Wednesday, August 17, 2022

‘শুভংকরের ফাঁকি’ : বিতর্কের মুখে ইসলামি ব্যাংকিং

রাকিবুল হাসান নাঈম:

সুদ থেকে বাঁচার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সুদি ব্যাংক থেকে সরে ইসলামি ব্যাংকগুলোর দিকে ঝুঁকছে বেশি। প্রচলিত ব্যাংকে আমানত রাখলে যে পরিমাণ সুদ পাওয়া যায়, ইসলামি ব্যাংকগুলো সচরাচর তারচেয়ে বেশি মুনাফা দেয় না, তবুও। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে সাধারণ গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি আমানত রেখেছেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে। শুধু তাই নয়, করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাংক খাতে যখন টাকার সংকট, তখন প্রথম ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এমনকি আমানতের হিসাবে শীর্ষ পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে তিনটিই ইসলামি ধারার ব্যাংক।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রচলিত ব্যাংক ও ইসলামি ব্যাংকের তুলনা-প্রতিতুলনায় তৈরী হয়েছে বিতর্ক। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের নামে যা হচ্ছে, তা একটা কৌশলমাত্র। এগুলোর কার্যক্রম প্রচলিত ব্যাংকের চেয়ে খুব একটা ভিন্ন নয়। দেখা যায়, প্রচলিত ব্যাংকগুলো যে প্রকল্পে অর্থায়ন করছে, একই প্রকল্পে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোও বিনিয়োগ করছে। বলা হচ্ছে, ইসলামি ব্যাংকগুলো ইসলামি ব্যাংকিংয়ের নিয়ম-কানুন ঠিকঠাক পালন করছে না। বরং যতটুকু ইসলামি আবহাওয়া ছিল, সেটাকেও দিনকে দিন সংকুচিত করা হচ্ছে।

শুভংকরের ফাঁকিটা কোথায়?

চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মোহাইমিন পটোয়ারির বই ‘ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থার শুভংকরের ফাঁকি’। বইটিতে লেখক মোটাদাগে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, ইসলামি নামের আড়ালে কোথায় ফাঁকিটা দিচ্ছে ইসলামি ব্যাংকগুলো। বইটি প্রকাশের আগ-পর মিলিয়েই তৈরী হয়েছে বিতর্ক।

প্রতিবেদকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয় অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মোহাইমিন পটোয়ারির। তিনি বলেন, ‘আমি শরিয়া বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা, সেন্ট্রাল শরিয়া বোর্ডের সদস্য-সহ আরও বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। তারা স্বীকার করেছেন, প্রচলিত ব্যাংকগুলো থেকে ইসলামি ব্যাংকে খুব একটা পার্থক্য নেই। এখানে কৌশলে কার্যোদ্ধার করছে। কিন্তু একটা সিস্টেম চালু হয়ে গেছে। এটা এভাবেই চলবে।’

মোটাদাগে ইসলামি ব্যাংকের ফাঁকিটা জানতে চাইলে তিনি সাতটি পয়েন্ট তুলে ধরেন।

১. মুরাবাহা, বাইয়ে মুআজ্জাল সহ বিভিন্ন লেনদেনে ব্যাংকগুলো শরিয়াসম্মত শর্তগুলো পালন করছে না। সুদের নিমিত্তে অনেক ক্ষেত্রেই বাহানা তৈরী করছে।

২. ইসলামি ব্যাংকগুলো নিজেদেরকে সুদি কারবার বলে না। তারা বলে আমরা ব্যবসা করছি। ব্যবসায় লাভ-লস দুটোরই ভাগ নিতে হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো লাভ-লসে ভাগ নেয়ার বিষয়টি (মুরাবাহা) ক্রমশ সংকুচিত করে একেবারে নাই করে ফেলছে। অর্থাৎ, তারা কেবল লাভটাই নিতে চায়।

৩. ঋণ নিয়ে অল্প সময়ে পরিশোধ করলে ছাড় দেওয়া হয় এবং বেশি সময় পর দিলে জরিমানা দিতে হয়। এই ছাড় ও জরিমানার হার সুদের বাজার দরের সমান।

৪. যারা ডিপোজিট করে, তাদেরকে ব্যবসায়িক লাভের ভাগ ঠিকমতো দেওয়া হয় না। অথচ ব্যাংক দেউলিয়া হলে পুরা দায় চাপিয়ে দেয় ডিপোজিটকারীর উপর। অর্থাৎ, তাদের টাকার পরিমাণ শূণ্য হয়ে যায়।

৫. ডিপোজিটররা কোনদিন টাকা রেখে লস করে না। কিন্তু প্রতিটি ব্যবসাতেই লস আছে।

৬. ইসলামি ব্যাংক অন্য ব্যাংকের মতো ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ সিস্টেমে টাকা তৈরী করে। তারা নিজেরাই ওয়েবসাইটে তা স্বীকার করেছে।

৭. ইসলামি ব্যাংকগুলো পরিচালনার জন্য নেই স্বাধীন শরিয়া বোর্ড। দেখা যায়, শরিয়া বোর্ডগুলো থাকে ব্যাংকের এমডির অধীনে। কোনো কোনো ডিরেক্টর শরীয়া বোর্ডের সদস্য। ফলে শরিয়া বোর্ডের সিদ্ধান্ত নিজেদের মতো করেই নেয়া হয়। স্বাধীনভাবে নেয়ার সুযোগ থাকে না। তাছাড়া ইসলামি ব্যাংকগুলো পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ইসলামি ব্যাংকিং আইন। সবমিলিয়ে ব্যাংকগুলো শরিয়াসম্মত চলছে কিনা, তা নিয়ে কারো কোনো তদারকি নেই।

কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা?

বিশ্বে ব্যাংক ব্যবস্থা ৬০০ বছর আগে যাত্রা শুরু করলেও ইসলামি ধারার ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হয় ১৯৬৩ সালে। বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং চালু হয় ১৯৮৩ সালে। দেশি-বিদেশি উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে ইসলামি ব্যাংকিং শুরু।

ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পার হলেও পরিপূর্ণ শরিয়াসম্মত নীতি চলার পরিবেশ তৈরী করতে পারেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর অধ্যাপক ড. শাহ মো. আহসান হাবীব বলেন, ‘ইসলামি ব্যাংক প্রফিট-লস শেয়ারিং বা মুশারাকা পদ্ধতি বলে যে ব্যাংকিংয়ের কথা বলে, বাস্তবে তেমনটি দেখা যায় না। ইসলামি ব্যাংক কখনও লসের ভাগ নিয়েছে বলে এখন পর্যন্ত শুনিনি।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, বিশ্বের কোনও ইসলামি ব্যাংকিং সিস্টেমেই প্রফিট-লস শেয়ারিং দেখা যায় না। ইসলামি ব্যাংক যেভাবেই চলুক না কেন, মানুষ মনে করে ইসলামসম্মত ব্যাংকিং করে। সুদমুক্ত থাকার জন্য সেখানে তারা টাকা রেখে আসে। এই ব্যাংকের ডিপোজিট কালেকশনের জন্য কোনও মার্কেটিংও করতে হয় না। ইসলামি ব্যাংকগুলো মূলত রেট ফিক্সড না করে বলতে চায়, তারা সুদমুক্ত। বাদবাকি সবই সাধারণ ব্যাংকের মতোই।’

ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাংক নিজেদের লাভটাই দেখে বলে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মুনিরুল মওলা। তিনি বলেছিলেন, ‘সচেতন ব্যবসায়ীরা সব সময় লাভ করার পরিকল্পনাই করেন। আমরাও দেখেশুনে বিনিয়োগ দেই। দেখা যায়, ৯৫ থেকে ৯৬ শতাংশ প্রকল্পই লাভে থাকে। ৩-৪ শতাংশ হয়তো লোকসানে পড়ে। অর্থাৎ গড় হিসেবে ব্যাংকের লাভই বেশি। যে কারণে লোকসানের ভাগ নেওয়ার পরও ব্যালেন্স শিটে সেটার প্রভাব পড়ে না।’

ইসলামি ব্যাংকের সেবা কতটুকু বিস্তৃত

বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি বছরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে অন্তত সাড়ে ৫ হাজার শাখা-উপশাখায় ইসলামি ব্যাংকিং পরিচালিত হচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি মোট ৩৩টি ব্যাংক কোনও না কোনোভাবে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে।

এর মধ্যে পুরোপুরি ইসলামি ধারায় আছে ১০টি। ব্যাংকগুলো হলো— ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক।

আরও ৯টি ব্যাংক তাদের ৪০টি শাখায় ইসলামি ব্যাংকিং পরিচালনা করছে। এর বাইরেও ১৪টি ব্যাংক তাদের ১৯৪টি শাখায় ‘ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো’ খুলেছে।

আরও জানা গেছে, গত সাত বছরে ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার কেন্দ্র বেড়েছে অন্তত সাড়ে পাঁচগুণ। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯০০টি শাখায় চলেছে ইসলামি ব্যাংকিং। এখন হচ্ছে ৫ হাজার ১২৩টি শাখায়।

দেখা যায়, বেসরকারি খাতের অন্য কোনও ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের ধারেকাছেও নেই। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমানত রয়েছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ দ্বিতীয় সর্বোচ্চর চেয়ে ইসলামী ব্যাংকের আমানত তিনগুণেরও বেশি।

আগামীকাল পড়ুন: অভিযোগগুলো কিভাবে দেখছেন ইসলামি অর্থনীতিবিদরা

The post ‘শুভংকরের ফাঁকি’ : বিতর্কের মুখে ইসলামি ব্যাংকিং appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/98OA6vR

Friday, August 12, 2022

মুসলিম সভ্যতা নির্মাণ: কালোদের ভূমিকার অনুসন্ধান

 

 

রাকিবুল হাসান:

 

১৯৪৮ সালে ওকলাহোমা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন আমেরিকান-আফ্রিকান যুবক জর্জ মা ক্লোইন। কালো কুচকুচে চেহারা। এই ইউনিভার্সিটিতে তিনিই ছিলেন প্রথম কোনো কৃষ্ণাঙ্গ। আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তখন সাদা-কালো একসাথে পড়ালেখা করার নিয়ম ছিল না। নিয়মটা হয়েছে পরে, ১৯৫৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। কিন্তু নিয়ম না থাকলেও জর্জ মা ক্লোইন প্রতিভার জোরে এখানে ভর্তি হয়েছেন, কেউ আটকাতে পারেনি। সাদা কালো একসাথে থাকার যেহেতু নিয়ম নেই, তাই পানি খাবার কল, খাবারের টেবিল, ক্লাসরুমে বসার তেপায়া—সবকিছুতেই জর্জকে আলাদা করে দেয়া হয়। ২০২০ সালে ওকলাহোমার ইউনিভার্সিটির কিছু দূরে ভয়ংকর বর্ণবৈষম্যের শিকার হয় আরেক যুবক। নিজ দেশের শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড। করোনা মহামারীর তীব্র সময়েই প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে আমেরিকার রাজপথ। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে পৃথিবীজুড়ে তৈরী হয় আরেকটি চিৎকার।

 

 

এই চিৎকার আমাদের তাড়িত করে নিয়ে যায় হাজার বছর আগে, মক্কাতুল মুকাররমায়। তখন বনি উমাইয়াদের শাসনকাল। ‘আখবারু মাক্কা’ গ্রন্থে ফাকিহানি (মৃ:২৭২) লিখেছেন, হজের সময় এক ঘোষক ঘোষণা দেয়—মক্কায় ফতোয়া দিতে পারবেন একমাত্র আতা ইবনে আবি রাবাহ (মৃ:১১৫)। তিনি ছাড়া আর কেউ ফতোয়া দিতে পারবেন না।’

 

মক্কায় ফতোয়া দেবার মতো মহান কাজের একচ্ছত্র অধিকার দেয়া হলো যাকে, তিনি মক্কার এক মহিলার কালো দাস। তাকে উপাধি দেয়া হলো—’হিজাযবাসীদের ফকিহদের সর্দার।’ কেউ নাক সিঁটকালো না, কালো বলে কেউ ঠাট্টা করলো না। খতিব বাগদাদি (মৃ:৪৬৩) তার ‘আল ফকিহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আতা ইবনে আবি রাবাহ একজন কৃষ্ণাঙ্গ ফকিহ। উমাইয়া খলিফা সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিক (মৃ:৯৫) তার দুই ছেলেকে নিয়ে এই ফকিহের কাছে এলেন। তাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন হজের বিভিন্ন মাসায়েল। এরপর খলিফা তার দুই ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, দাঁড়াও। ইলম অর্জন করতে কখনো অলসতা করো না। এই কালো দাসের সামনে আমাদের এই তুচ্ছতা আমি কখনোই ভুলি না।’

 

দুই অঞ্চলে দুই ঘটনার মাঝে কত তফাৎ। আমেরিকায় বর্ণবৈষম্যের কারণে যুবক জ্ঞান শিখতে পারছে না, বেঁচে থাকার সুযোগ পাচ্ছে না। অথচ ইসলামের জন্মভূমি মক্কায় বর্ণবৈষম্যহীন কী সুন্দর এক পৃথিবী। কালো এক দাস পাচ্ছেন শহরের সবচে বড় সম্মান; স্বয়ং খলিফা যাচ্ছেন তার কাছে মাসায়েল জানতে। গায়ের রংয়ের চেয়ে ভেতরের গুণকেই মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম। যে গুণে মানুষ মানুষ হয়ে উঠে। এই লেখায় ইসলামি ইতিহাসে কালোদের ভূমিকা নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করবো। এতে ফুটে উঠবে ইতিহাসে কালোদের ভূমিকা কারো থেকে কম নয়।

 

বিদেশী বাদশার কাছে ইসলামি তরজুমান

 

মুসলমানদের মধ্যে যারা অগ্রজ এবং প্রথম সারির, তাদের অধিকাংশই দরিদ্র এবং দাস। কারণ ইসলাম ধন-সম্পদ এবং সামাজিক অবস্থানের চেয়ে প্রাধান্য দেয় মানুষের গুণ এবং চরিত্র। এই গুণের বলেই অনেক দাস হয়ে উঠেছেন সর্দার, বিদেশী বাদশাহর দরবারে ইসলামের তরজুমান। তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছেন বিখ্যাত সাহাবি হজরত বেলাল ইবনে রাবাহ (মৃ:২০)। হজরত ওমর রাদি. বলতেন, ‘আবু বকর আমাদের সর্দার; তিনি আমাদের আরেক সর্দারকে মুক্ত করেছেন।’ অর্থাৎ আরেক সর্দার বলতে হজরত বেলাল রাদি.। ‘হিলইয়াতুল আউলিয়া’তে আবু নাঈম ইস্পাহানি (মৃ:৪৩০) বেলাল রাদি.কে বলেছেন—’বেলাল হলেন সর্দার, আবেদ, যাহেদ।’

 

কৃষ্ণদের জন্য বেলাল রাদি. তৈরী করেছেন অনন্য এক মর্যাদা। তার গায়ের রং কালো; কিন্তু রসূলের সোহবতে, সাহাবিদের সংস্পর্শে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ইসলামের মুআযযিন। ১৩ হিজরিতে ফিলিস্তিনের সিজারিয়া যখন অবরোধ করা হয়, রোমের বাদশা ইবনে হিরাকলের সঙ্গে সমঝোতা করতে পাঠানো হয় হজরত বেলাল রাদি.কে।

 

ওয়াকিদি (মৃ:২০৭) ‘ফুতুহুশ শাম’ গ্রন্থে লিখেন, ১৩ হিজরিতে ফিলিস্তিনের সিজারিয়া যখন অবরোধ করা হয়, রোমের বাদশা ইবনে হিরাকল একজন বড় পুরোহিতকে ডাকলো। সিজারিয়ার সবচে বড় পুরোহিত সে। হিরাকল তাকে বললো, মুসলিমদের সঙ্গে দেখা করতে যাও। তাদের সঙ্গে কথা বলো সবচে সুন্দর ভঙ্গিতে। তাদেরকে বলো, বাদশার পুত্র বলেছেন, তোমাদের সবচে বিশুদ্ধভাষী, সবচে সাহসী একজনকে যেন তার কাছে পাঠাও। তবে শর্ত হলো সে আরবের হতে পারবে না।

 

পুরোহিত এসে মুসলিম বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে হিরাকলের ঘোষণাটি শোনালো। হজরত বেলাল রাদি. এগিয়ে এসে মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনুল আস (মৃ:৪৩) রাদি.কে বললেন, রোমের সেনাপ্রধানের সাথে মুসলমানদের পক্ষ থেকে আমি কথা বলতে চাই। আমর ইবনুল আস রাদি. বললেন, তুমিই যাও। আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো। কথা বলতে ভয় পেয়ো না। সুস্পষ্ট জবাব দিবে, ইসলামের নিয়ম-কানুন সবার উর্ধ্বে রাখবে। বেলাল রাদি. বললেন, ইনশাআল্লাহ, আপনার কথামতোই আমি কাজ করবো।

 

মুসলিম সেনাবাহিনীর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে সামনে এলেন হজরত বেলাল রাদি.। পুরোহিত তাকে দেখে বললো, হে গোলাম, তোমার সর্দারকে পাঠাও। তাকে বলো বাদশা তোমাদের আমিরের সঙ্গে ইচ্ছেমতো কথা বলতে চান। বেলাল রাদি. বললেন, হে পুরোহিত, আমি বেলাল; রাসূল সা. এর মুআযযিন; তোমার নেতার জবাব দিতে আমি অক্ষম নই। পুরোহিত বললো, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। বাদশাহকে জিজ্ঞেস করে আসি। পুরোহিত বাদশার সঙ্গে দেখা করে এসে বললো, হে কৃষ্ণাঙ্গ, বাদশা বলেছেন, তিনি গোলামের সঙ্গে কথা বলবেন না। বরং তেমাদের সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলবেন। বেলাল রাদি. সেনাবাহিনীর বৃত্তে ফিরে গেলেন।

 

এখানে দেখার বিষয়—মুসলিমরা একজন কালো গোলামকে পাঠাচ্ছে বাদশার দরবারে ইসলামকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। অথচ বাদশা পাঠিয়েছে তাদের কাছে সবচে সম্মানিত পুরোহিতকে। কালো হলেও বেলালের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কারো দ্বিমত ছিলো না। তাই মুসলিমরা বিদেশী বাদশার সামনে ইসলামের তরজুমান করে তাকে পাঠাতে দ্বিধাবোধ করেনি।

 

সাহসিকতার ক্ষেত্রেও কালোরা এগিয়ে থেকেছে সবসময়। ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ গ্রন্থে যাহাবি রহ. বলেন, হজরত ওমর রাদি. এর আজাদকৃত গোলাম মাহজা’ ইবনে সালেহ (মৃ:২) ছিলেন বদর যুদ্ধের প্রথম শহীদ।’ বদর যুদ্ধে মুসলিম দলের একমাত্র অশ্বারোহী ছিলেন মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ রাদি. (মৃ:৩৩)। ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ গ্রন্থে যাহাবি রহ. লিখেন, মিকদাদ রাদি. ছিলেন গোলাম… কৃষ্ণবর্ণ…বদর যুদ্ধে তিনিই একমাত্র সাহাবি, যার সঙ্গে ঘোড়া ছিলো।’ যাহাবি আরও লিখেছেন, ‘হজরত আলী রাদি. বলেছেন, বদরে আমরা রাত কাটিয়েছি। আমাদের সঙ্গে অশ্বারোহী ছিল মাত্র একজন। তিনি হলেন হজরত মিকদাদ।’ মিকদাদ রাদি. সব গাযওয়াতে অংশগ্রহণ করেছেন। তাকে উপাধি দেয়া হয়েছে—’রাসূলের অশ্বারোহী’ বলে।

 

আরবেও কৃষ্ণাঙ্গ ছিল

 

সব কৃষ্ণাঙ্গ সাহবিগণই আফ্রিকান ছিলেন না। অনেকেই ছিলেন আরব মরুভূমির, যাদের গায়ের চামড়া ছিল কালো। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন উবাদা ইবনে সামেত খাযরাজি রাদি. (মৃ:৩৪)। তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। মিসরে তিনি ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। বেলাল রাদি.কে যেমন হিরাকলের সঙ্গে আলোচনার জন্য পাঠানো হয়েছিল, তেমনি উবাদা রাদি.কে পাঠানো হয়েছিল মুকাওকিসের সঙ্গে আলোচনা করতে।

 

ইমাম ইবনু আবদিল হাকাম রহ. (মৃ:২৫৭) ‘ফুতুহু মিসর ওয়াল মাগরিব’ গ্রন্থে লিখেছেন, মিসর বিজয়ী সেনাপতি হজরত আমর ইবনুল আস রাদি. শামে মুকাওকিসের সঙ্গে আলোচনা করতে উবাদা ইবনে সামেতের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠালেন। দরবারে যখন উবাদা রাদি. প্রবেশ করলেন, তার কুচকুচে কালো চেহারা দেখে ভড়কে গেলেন মুকাওকিস। তিনি বললেন, এই কৃষ্ণাঙ্গকে নিয়ে যাও। তার বদলে অন্য কাউকে আসতে বলো। প্রতিনিধি দল বললো, এই কৃষ্ণাঙ্গই আমাদের মধ্যে ইলমে এবং বুদ্ধিমত্তায় শ্রেষ্ঠ। তিনি আমাদের সর্দার, আমাদের নেতা। তার কথা আমরা বিনাপ্রশ্নে মেনে নেই। আমিরের যা বলার তাকেই বলে দিয়েছেন। আমাদেরকে বলে দিয়েছেন, আমরা যেন তার বিরোধিতা না করি।’ মুকাওকিস বললেন, ‘এই কৃষ্ণাঙ্গকে কিভাবে তোমাদের সর্দার মেনে নিলে? তেমাদের সর্দার অন্য কেউ হওয়া উচিত।’ প্রতিনিধি দল বললো, কখনোই নয়। দেখতে যদিও তিনি কালো, কথা-বার্তায়, জ্ঞানে-গুণে তিনিই আমাদের শ্রেষ্ঠ। আমাদের ধর্মে কালোকে ঘৃণা করা হয় না।’ মুকাওকিস তখন উবাদা রাদি.কে বললেন, হে কৃষ্ণাঙ্গ, এগিয়ে আসো। নরম ভাষায় কথা বলো।’

 

বর্ণবাদকে ইসলাম ‘না’ বলে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হজরত বেলাল এবং উবাদা রাদি. এর এই দুটো ঘটনা। মুসলমানদের হয়ে কথা বলতে রোমের বড় দুজন নেতার কাছে পাঠানো হয়েছে তাদের। রোমক নেতাগণ কালো বলে নাক সিঁটকালেও মুসলিমরা দৃঢ়কণ্ঠে বলেছে—আমাদের ধর্মে কৃষ্ণাঙ্গকে ঘৃণা করা হয় না।

 

ইসলামের শুরু থেকেই কৃষ্ণ বর্ণের সাহাবিগণ রাসূল সা. এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ তাদের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন রাসূল সা. এর আজাদকৃত গোলাম রাবাহ। হাফেজ ইবনু আবদিল বার (মৃ:৪৬৩) ‘আল ইসতিআব ফি মারিফাতিল আসহাব’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রাবাহ ছিলেন কালো। রাসূল সা. যখন একাকী থাকতেন, তার কাছে যাবার অনুমতি ছিল তার।’ এমন আরেকজন কৃষ্ণাঙ্গ সাহাবি জুলাইবিব রাদি.। তিনি যেদিন শহীদ হন, রাসূল সা. তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘জুলাইবিব সাতজন কাফেরকে হত্যা করেছে। পরে তারা তাকে হত্যা করেছে। সে আমার অংশ, আমি তার অংশ। সে আমার অংশ, আমি তার অংশ।’ এমন আরেকজন সাহাবি আবু হুযায়ফার গোলাম সালেম রাদি.। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পর তিনি মুহাজিরদের নামাজ পড়াতেন। কারণ, তিনিই ছিলেন তাদের মধ্যে সবচে বিশুদ্ধ তেলাওয়াতকারী।

 

এদের মধ্যে মহিলা সাহাবির কথা বললে সবার আগেই আসবে উম্মে আয়মান হাবশি রাদি. এর কথা। তিনি ছিলেন রাসূল সা. এর প্রতিপালনকারী এবং উসামা ইবনে যায়েদের মা। উসামা তার কাছ থেকে কালো বর্ণ পেয়েছিল। রাসূল সা. এর ওফাতের পর হজরত আবু বকর এবং ওমর রাদি.তাকে দেখতে যেতেন। তিনি কেঁদে কেঁদে বলতেন, আসমান থেকে ওহি আসা বন্ধ হয়ে যাবার কারণে আমি কাঁদছি।

 

ইলমের মসনদে, ইলমের গুণে

 

ইসলামি সভ্যতার গভীরে কৃষ্ণাঙ্গদের অবদান উজ্জ্বল হয়ে আছে। তারা তাদের জ্ঞানের গুণে আলোকিত করেছে পৃথিবী। যারা তাদের জ্ঞানে-চিন্তায় সমৃদ্ধ করেছে ইসলামি সংস্কৃতি, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইয়াজিদ ইবনে আবি হাবিব নুবি (মৃ:১২৮)। ‘তারিখুল ইসলামে’ যাহাবি রহ. লিখেছেন, ‘তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ হাবশি। মিসরের মুফতি। ধৈর্যশীল এবং বুদ্ধিমান।’ মিসরের ইলমি চরিত্র বদলে দিয়েছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, মিসরে যিনি ফিকহি মাসায়েল তথা হালাল-হারাম নিয়ে কথা বলেছেন। এর আগে সেখানে কেবল আমলের তারগিব, ফিতনার স্বরূপ ইত্যাদি নিয়ে কথা হতো।

 

মিসরের একদল ইমাম তার নিকট ইলম শিক্ষা করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আব্দুল্লাহ ইবনে লাহিয়া রহ. (মৃ:১৭৪)। মিসরের বড় ইমাম এবং প্রসিদ্ধ মুফতি লাইস ইবনে সাদ রহ. (মৃ:১৭৫)। ইয়াজিদ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইয়াজিদ আমাদের আলেম, আমাদের সর্দার।’

 

সত্য প্রকাশে ইয়াজিদ কখনো সংকোচ করতেন না। ইয়াজিদের ছাত্র ইবনে লাহিয়া বলেন, ইয়াজিদ ইবনে আবি হাবিব যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, মিসরের যুবরাজ হাথুর বিন সুহাইল তাকে দেখতে এলেন। তিনি বললেন, হে আবু রজা, কাপড়ে মাছির রক্ত নিয়ে নামাজ পড়ার হুকুম কি? ইয়াজিদ মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কথা বলতে চাইলেন না। যুবরাজ ইয়াজিদের মুখের দিকে ফিরে গেলেন। তখন ইয়াজিদ বললেন, প্রতিদিন কত মানুষকে আপনি হত্যা করছেন। অথচ আপনি এখন জিজ্ঞেস করতে আসছেন মাছির রক্তের কথা!

 

জাতির নেতৃত্বে

 

জাতির ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বেও ছিল কৃষ্ণাঙ্গরা। শুরুতেই আতা ইবনে আবি রাবাহের কথা উল্লেখ করেছি। তিনি ছিলেন মক্কার নেতৃস্থানীয় আলেমদের একজন। ‘মারিফাতুস সিকাত’ গ্রন্থে ইমাম আবুল হাসান আজালি (মৃ:২৬১) বলেন, ‘আতা ইবনে আবি রাবাহ মক্কাবাসীদের মুফতি ছিলেন।’ যাহাবি তাকে বলেছেন, ‘শাইখুল ইসলাম, হারামের মুফতি।’

 

আতা ইবনে রাবাহ কেবল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যই আদর্শ নন, বরং তিনি প্রতিবন্ধীদের জন্যও আদর্শ। কারণ তিনি ছিলেন প্যারালাইজড, এক চোখ অন্ধ। পরবর্তীতে দুচোখই অন্ধ হয়ে যায়। তার সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনে কুনফুজ কুসানতিনি ‘আল ওফায়াত’ গ্রন্থে লিখেছেন, চেহারার সৌন্দর্য এবং সম্পদের প্রাচুর্য দিয়ে কেউ ইলম অর্জন করতে পারে না। ইলম হলো নূর; আল্লাহ তায়ালা এই নূর যার বুকে ইচ্ছে, তার বুকে রাখেন।’

 

তাবেয়িদের ইমাম সাঈদ ইবনে জুবায়ের (মৃ:৯৪) বিরাট ইলমের অধিকারী ছিলেন। ‘তাজকিরাতুল হুফফাজে’ যাহাবি লিখেছেন, ‘বিদ্বান আলেম বলা হয় সাঈদ ইবনে জুবায়েরকে। তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। ইবনে আব্বাস রাদি. যখন হজে গেলেন, কুফাবাসী তাকে বিভিন্ন কিছু জিজ্ঞেস করছিলো। তখন তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে সাঈদ ইবনে জুবায়ের নাই?’

 

ইলমের এতবড় মসনদ দখল করার পরও কুফার বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ইরাকে উমাইয়া খলিফা হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের (মৃ:৯৫) বিরুদ্ধে যখন ফকিহগণ বিদ্রোহ করলেন, সেই বিদ্রোহে সাঈদ ইবনে জুবায়ের যোগ দিয়েছিলেন। বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়, তিনি গ্রেফতার হন। পরে হাজ্জাজ তাকে হত্যা করেন।

 

কৃষ্ণাঙ্গ আলেমদের মাঝে কেরাতের ইমামও ছিলেন। তিনি হলেন মদীনার কারী আবু রুয়াইম নাফে ইবনে আবদির রহমান মাদানি (মৃ:১৭০)। ইবনু জাযারি (মৃঃ৮৩৩) ‘গায়াতুন নিহায়াহ ফি তাবাকাতিল কুররা’ গ্রন্থে লিখেন, ‘তিনি ছিলেন সাত কারীর একজন। গাত্রবর্ণ কালো, কথা বলেন হাসি রসাত্মক। মদীনার একদল তাবেয়ি থেকে কেরাত গ্রহণ করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি সত্তরজন কারীর নিকট কেরাত পড়েছি।’

 

কাব্যে ও কবিতায়

 

কৃষ্ণাঙ্গরা কেবল কুরআন-হাদীস-ফিকহের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তারা কাব্য এবং কবিতায়ও অবদান রেখেছে। ভাষা ও সাহিত্যের ইমাম আসমাঈ (মৃ:২১৬) ‘ফুহুলাতুশ শুআরা’ গ্রন্থে অনেক কৃষ্ণাঙ্গ কবি ও সাহিত্যিকের আলোচনা করেছেন। কবিদের মধ্যে কতজন হলেন—নুসাইব ইবনে রাবাহ আবু মিহজিন নুবি (মৃ:১০৮), রম্য কবি আবু দাল্লামা (মৃ:১৬১), আবু আতা সানাদি (মৃ:১৮০ এর পর)। সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম হলেন আবু উসমান জাহিয (মৃ:২৫৫)। ‘মুজামুল উদাবা’ গ্রন্থে ইয়াকুত হামাভি (মৃ:৬২৬) লিখেছেন, জাহিযের দাদাও কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন।

 

কৃষ্ণাঙ্গ কবিদের মধ্যে খুব বেশি প্রসিদ্ধ সুহাইম, যিনি ‘আবদু বনি হাছহাছ’ বলে পরিচিত। ‘খাযানাতুল আদব’ গ্রন্থে আবদুল কাদের বাগদাদি (মৃ:১০৯৩) লিখেন, সুহাইম ছিলেন মুখাজরামিনদের একজন; ‘তিনি জাহেলি এবং ইসলাম দুটো সময়ই পেয়েছেন। তবে তিনি সাহাবি কিনা, তা জানা যায়নি। তিনি ছিলেন কুচকুচে কালো।’ সুহাইমের দু’একটা পঙক্তি—দেহ তোমার দাস, মন কিন্তু স্বাধীন/গায়ের বর্ণ কালো, কিন্তু চরিত্র শ্বেত পাথরের মতো সমুজ্জ্বল।

 

প্রসিদ্ধ এই কবিদের একজন আব্বাসী কবি আবু ফানান আহমদ ইবনে সালেহ (মৃ:২৭০)। আবু উবায়েদ আন্দলুসি (মৃ:৪৮৭) ‘সামতুল লাআলি’তে লিখেন, ‘আবু ফানান ছিলেন কালো; তিনি বাগদাদের ভালো কবিদের একজন ছিলেন। তিনি মুতাওয়াক্কিলের শাসনকালে কবিতায় প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন।’ তার পঙক্তি—কান্না থামাতে অস্বীকার করেছে আমার চোখ/অশ্রুর প্লাবন থামাতে নারাজ/অশ্রুকে অস্বীকার করো না/ মুক্তোর মতো জ্বলছে অল্প কিছু অশ্রু।

 

প্রসিদ্ধ আরেকজন কবি নুসাইব ইবনে রাবাহ আবু মিহজিন। ইমাম মোবাররাদ ‘আল কামিল’ গ্রন্থে বলেছেন, নুসাইবা কবিতায় আবদুল্লাহ ইবনে জাফর (মৃ: ৮০) এর প্রশংসা করেছেন। খুশি হয়ে জাফর তাকে ঘোড়া ও দিনার ও দিরহাম পুরস্কার দিলেন। লোকজন তাকে বললো, কৃষ্ণাঙ্গ কবি কে আপনি এতগুলো উপঢৌকন দিলেন! আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর বললেন, যদিও সে কালো কিন্তু তার কবিতা উজ্জ্বল ; আরবদের প্রশংসা করছে সে; শুধু এতোটুকুই নয় বরং সে এর চেয়ে বেশি উপহারের যোগ্য।’

 

আরেকজন কবি ছিলেন ছোট নুসাইব (মৃ:১৭৫)। তিনি আবুল হাজনা বলে পরিচিত। কবিতায় তিনি আব্বাসি খেলাফতের নিকট একটা রাজনৈতিক অবস্থান তৈরী করে নিয়েছিলেন। ‘তাবাকাতুশ শুআরা’তে ইবনু মু’তাজ (মৃ:২৯৬) লিখেছেন, বাদশা হারুনুর রশীদ তাকে শামের কিছু এলাকার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ।’ তেমনি আরেকজন কবি ফজল ইবনে ইয়াহইয়া (মৃ:১৯২)। হেলালি বলেন, একদিন আমি ইমাম আসমাঈকে বললাম, এই কৃষ্ণাঙ্গের কবিতা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?’ তিনি বললেন, ‘আবদে হাছহাছ তার কালে যতটা প্রসিদ্ধ ছিলেন, এই কালে তারচে বেশি প্রসিদ্ধ ফজল ইবনে ইয়াহইয়া। হেলালি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় বড় নুসাইবের কবিতা, কোথায় ফজলের কবিতা! আসমাঈ বললেন, তারা দুজন একই শতাব্দীর, তাদের প্যাটার্নও এক। তবে নুসাইব ছিলেন একটু আগের, ফজল সমকালীন।’

 

আরেকজন কবি আলি ইবনে জাবালাহ, তিনি আকাউওয়াক বলে পরিচিত (মৃ:২১৩)। ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’তে যাহাবি লিখেছেন, ‘জাহিয বলেন, আকাউওয়াক জন্মগ্রহণ করেছিলেন অন্ধ। তার ওপর তিনি কালো এবং কুষ্ঠরোগী। কিন্তু তার কবিতা অনন্য।’ আরেক কবি কাফুর নববি (মৃ:৫০৩)। ঐতিহাসিক সাফাদি তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ কবি এবং দারুণ কবি।’

 

রাজনৈতিক তৎপরতায়

 

জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের বাইরে রাজনীতির ময়দানেও কীর্তি আছে কৃষ্ণাঙ্গদের। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সবচে প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলেন মিসরের আমির কাফুর ইখশিদি (মৃ: ৩৫৬)। ক্ষমতার কেন্দ্রে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সাহিত্যেরও কদর করতেন। ঐতিহাসিক সাফাদি লিখেছেন, ‘কাফুর ইখশিদি মিসরের প্রসিদ্ধ সুলতান…তিনি কৃষ্ণাঙ্গ…তিনি মেধাবি; আরবি, সাহিত্য এবং ইলমের প্রতি তিনি মনোযোগী ছিলেন।’

 

সাফাদি আরেকজন কৃষ্ণাঙ্গ নেতার কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে ছিলেন। তিনি হলেন কাফুর শিবেল দাওলা (মৃ:৬২৩)। তিনি কায়রোতে আইয়ুবি প্রাসাদের খাদেম ছিলেন। তিনি ছিলেন হানাফি; একসময় তিনি মাদরাসা এবং খানকা কায়েম করেছেন।

 

তারিখুল ইসলামে যাহাবি একজন কৃষ্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি আমির বদরুদ্দিন হাবশি আদিলি (মৃ:৬৯৮)। তিনি ছিলেন সাহসী, যুদ্ধক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারঙ্গম। আমানত এবং দিয়ানতদারিতেও তিনি ছিলেন অনন্য। দীর্ঘ ৪০ বছরেরও অধিক কাল তিনি আমির ছিলেন। তিনি অনেকবার হজ করেছেন।’ এরপর যাহাবি এমন একটি বাক্য বলেছেন, যা ইঙ্গিত করে, এই কৃষ্ণাঙ্গ আমির যাহাবির শায়েখদের মধ্যে একজন ছিলেন। যাহাবি বলেছেন, আমি তার নিকট একটা ‘জুয’ পড়েছি; এই জুয তিনি শুনেছিলেন ইবনু আবদিদ দায়েম থেকে।

 

রাজনৈতিক খেলায় কৃষ্ণাঙ্গরা বিদ্রোহও পরিচালিত করেছে। তারমধ্যে একটি হলো ১৪৫ হিজরির বিদ্রোহ। বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল মদীনায়। ‘আল বিদায়া অন নিহায়া’ গ্রন্থে ইবনে কাসির লিখেছেন, ‘আব্বাসি সেনাদের হাতে যখন বিদ্রোহী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান নিহত হয়, তখন কৃষ্ণাঙ্গরা বিদ্রোহে নামে। খলিফা মানসুর (মৃ:১৫৮) আব্দুল্লাহ ইবনে রাবি হারিসিকে মদীনায় গভর্নর করে পাঠান। তার সৈন্যরা মদীনায় বিশৃঙ্খলা উসকে দেয়। ফলে একদল কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্রোহী হয়ে উঠে। সৈন্যরা যখন জুমার নামাজ পড়তে যাচ্ছিল, তখন কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের ওপর হামলা চালায়। কৃষ্ণাঙ্গ নেতাদের মধ্যে ছিল—ওয়াসিক, ইয়াকিল, উনকুদ, আবু কায়েস এবং আবু নার প্রমূখ। আব্দুল্লাহ ইবনে রাবি সৈন্যদের নিয়ে লড়াইয়ে নামেন এবং কৃষ্ণাঙ্গদের পরাজিত করেন।

 

এর এক শতাব্দী পর দক্ষিণ ইরাকে কৃষ্ণাঙ্গদের আরেকটি বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। বিদ্রোহটি ২৫৫ হিজরি থেকে ২৭০ হিজরি পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই বিদ্রোহকে বলা হয় ‘যানজ বিদ্রোহ’। এর দুই শতাব্দী পর ফাতেমি সাম্রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের আরেকটি বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। যখন বিখ্যাত সেনানায়ক সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (মৃ:৫৮৯) মিসরে আসেন। আইয়ুবি বিদ্রোহ দমন করেন।

 

কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে লেখালেখি

 

ইসলামি সভ্যতায় কৃষ্ণঙ্গদের অবদান কেবল ধারণাগত ছিল না, বরং বাস্তবেই দৃশ্যমান ছিল। ইতিহাসের পাতায় কৃষ্ণাঙ্গদের সেসব অবদান লিপিবদ্ধ আছে। তবে বিশিষ্ট দার্শনিকদের লেখা প্রাচীন ইউরোপীয় লেখাগুলো বর্ণবাদী মানদণ্ডে মানুষকে বিভক্ত করতে চেয়েছিল। জার্মান দার্শনিক এমানুয়েল ক্যান্ট (মৃ:১৮০৪ খৃ.) প্রতিভা সারণিতে প্রথমেই রেখেছেন শ্বেতাঙ্গদের। তারপর ইন্ডিয়ান। তৃতীয় সারণিতে রেখেছেন কৃষ্ণাঙ্গদের। এমনিভাবে দার্শনিক হেগেলের (মৃ:১৮৩০ খৃ.) বর্ণবাদী অবস্থানও ছিল ক্যান্টের মতো। কিন্তু ইসলামি লেখকদের লেখায় বর্ণবাদী মানদণ্ডে মানুষকে বিভিক্ত করা হয়নি। বরং তাদের লেখায় ফুটে উঠেছে সাম্য। তারা শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গদের অবদান তুলে ধরেছেন ইনসাফের সাথে। কৃষ্ণাঙ্গদের ফেলে দেননি। সমাজ ও সভ্যতায় কৃষ্ণাঙ্গদের অবদান তুলে ধরেছেন।

 

‘কাশফুয যুনুনে’ আরব সংস্কৃতিতে কৃষ্ণাঙ্গদের উপস্থিতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহের নাম উল্লেখ করেছেন হাজি খলিফা (মৃ:১০৬৮)। তিনি লেখকদের মৃত্যুর ধারাবাহিকতা অনুযায়ী গ্রন্থগুলোর বিন্যাস করেছেন। গ্রন্থগুলো হলো—জাহিয (মৃ:২৫৫) রচিত ‘ফাখরুস সুদান আলাল বীদান’; আবুল আব্বাস নাশিঈ (মৃ:২৯৩) রচিত ‘ফি তাফজিলিস সূদ আলাল বিয়াজ’; ইবনুল মারজুবান (মৃ:৩০৯( রচিত ‘আস সুদান ওয়া ফাজলুহুম আলাল বীদান’; ইবনুস সাররাজ কারি (মৃ:৫০০) রচিত ‘যুহদুস সুদান’; সুয়ুতি রচিত ‘নুজহাতু উমর ফিত তাফজিলি বাইনাল বিয়াজ ওয়াস সূদ’।

 

শেষকথা

 

ইবনুল জাওযি লিখেছেন, কৃষ্ণাঙ্গদের স্বভাবে কিছু গুণ থাকে বিশেষ। যেমন—শারীরিক শক্তি, অন্তরের দৃঢ়তা; এ দুটো সাহসের জন্ম দেয়। কৃষ্ণাঙ্গদের দেশ হাবশার কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে আতিথিয়েতা, সুন্দর চরিত্র, দুঃখ ঘুচিয়ে দেয়া, মিষ্টি ভাষী এবং হাসী।’

 

কালো যে আলো, প্রকৃতির কিছু জিনিস তার প্রমাণ। ইবনুল জাওযি লিখেছেন, কিছু গুণ এবং সৌন্দর্য কালোতেই নিহিত। এরমধ্যে রয়েছে ‘চোখের মণি’ এবং ‘কলিজার কালো রং’। এ দুটো জিনসই মানুষের গুরুত্বপূর্ণ দুটি অঙ্গ। তারপর বলা যায় মানুষের সৌন্দর্যের মুকুট ‘মাথায় কালো চুল’। সবচে মহান যে পাথর, হাদীসে তাকে বলা হয়েছে ‘হাজরে আসওয়াদ’।

 

কৃষ্ণাঙ্গদের দেশ হাবশার কিছু ভাষা কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন—মেশকাত, ত্বাহা, আওয়াহুন। হাবশার ভাষায় ত্বাহা অর্থ—হে লোক। আওয়াহুন অর্থ মুমিন। আল্লামা সুয়ুতি রহ. ‘আল ইতকান ফি উলুমিল কুরআনে’ লিখেছেন, ‘সব আসমানি কিতাব যার যার কওমের ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। এক কওমের জন্য অন্য কওমের ভাষায় আসমানি কিতাব অবতীর্ণ করা হয়নি। এইখানে কুরআনের বিশেষত্ব হলো—কুরআনে আরবের সবকটি ভাষার শব্দই ব্যবহৃত হয়েছে। এরমধ্যে রোম, পারস্য, হাবশার কথা বলা যায়।’

 

এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয়তো কুরআনের বাণী এবং ইসলামের ব্যাপকতাকে ভাষা কিংবা বর্ণের বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়া। মুসলিম উম্মাহর মাঝে মাঝে কেবল ভাষাগত বন্ধনই নেই, বরং সবধরণের বন্ধনই আছে। সবাই সমান, বর্ণের ভিত্তিতে কেউ কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। ইবনুল জাওযি রাসূল সা. এর এই উক্তি তুলে ধরেছেন—’বাদশা কুরাইশদের মধ্য হতে; বিচারক আনসারদের মধ্য হতে; মুআযযিন হাবশার মধ্য হতে; এবং আমানতদারিতা আজদের মধ্য হতে।’

 

ইসলাম যে সাম্য উপহার দিয়েছে, তার মতো আর কেউ দিতে পারেনি। কৃষ্ণাঙ্গদের যে উচ্চতায় জায়গা দিয়েছে ইসলাম, তাও অন্য কেউ দিতে পারেনি।

 

The post মুসলিম সভ্যতা নির্মাণ: কালোদের ভূমিকার অনুসন্ধান appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/5dFDHeT

Monday, August 8, 2022

হুসাইনিয়া চিশতিয়া : যে সুন্নিরা কারবালা পালন করেন

রাকিবুল হাসান নাঈম:

কাশেদ ইমামবাড়া, সূত্রাপুর, ডালপট্টি। ইমামবাড়ার জন্য এখানে নির্ধারিত কেনো বিল্ডিং নেই। রাস্তার পাশেই এই ইমামবাড়াটি অস্থায়ীভাবে বানানো হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবকদের গায়ে কালো পাঞ্জাবি। মহা উৎসাহে তারা বাঁশ কুপছে, ব্যানার টানাচ্ছে। মহররমের দশ তারিখ কারবালার স্মরণে এখান থেকেই বের হবে তাজিয়া মিছিল। পথের মোড়ে মোড়েও টানানো হয়েছে ডোরাকাটা নিশান। আপাতদৃষ্টিতে তাদেরকে শিয়া মনে হলেও তারা মূলত শিয়া নন। তাদের দাবি অনুযায়ী তারা সুন্নী। ইমাম হোসাইনের স্মরণে তারা তাজিয়া মিছিল বের করেন। কারবালার স্মরণে মিলাদ-মাহফিল আয়োজন করেন।

সুন্নীদের কারবালা পালন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারবালার স্মরণে তাজিয়া মিছিল শিয়াদের অনুষঙ্গ হলেও অনেক সুন্নী মুসলিম কারবালা পালন করে থাকেন। মিলাদ-মাহফিল ও জারিগানের মাধ্যমে দিনটিকে তারা উদযাপন করেন। কাশেদ ইমামবাড়ার একজন স্বেচ্ছাসেবক আরিফ রহমান। তারা শিয়া কিনা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘তাওবা, তাওবা। কী বলেন। আমরা সুন্নী। ইমাম হুসাইনের স্মরণে বছরে একটা দিন তাজিয়া মিছিল করি। ইমামবাড়া বানাইতাসি, এখান থেইক্কা মিছিল বের হইব।’

সাধারণত প্রোগ্রাম কেমন হয় জানতে চাইলে আরিফ রহমান বলেন, ‘সকালে তাজিয়া মিছিল। তারপর মিলাদ-মাহফিল৷ সবশেষে তবারক।’

আখাউড়ায় রাজেন্দ্রপুর চিশতিয়া হুসাইনিয়া দরবার শরীফের তত্ত্বাবধানে প্রতিবছরই কারবালা পালন করা হয়। তারাও মূলত সুন্নী। এ দরবার শরীফের তত্ত্বাবধানে ১০৮ বছর ধরে কারবালা পালন করা হয়। এ দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা নাসিরুদ্দিন চিশতি। বর্তমান গদ্দিনশিন পীর জাহের উদ্দিন চিশতি। করোনার কারণে গত দুই বছর বিশাল আয়োজনে কারবালা পালন করতে না পারলেও এবার পালন বড় করেই পালন করবেন তারা।

হুসাইনিয়া দরবার শরীফের ভক্তের মাধ্যমে গদ্দিনশিন পীরের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কথা বলতে না পারায় ভক্ত বলেন, ‘আমি আপনারে বইল্যা দেই। এতদিন ত করোনার কারণে হুজুর নিষেধ করতেন কেউ যেন না আসে। এবার সবাইরে নিয়াই কারবালা পালন করবেন। আগেরবারের মতো এবারও প্রতীকী ঘোড়া তৈরী করা হয়েছে। সবকিছু প্রস্তুত।’

তাজিয়া মিছিলের বিভিন্ন প্রতীক

তাজিয়া মিছিলে কারবালার দৃশ্যায়ন করতে বিভিন্ন প্রতীক ব্যবহার করা হয়। মিছিলে লম্বা বাঁশের মাথায় নানা রকম পতাকা বহন করা হয়। এগুলোকে বলা হয় আলম। এছাড়াও মিছিলের অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন নিশান নিয়ে আসেন। যে যার মতো এই নিশান বহন করেন। তাজিয়া মিছিলের অগ্রভাগে থাকে আলম বহনকারী বাহিনী। তার পেছনে থাকে বাদ্যকর; তৎপশ্চাতে কয়েকজন লোক লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে ও তরবারি চালাতে চালাতে অগ্রসর হয়। এ সময় দুটি শিবিকাসহ অশ্বারোহী সৈন্যের সাজে কয়েকজন লোক শোক প্রকাশ করতে করতে অগ্রসর হয় এবং তার পেছনে একদল গায়ক শোকগান গাইতে থাকে।

মিছিলে সবার পরে থাকে হুসাইন রাজি.-এর সমাধির প্রতিকৃতি। সমাধিটি কাঠ, কাগজ, সোনা, রূপা, মারবেল পাথর ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয়। ঢাকার হুসেনী দালানের তাজিয়াটি কাঠ ও রূপার আবরণ দিয়ে তৈরি, যা নবাব সলিমুল্লাহ দান করেন। তাজিয়া মিছিলে মাতম করা, বুক চাপড়ানো ও জিঞ্জির দিয়ে পিঠের ওপর আঘাত করে রক্তাক্ত করা হয়। তাজিয়া মিছিলে ‘হায় হোসেন’ মাতম তুলে ছোরা, কাঁচি, বর্শা, বল্লম, তরবারি নিয়ে নিজেদের শরীর রক্তাক্ত করা লোকদেরকে বলা হয় ‘পাইক’। এভাবে মিছিলটি নিয়ে লোকজন সম্মুখে অগ্রসর হয় এবং একটি পূর্ব নির্ধারিত স্থানে গিয়ে তা শেষ হয়। কোথাও কোথাও মিছিলে দু’টি কিংবা প্রতীকী ঘোড়াও ব্যবহার করা হয়। আখাউড়ায় রাজেন্দ্রপুর চিশতিয়া হুসাইনিয়া দরবার শরীফে প্রতি বছর কারবালার অনুষ্ঠানে প্রতীকী ঘোড়া বানানো হয়। ঘোড়াটাকে সাজানো বিভিন্ন রঙ্গের ঝাড়বাতি দিয়ে। অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করতে থাকে।

সোমবার সকালে সূত্রাপুর ডালপট্টিতে গিয়ে দেখা যায়, তাজিয়া মিছিল শুরু এবং শেষ করার জন্য একটি ইমামবড়া বানানো হয়েছে। তার আশপাশের গলিগুলোতে উড়ছে নির্দিষ্ট প্রকারের পতাকা।

May be an image of 1 person and outdoors

কারবালার অন্যতম অনুষঙ্গ ‘জারি’

নবীনগর থানার বাজেবিশাড়া গ্রামের পাক পাঞ্জাতন দরবার শরীফেও পালন করা হয় কারবালা। তারা বড় কোনো আয়োজনে জড়ান না। তবে খিচুরি রান্না করে বিতরণ করেন। রাতে আয়োজন করেন মিলাদ-মাহফিলের। আগে জারির প্রচলন থাকলেও এখন অনেকটাই কমে গেছে। একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। তবে জারি অনুষ্ঠানটি যতটুকু টিকে আছে, তাও গ্রামেগঞ্জে, শহরে নয়।

কারবালার হৃদয়বিদারক বিয়োগান্তক ঘটনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করার জন্য হজরত ইমাম হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের স্মরণে জারি গান পরিবেশন করা হয়ে থাকে। যেমন একটি জারি গান হলো: ‘মহররমের ঐ দশ তারিখে কী ঘটাইলেন রাব্বানা/ মায়ে কান্দে জি-এ কান্দে কান্দে বিবি সকিনা/ একই ঘরে তিন জন গো রাড়ি (বিধবা) খালি সোনার মদিনা।’

জারি শব্দের উৎপত্তি আহাজারি থেকে। জারি মূলত শোক সংগীত। কয়েকজন মিলে যৌথভাবে এ শোক সংগীত পরিবেশন করা হয়। মুসলিম সমাজে জারির উৎপত্তি কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মরণ করার উদ্দেশ্যে। যতদূর জানা যায় ইরাক এবং আশপাশের দেশে শিয়া সম্প্রদায় কারবালার জারির প্রচলন ঘটায়। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন আছেন। কিন্তু ব্যাপক আকারে এ অঞ্চলে কারবালার জারি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানমালা পালন করেন মূলত সুন্নি সম্প্রদায়। তবে শিয়া সম্প্রদায়ের যে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করেন তারা তাদের নিয়মে মহররমের অনুষ্ঠানাদি পালন করে থাকেন। বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়ের মূল কেন্দ্র হচ্ছে পুরান ঢাকার হোসনি দালান। তারাই বাংলাদেশে মহররম কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান পালনের সূচনা করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যেও মহররমের এ আনুষ্ঠানিক পালন করা হয়।

কোথাও কোথাও জারির জন্য আলাদা কোনো অনুষ্ঠান করা হয় না। বরং কারবালা কেন্দ্রীক মিলাদ-মাহফিলেই জারি গাওয়া হয়। কথা হয় পাক পাঞ্জাতন দরবার শরীফের গদ্দিনশীন পীর ড. শহীদুল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আহলে বাইতকে মহব্বত করতে আল্লাহ তায়ালাই বলেছেন। ইমাম হুসাইন ছিলেন রাসুলের প্রিয়তম নাতি, মা ফাতেমার নয়নের টুকরা। তার শাহাদাতের ঘটনার স্মরণে আমরা দিনটি পালন করি। বাতিলের সামনে নত না হওয়ার যে শিক্ষা তিনি দিয়ে গেছেন, তার থেকে আমরা প্রেরণা লাভ করি। মিলাদ-মাহফিল করি, পাক-পাঞ্জাতন নিয়া সানা-সিফত গাই। তাজিয়া মিছিল করি, কিন্তু তাজিয়া বানাইনা। প্রতীকী ঘোড়াও বানাই না। আমরা আলোচনা করি হুসাইনের চেতনা নিয়ে, কারবালার শিক্ষা নিয়ে।’

The post হুসাইনিয়া চিশতিয়া : যে সুন্নিরা কারবালা পালন করেন appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/s83GSJf

Sunday, August 7, 2022

বাংলাদেশকে ২৮৫৪ কোটি টাকা ঋণ দিলো বিশ্বব্যাংক

ফাতেহ ডেস্ক:

করোনা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ৩০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রতি ডলার সমান ৯৫ দশমিক ১৬ টাকা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

রোববার (৮ আগস্ট) বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে। এতে বাংলাদেশের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান ও বিশ্বব্যাংকের পক্ষে সংস্থাটির বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন সই করেন।

লোকাল গভর্নমেন্ট কোভিড-১৯ রেসপন্স অ্যান্ড রিকভারি প্রকল্পের আওতায় ৩০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন মেয়াদকাল জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত।

বিশ্বব্যাংকের স্পেশাল ড্রয়িং রাইটসের (এসডিআর) মুদ্রায় এ ঋণ নেওয়া হবে এবং পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। তবে উত্তোলিত ঋণের ওপর বার্ষিক শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ এবং এক দশমিক ২৫ শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করতে হবে।

অনুত্তোলিত অর্থের ওপর বার্ষিক সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ হারে কমিটমেন্ট ফি দেওয়ার বিধান থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বব্যাংক কমিটমেন্ট ফি দেওয়ার বিষয়টি মওকুফ করে আসছে।

প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হলো- কোভিড-১৯ অতিমারি থেকে উত্তরণে নগর কেন্দ্রিক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা বাড়ানো, স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিধি সম্প্রসারণ এবং অত্যাবশ্যকীয় নাগরিক সুবিধাসমূহ নিশ্চিত করা। এর মধ্যে রয়েছে- পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্যানিটেশন, ড্রেনেজ ইত্যাদি। এছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে ভ্যাকসিন বিতরণ কার্যক্রম জনগণের কাছে পৌঁছানো এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর নিজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে আইটিভিত্তিক রাজস্ব ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করা হবে।

The post বাংলাদেশকে ২৮৫৪ কোটি টাকা ঋণ দিলো বিশ্বব্যাংক appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/BbXCts8

Wednesday, August 3, 2022

দেশে কাদিয়ানিদের সংখ্যা কত?

মুনশী নাঈম:

দেশে দিনদিন কাদিয়ানিদের সংখ্যা বাড়লেও তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কাদিয়ানি ধর্ম প্রচারের কাজে তাদের প্রচারকরা বেশ কৌশল ও গোপনীয়তা বজায় রাখেন। অনুসারীরাও নিজেদেরকে প্রকাশ করেন না। তারা নিজেদেরকে কাদিয়ানি বলে পরিচয় দেন না। পরিচয় দেন আহমাদিয়া মুসলিম জামাতের লোক বলে। প্রচারক ও অনুসারীদের এই গোপনীয়তা রক্ষার ফলে দেশে তাদের নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও তৈরী হয়নি। তবে বাংলাদেশে ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুন্দরবন, আহমদনগর-শালসিঁড়ি, রাজশাহী, কুমিল্লা এবং জামালপুর-ময়মনসিংহ অঞ্চলে কাদিয়ানিদের সংখ্যা উল্ল্যেখযোগ্য ।

আহমাদিয়া মুসলিম জামাতের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, এই দলটি বর্তমানে সমস্ত দেশব্যাপী ১০৩টি শাখায় বিস্তার লাভ করেছে এবং বর্তমানে দেশব্যাপী প্রায় ৪২৫টি এরূপ স্থান রয়েছে যেখানে আহ্‌মদীদের ছোট-ছোট সমাজ রয়েছে। এখানকার দলের ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণরূপে স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা পরিচালিত। এই দলের সমস্ত কর্মকর্তারা নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বর্তমানে দেশে তাদের ৬৫জন প্রচারক রয়েছে। তাদের কার্যক্রম কেন্দ্র, রিজিওন ও স্থানীয় পর্যায়ে এই তিনটি স্তরে পরিচালিত হয়।

২০১৩ সালে বাংলাদেশে কাদিয়ানিদের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত ক্রোড়পত্রে বলা হয়, দেশব্যাপী প্রায় ৫৫০টি এরূপ স্থান রয়েছে, যেখানে আহ্‌মদীদের ছোট-ছোট সমাজ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ আহমদি মুসলিম জামাতের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী নাজির আহমদের সঙ্গে। এদেশে তাদের সদস্যসংখ্যা কত জানতে চাইলে প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘সদস্য কত সেটা বলা মুশকিল। প্রতিদিন সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। শাখা বাড়ছে। এর সঠিক পরিসংখ্যান করা হয়নি।’ তবে কোন জেলায় তাদের সদস্য সংখ্যা বেশি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকা জেলায় সদস্য সংখ্যা সবচে বেশি।’

গণমাধ্যমে বলা হয়, কাদিয়ানিদের বার্ষিক সভাগুলোতে ১০ হাজার মানুষের সমাগম হয়। কিন্তু এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী নাজির আহমদ বলেন, ‘এটা করোনার হিসাব। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি বিধি-নিষেধ থাকে। ফলে মানুষ কম হয়। কিন্তু যদি সরকারি বিধি-নিষেধ না থাকে, তাহলে ২০ হাজারের বেশি মানুষের সমাগম হয়।’

এদেশে কাদিয়ানিদের সংখ্যা লাখের কাছাকাছি হতে পারে বলে অনুমান প্রকাশ করেছেন দাওয়াতি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল খতমে নবুওয়ত মুভমেন্টের আমির মুফতি শোয়াইব ইবরাহিম। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘দাওয়াতি কাজে যতটুকু ঘুরেছি, তাতে অনুমান করতে পারি, তাদের সংখ্যা লাখের কাছাকাছি হবে। তারা সবকিছুতে গোপনীয়তা বজায় রাখে। ফলে কাটায় কাটায় হিসাবটা বলা যাবে না।’

কাদিয়ানিদের প্রচারণায় প্রতারণার কথা উল্লেখ করে মুফতি শোয়াইব ইবরাহিম বলেন, সাধারণ মুসলমানদের খুব কৌশলে তারা প্ররোচিত করে। বলে, আপনারা মুসলমান, আমরাও মুসলমান, কোনো তফাত নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে আপনারা যেমন নবি ও রাসুল মানেন, বিশ্বাস করেন—আমরাও তাই। তাঁর সঙ্গে আপনি কেবল আমাদের নবি গোলাম আহমদ কাদিয়ানিকেও নবি মেনে নিন, ব্যস, আপনি আমাদের ভাই হয়ে যাবেন। এভাবেই নম্র ও আপোসকামী মোলায়েম ভাষায় সাধারণ মুসলমানদের মগজ ধোলাই করে। পাশাপাশি ভালো মাইনের চাকরি এবং আর্থিক লোভও দেখায়। ফলে মানুষ সহজেই তাদের শিকারে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত যারা আছেন, তাদেরকে মোটিভেশনের কায়দা ভিন্ন। নবিজিকে শেষনবি যে তারা মানে না, এ ব্যাপারটি খোলামেলাভাবে উচ্চশিক্ষিতদের বলে না। বরং অন্য উপায়ে এ শ্রেণিকে মোটিভেশন করে। ফলে চাকরি ও পদোন্নতির লোভে অনেকেই এসব বিষয়ে ঘাটাঘাটি না করে সহজেই কাদিয়ানিদের কাতারে নিজের নাম লিখিয়ে নেয়।

দাওয়াতের মাধ্যমে কতজন কাদিয়ানি ইসলামে ফিরে এসেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দাওয়াতে গত ৫ বছরে প্রায় ৬০০ মানুষ ফিরে এসেছে। এছাড়া আরও কয়েকটি দল দাওয়াতের কাজ করছে। তাদের কাছে তাদের হিসাব পাওয়া যাবে। বিশেষ করে যাদেরকে প্রতারণা করে, ভুজং-ভাজং বুঝিয়ে কাদিয়ানি ধর্মে নিয়েছে, তারা দাওয়াত পেলে বুঝতে পেরে ফিরে আসে । ‍কিন্তু যারা টাকার লোভে, পদের লোভে পড়ে কাদিয়ানি হয়েছে, তারা ফিরে আসে না সহজে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে কাদিয়ানিদের পথচলা শুরু হয় ১৯১২ সালে। এর আগে ১৯০৫ সনের দিকে চট্টগ্রাম আনোয়ারা থানার আহমদ কবীর নূর মোহাম্মদ মির্যা গোলাম আহমদের ধর্ম গ্রহণ করেন। তারপরে ১৯০৬ সনে কিশোরগঞ্জ জেলার নাগেরগাঁও গ্রামের রঈস উদ্দিন খাঁন কাদিয়ান গিয়ে কাদিয়ানি ধর্ম গ্রহণ করেন। ১৯০৯ সনে কাদিয়ানি ধর্ম গ্রহণ করেন বগুড়া নিবাসী মৌলভী মোবারক আলী খাঁন। তারপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সৈয়দ আব্দুল ওয়াহেদ সাহেব কাদিয়ানি ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত মির্জা কাদিয়ানির সাথে পত্র আদান-প্রদান করেন এবং তার এই যোগাযোগের উল্ল্যেখ বারাহীনে আহ্‌মদীয়ার পঞ্চম খন্ডে সংরক্ষিত আছে। তিনি কাদিয়ান হতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রত্যাবর্তনের সাথে-সাথে সেখানে জামাতে আহ্‌মদীয়া, বাংলাদেশের কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। সুতরাং ১৯১২ সন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জামাতে আহ্‌মদীয়া বাংলাদেশের পদচারণা শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে দলটির কেন্দ্র রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত।

The post দেশে কাদিয়ানিদের সংখ্যা কত? appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/oa2cNJA