Sunday, March 19, 2023

রমজানে তারাবি পাচ্ছেন না হাফেজগণ

যুবাইর ইসহাক

দরজায় কড়া নাড়ছে রমজান। এ সময়ে অন্যদের মতো হাফেজদেরও ব্যস্ততা বেড়েছে। তাদের অনেকে তারাবির জন্য মসজিদ ঠিক করছেন, তারাবির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।  রমজানের তারাবি হাফেজদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ। তারাবির মাধ্যমে হাফেজরা সারা বছরের তেলাওয়াতের ঘাটতি কাটিয়ে ওঠেন।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক হাফেজ তারাবি পাচ্ছেন না। আগে তারাবি পড়ালেও বর্তমানে তারাবির বাইরে থেকে যাচ্ছেন তারা। হাফেজদের তুলনায় পর্যাপ্ত মসজিদে খতমে তারাবি না হওয়ার পাশাপাশি স্বজনপ্রীতিসহ নানান কারণ উল্লেখ করেছেন হাফেজগণ। ফাতেহের কাছে তুলে ধরেছেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।


কেন তারাবি হচ্ছে না?

হাফেজ মাওলানা মামনূন মারজান। বর্তমানে কওমি ধারার উচ্চমাধ্যমিক স্তরের একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন। হিফজ শেষ করেছেন ১২ বছর আগে। এরপর থেকে নিয়মিত খতমে তারাবি পড়িয়ে আসছিলেন। কিন্তু দুই হাজার বিশ ও বাইশ সালে তার তারাবির পড়ানো হয় নি। এবার এখনো তারাবির ব্যাপারে নিশ্চিত নন।

তারাবি না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি ফাতেহকে জানান, ‘আমাদের দেশে এখন হাফেজের সংখ্যা অনেক। প্রতি বছর নতুন অনেকে হিফজ শেষ করে বের হচ্ছেন। কিন্তু সে অনুপাতে মসজিদগুলোতে খতমে তারাবি হচ্ছে না। বিশেষ করে, করোনার পর সে সংখ্যা আরো কমে গেছে। আগে অনেক জামে মসজিদে খতমে তারাবি হলেও এখন তারা নিজেদের ইমাম দিয়ে সুরা তারাবি আদায় করেন।’

মামনূন মারজান সহজে তারাবির না পাওয়ার ব্যাপারে মসজিদ কমিটির সমস্যার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি জানান, ‘ অনেক মসজিদে কমিটির  প্রভাবশালীরা নিজেদের পরিচিত হাফেজ রাখতে চান। কখনো এ নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধও দেখা দেয়। ফলে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা থেকে বাঁচতে খতমে তারাবি বন্ধ হয়ে যায়।’

হাফেজ মাওলানা উবায়দুল্লাহ তাসনিম প্রতি বছর নতুন হাফেজ বের হচ্ছে, একে ইতিবাচক চিত্র হিসেবেই দেখেন। তবে তাদের তারাবি না হওয়ার পেছনে স্বজনপ্রীতিকে উল্লেখ করেন। তার মতে, তারাবি দিন দিন চাকরির বাজারের মতো হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘প্রভাবশালী আত্মীয়-স্বজন না থাকলে যেমন চাকরি হয় না, এখন দেখা যাচ্ছে, আত্মীয়-স্বজন না থাকলে তারাবিও হয় না।’  বিপরীতে যাদের হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সাপোর্টার অথবা আত্মীয়স্বজনের সুবাদে সুযোগ মিলছে।  মানে, ব্যাপারটা পুরো চাকরির বাজারে পরিণত হয়েছে।’ 

হাফেজ মাওলানা ফয়সল আহমদ হাফেজ বৃদ্ধির পাশাপাশি মসজিদের নিয়মিত ইমাম ও মুসল্লিদের অনীহার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘অনেক ইমাম সাহেব মসজিদে খতমে তারাবি চান না। এতে রমজানে তার সুযোগ কমে যায়। অবশ্য এ সংখ্যা নগন্য। পাশাপাশি অনেক মসজিদে বৃদ্ধ মুসল্লিদের কথা ভেবে খতমে তারাবির আয়োজন করা হয় না। আবার কোনো কোনো দরিদ্র এলাকায় মুসল্লিগণের জন্য হাদিয়া দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই তারা খতমে তারাবি পড়তে চান না।’

হাফেজ জাকির সোহরাব হাফেজের আধিক্যতা ও স্বজনপ্রীতির পাশাপাশি কমিটির চাহিদার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘কমিটির চাহিদা থাকে বেশি। দেখা যায়, বর্তমানে খুব ছোটবেলায় ছাত্ররা হিফজে ভর্তি হয়ে দশবারো বা তারচেয়েও কম বয়সে হাফিজ হয়ে যায়। এ বয়সে দাড়ি না থাকা বা গায়েগতরে একটু কমজোর হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এটা কমিটির প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।”হাফিজ সাহেব তো ছোট! দাড়ি নেই। পড়াতে পারবেন তো?” তারা আরো নানান যুক্তি দেখান।’

তারাবি না পড়ানোর ক্ষতি 

মাওলানা মারজান মনে করেন, তারাবি পড়ানোর ফলে সারা বছর নিয়মিত তেলাওয়াত না করায় যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়, সেটা কাটিয়ে উঠা যায়। তারাবির জন্য প্রস্তুতি নিলে হিফজের দুর্বলতা কেটে যায়। বিপরীতে তারাবি না হলে  সে সুযোগ হয়ে উঠে না। ফলে হিফজ দুর্বল হতে থাকে। 

উবায়দুল্লাহ তাসনিম বলেন, ‘সবচে’ বড় সমস্যা আমার কাছে যা মনে হয়, তারাবি না হওয়ায় আমরা কুরআন নাজিলের মহিমান্বিত মাসেও কুরআন তিলাওয়াতের সাথে জুড়তে পারি না।  আলসেমি বা দুনিয়ার নানা জঞ্জালে পড়ে বলতে গেলে সারা বছর আমাদের কুরআন তিলাওয়াতের সাথে সম্পৃক্ততা থাকে না। রমজানই যা ভরসা। দেখা যায়, তারাবি না হলে এ মাসেও খুব একটা তেলাওয়াত হয় না’

ফয়সল আহমদ তেলাওয়াতের ঘাটতির পাশাপাশি সামাজিক তাচ্ছিল্যের বিষয়টিও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় যে হাফেজ সাহেবদের তারাবি হয় না, তাদেরকে সমাজে কিছুটা ছোট করে দেখেন।’

জাকির সোহরাবের মতে, ‘ মুখস্থ শক্তির হ্রাস পায়, এটি প্রধান সমস্যা। এক বছর তারাবি না পড়ালে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা পরবর্তী বছর তারাবি পড়াতে গেলে বুঝা যায়। হিফজ শেষ করে হাফিজ সাহেবরা কেউ কেউ কিতাব বিভাগে অধ্যায়নে যান। কেউ কেউ অন্যান্য পেশায় নিজেকে জড়িয়ে নেন। এ কারণে কোরআন শরিফের পেছনে প্রয়োজন অনুযায়ী মেহনত করা হয় না। এছাড়া তারাবি না হলে আশেপাশের লোকদের খোঁচানো, কটু কথায় রীতিমতো মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’

সমাধান কি সম্ভব? 

মামনূন মারজান মনে করেন, প্রত্যেক জামে মসজিদে যথাসম্ভব খতমে তারাবির আয়োজন করতে হবে। যেসব মসজিদে হাদিয়ার কারণে তারাবি হয় না, সেক্ষেত্রে তিনি হাফেজদের অর্থনৈতিক মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসার কথা বলেন। হাফেজ নিয়োগে অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, তিনি এ বিষয়েও জোর দেন।

ফয়সল আহমদ বলছেন, তারাবির ক্ষেত্রে দুয়েকজন হাফেজ নির্ধারণ না করে তিনচার জন হাফেজ নিয়োগ দিলে তারাবি না পাওয়া হাফেজের সংখ্যা অনেক কমে আসবে। তাছাড়া যে এলাকায় হাদিয়ার জটিলতায় তারাবি হচ্ছে না, তারা যদি আগে বলে হাদিয়া ছাড়া পড়াতে রাজি এমন হাফেজ নিয়োগ নেন, তাহলে সেখানেও তারাবি আয়োজন সম্ভব। তবে নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিটির মধ্যে স্বচ্ছতা থাকা জরুরি।

তারাবির বাইরে থাকা হাফেজগণ তারাবিতে ফিরতে চান। তারা রমজান মাসে নিজেকে কুরআন তেলাওয়াত ও কুরআনের খেতমতে ব্যস্ত রাখতে আগ্রহী। তারাবি না হলে হাফেজরা ভুগেন নানাবিধ সামাজিক-ব্যক্তিগত জটিলতায়।

The post রমজানে তারাবি পাচ্ছেন না হাফেজগণ appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/wNf3PuO