদে যেত? বা কেউ যদি দ্বীনের মুহাব্বতে মসজিদে যাওয়ার ইচ্ছা করত, তাহলে তাঁকে কিভাবে অন্যরা বুঝাত বা বাঁধা প্রদান করত? 

এর উত্তর যদি এই হয় যে, সেই অবস্থায় আমরা মসজিদে উপস্থিত না হয়ে, শরীয়ত কর্তৃক প্রদত্ত রুখসত গ্রহণ করতাম, আর কেউ যদি সেই অবস্থায় বাইরে যাওয়ার চিন্তা করত, তাহলে আমরা তাঁকে বুঝাতাম যে, এই অবস্থায় বাইরে যাওয়া শরীয়তের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এখন ঘরে থাকাটাই শরীয়তের আদেশ, ঘরের বাইরে যাওয়া শরীয়তের খেলাফ।  

তাহলে এর অর্থ কি এটা হয় না যে, আমরা যতটুকু ঈমানের কারণে এখন মসজিদে যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে, তাঁর চেয়ে বেশী মনে হয় বিপদটি আমাদের সামনে তেমন স্পষ্ট নয়, বা এই বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ তাদের বক্তব্যকে আমরা গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেনি বলেই এমন আচরণ করছি। যদি আসমান থেকে বাহ্যিক কোন বিপদ আপতিত হত, যেমন দুটি উদাহরণ দিলাম, তাহলে আমাদের ঈমানের অবস্থা কী হত?

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেনঃ 

قل لن يصيبنا إلا ما كتب الله لنا هو مولانا وعلى الله فليتوكل المؤمنون.

“বলুন, আল্লাহ আমাদের জন্য যা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন শুধুমাত্র তাই আমাদের কাছে পৌঁছবে, তিনি আমাদের মাওলা, আর আল্লাহর উপরই মুমিনগণ তাওয়াক্কুল করেন”। (সুরা তাওবাহঃ ৫১)। 

এই দুনিয়াতে ও আমাদের জীবনে যা কিছু হচ্ছে ও ঘটছে তার সবকিছু একমাত্র আল্লাহর ইলম, নির্ধারণ, ইচ্ছা ও কুদরতের মাধ্যমেই হচ্ছে ও ঘটছে। সেটা আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ইবতিলা। প্রত্যেকটি অবস্থার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত আসবাব বা উপায়-উপকরণ নির্ধারিত রয়েছে, এবং আমাদেরকে সেই আসবাব গ্রহণ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে, বাকি আসবাবের উপর ভরসা না করে শুধুমাত্র আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করার আদেশ দেওয়া হয়েছে, এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, ‘যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবে তিনিই তার জন্য যথেষ্ঠ হবেন’। 

বর্তমান সময়ে বিদ্যমান করোনাভাইরাস মহামারী আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ইবতিলা-পরীক্ষা জগতবাসীর জন্য। দুনিয়ার সকল বালা-মুসিবত আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের গুনাহ ও অন্যায়ের কারণে অবতীর্ণ হয়ে থাকে। সেই অবস্থায় মানুষের দায়িত্ব আল্লাহর দিকে ফিরে আসা, তাঁর সাথে বান্দাসুলভ সম্পর্ক মজবুত করা। বিপদ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা, ইস্তিগফার করা, এবং সেই সাথে যুক্তিসম্মত উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা, তবে তার উপর ভরসা না করা। 

কাজেই আমাদেরও এই পরিস্থিতিতে বেশী বেশী আল্লাহর নিকট তাওবা ও ইস্তিগফার করা কর্তব্য, এবং সেই সাথে মাশরু বা বৈধ আসবাব গ্রহণ করা। আল্লাহ তায়ালা কুরআনের এরশাদ করেছেনঃ 

وما كان الله ليعذبهم وأنت فيهم وما كان الله معذبهم وهم يستغفرون.

“আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার নন, যতদিন আপনি তাদের মাঝে আছেন, আর আল্লাহর তাদেরকে শাস্তি দিবেন না, যতদিন তারা ইস্তিগফার করতে থাকে” (সুরা আনফাল ৩৩)    

ولنبلونكم بشيء من الخوف والجوع ونقص من الأموال والأنفس والثمرات وبشر الصابرين. الذين إذا أصابتهم مصيبة قالوا إنا لله وإنا إليه راجعون. 

“আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। তাদেরকে যারা বিপদে আক্রান্ত হলে বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী” (সুরা বাকারাহঃ ১৫৫-১৫৬)। 

نعوذ بكلمات الله التامات من شر ما خلق.

“হে আল্লাহ, আমরা আপনার পরিপুর্ণ কালিমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি, আপনার সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে”। 

 

The post করোনা-কালে মুসলমানের আকীদাহ : একটি প্রয়োগিক পাঠ appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/2V2wgoD

No comments:

Post a Comment