Friday, June 19, 2020

মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামি : মাঠে ময়দানে সরব এক সাহসী কণ্ঠস্বর

মুনশী নাঈম:

গতবছর রমজানে, ঈদুল ফিতরের আগে দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামি রহ.। এবার ঈদের খুশির বদলে তিনি দিলেন বেদনার বাতাবরণ। আকস্মাৎ আমরা শুনতে পেলাম তিনি নেই। প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন ওপারে, রাব্বে কারীমের দরবারে।

তারাবি পড়তে যাবো। এই সময়ে তার ইন্তেকালের সংবাদ শুনতে পেয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেছিলাম। কিন্তু আমার কানে সরব হয়ে উঠেছে তার কণ্ঠস্বর। মাঠে-ময়দানে তার দৃপ্ত ভাষণ। এমন কোনো ইস্যু আছে, যেখানে তিনি কথা বলেননি? পত্রিকার পাতায়, নিউজ পোর্টালের হেডলাইনে ছড়িয়ে আছে তার হুংকারের, সাহসী উচ্চারণের প্রতিটি শব্দ, বাক্য। স্মৃতির রেডিওতে সব বক্তৃতা এখন যেন ধারাবাহিকভাবে বেজে উঠছে।

মিয়ানমারে যখন মুসলিম গণহত্যার উৎসব, তখন তিনি প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন। বাইতুল মোকাররমের উত্তর গেইট প্রকম্পিত করে বলেছিলেন, ‘উগ্র বর্মীয় সেনাবাহিনী, অংসান সূচী এবং সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যা ও জাতিগত নির্মুল অভিযান এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করতে হবে। অবিলম্বে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর পরিচালিত জাতিগত হত্যা-নির্যাতন বন্ধে জাতিসংঘ, ওআইসিসহ সব আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মুসলিমবিশ্বকে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে।’

ক’দিন আগে দেশে যখন গুম, খুন, ধর্ষণের মহড়া শুরু হয়েছিলো, তিনি তখন অপরাধ দমনে ইসলামি আইন বাস্তবায়নের কথা বলেছিলেন। ইসলামি আইনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘ইসলামি আইনের প্রতি ধর্মগত বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধের কারণে মানুষ শাসিত হয়। তাই শরিয়া আইন বাস্তবায়ন করা হলে ঘুষ, দুর্নীতি, খুন ও ধর্ষণ সহ সকল প্রকার অপরাধ কমে যাবে।’

তিনি কথা বলেছেন পোশাক শ্রমিকদের পক্ষে। শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো সমস্যার সমাধানের প্রয়োজন তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, ‘শ্রমিকদের আস্থা নিয়েই শিল্পের বিকাশ সম্ভব। যে উন্নয়নে শ্রমজীবি মানুষের স্বার্থ রক্ষা হবে, সেই কাজে শ্রমজীবি মানুষ তার সর্বস্ব দিয়ে কাজ করতে প্রস্তুত। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রদানের মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। এজন্য মালিক-শ্রমিকের বুঝাপড়া দরকার। শ্রমিকদের বাঁচার মতো মজুরি নির্ধারণ করা অপরিহার্য।’

বন্যায় যখন দেশের উত্তরাঞ্চল ভেসে যাচ্ছিলো, মানুষের দুর্দশা লাঘবে তিনি ত্রাণের হাত বাড়িয়ে দেবার জন্য আহ্বান করেছিলেন বৃত্তবানদের। তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী ফসল না উঠা পর্যন্ত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে খয়রাতি সাহায্য অব্যাহত রাখতে হবে। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি পুনঃনির্মাণ, গৃহনির্মাণ সামগ্রী এবং নতুন করে ফসল বোনার জন্যে কৃষকদের বীজ সারসহ সকল প্রকার কৃষি উপকরণ সরবরাহ করতে হবে।’ সেইসঙ্গে তিনি বন্যা দুর্গত এলাকার কৃষকদের জন্যে বরাদ্দকৃত কৃষিঋণ ও এনজিওদের প্রদত্ত ঋণ মওকুফ এবং নতুন করে কৃষি কাজ শুরু করার জন্যে নতুন কৃষিঋণ মঞ্জুরের জন্যে সরকার ও সংশ্লিষ্ট এনজিও কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।

ভারতে বাবরি মসজিদের জমি হিন্দুদের দিয়ে দেওয়ার রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশ, পাকিস্তান প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে তখন। বিজেপি ‘অভ্যন্তরীন বিষয়’ বলে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছিলো। মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামি তখন বিজেপির সমালোচনার করে বলেছিলেন, ‘প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের প্রতিবেদন যে বিতর্কিত, রোমিলা থাপার, রামশরণ শর্মা ও ডি এন ঝা’র মতো ভারতীয় ইতিহাসবিদের মন্তব্য তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। কেননা এসব প্রথিতযশা ভারতীয় ইতিহসিবিদরা প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের প্রতিবেদনকে গলদ, সন্দেহজনক ও ত্রুটিপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। আইন সঙ্গতভাবে নয়, বরং প্রশ্নবিদ্ধ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রদত্ত সুপ্রীম কোর্টের রায়ে বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে।’

২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইসলামী ঐক্যজোটের দলীয় কার্যালয়ে নেজামি সাহেব বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার আগে কোনো দল ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলেনি। এমনকি ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণায়ও ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা উল্লেখ নেই। আজ মহান বিজয় দিবসে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখার দীপ্ত শপথ গ্রহণের দিন। বর্তমানে দেশ, জাতি ও জনগণের বিরুদ্ধে অব্যাহত ষড়যন্ত্র চলছে। এ ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় বিজয় দিবসের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তোলা এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।’

করোনা ভাইরাসের এই সঙ্কটে মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামি দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কথাও তুলে ধরেছেন। বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি গরীব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বৃদ্ধির মিছিলে আরেকটি দু:সহ সংযোজন। ভোগ্যপণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা উন্মুক্ত রাখা সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি বরদাশত করা যায় না। পবিত্র রমজান অন্যান্যের মধ্যে ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ও মূল্যবোধের চেতনা সঞ্জীবিত করার মাস। রমজান অতিমুনাফাখোরীর মতো কুচিন্তা ও কুধারণা পরিত্যাগের অনুশীলনের মাস। কিন্তু রমজানে লক্ষ্য করা যায়, ব্যবসায়-বাণিজ্যে কালোবাজারী, প্রতারণাও প্রবঞ্চনার মতো প্রবণতা। অথচ ব্যবসায়ীদের এই কাজ রমজানের শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ক্রেতাসাধারণের সাথে আচরণের মাধ্যমেই একজন ব্যবসায়ীকে চেনা যায়। তাই তাদের আচরণ ক্রেতাদের কল্যাণে নিবেদিত হওয়া উচিত। ক্রেতাদের প্রতি শুভ দৃষ্টিভঙ্গী প্রদর্শনের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভ করতে পারেন। কারণ ব্যবসায়সহ সকল প্রকার মানবিক আচরণকে ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দেখা হয়েছে।’

বিবৃতিতে তিনি মানুষের আয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের একটি স্থিতিশীল মূল্যমান নির্ধারণ এবং বাজার দরের দিকে সর্বদা কড়া নজরদারি রাখার জন্যে সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।

এভাবে বলতে থাকলে আরও অনেক উদ্ধৃতি দেয়া যাবে। যখনই কথা বলার প্রয়োজন হয়েছে, কথা বলেছেন বর্ষীয়ান আলেম রাজনীতিবিদ মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তার কর্মকাণ্ড নেহাত কম নয়। মানুষের পাশে দাঁড়ানো, মানুষের পক্ষে কথা বলা, দেশের কথা বলা—প্রতিনিয়তই তাকে উজ্জীবিত রেখেছে। এই সেদিন, ৫ মে, হেফাজতের ইসলামের ঢাকা অবরোধ নিয়ে দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছেন। পয়লা মে শ্রমিকদের নিয়ে কথা বলেছেন। মৃত্যুর আগের দিন কথা বলেছেন বদরের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা নিয়ে। আমৃত্যু তিনি বলেই গেছেন। তার সাহসী এবং অকপট কণ্ঠস্বর তাকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছে অনেক কিছু। স্মৃতির রেডিওতে যেগুলো বেজে চলছে অবিরাম।

সূত্র:

টাইমস বিডি, ১০ জানুয়ারি, ২০১৯
লাস্ট নিউজ বিডি, ১০ আগস্ট, ২০১৬
আওয়ার ইসলাম, নভেম্বর ১১, ২০১৯
প্রিয় ডটকম, ২০১৬

The post মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামি : মাঠে ময়দানে সরব এক সাহসী কণ্ঠস্বর appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/3ehFfL5

No comments:

Post a Comment