Friday, March 27, 2020

হেজাযে দুর্যোগ : যখন হজ্ব বন্ধ হয়েছিল

আব্দুর রাহমান রাফি :

সারাবিশ্বে করোনাভাইরাস আজ এক আতংকের নাম। দুনিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। ধনী-গরিব ও মুসলিম-অমুসলিম প্রায় সব দেশই আক্রান্ত হয়েছে। এখন এই পরিস্থিতিতে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কল-কারখানা, দোকানপাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই সাথে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ধর্মীয় গণ সমাগমস্থলগুলোও।

কিছুদিন আগে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কাবার চত্বর। বন্ধ করা হয়েছে সাময়িকভাবে তাওয়াফ।  এটা নিয়ে অনেকের মাঝেই বেশ চাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। কেউবা ফেসবুকে কেউবা টুইটারে যা ইচ্ছা লিখছে। কেউ বলছে আল্লাহর কসম কোন মুসলমানের করোনা হতে পারে না। কেউ বলছে এই করোনা দাজ্জালের তত্ত্বাবধানে সংক্রমিত হচ্ছে। কেউ বলছে এটা ইহুদি খ্রিষ্টানের চক্রান্ত। কেউ বলছে যারা এই মসজিদ মাদ্রাসা আর আমাদের প্রাণপ্রিয় কাবা বন্ধ করল, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবে না।

কিন্তু দুর্যোগের কারণে কাবা শরীফের বন্ধ হয়ে যাওয়ার কাহিনি এই প্রথম নয়। অতীতে বহুবার বিভিন্ন দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে কাবা বন্ধ বা কাবা সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় কার্যক্রম সীমিত হয়ে গেছিল। চলুন আজ তাহলে সেই ঘটনাগুলোর কয়েকটি জেনে নেয়া যাক।

কারামেতা এবং তাদের হাজরে আসওয়াদ চুরি

৩১৭ হিজরীতে কারামেতা গোষ্ঠী মসজিদুল হারামে এক জঘন্য অন্যায় অভিযান চালিয়ে সেখানে থাকা লোকদের হত্যা করে এবং হাজরে আসওয়াদ চুরি করে নিয়ে যায়। কারামেতা গোষ্ঠী মনে করত যে হজ্ব হলো প্রাক-ইসলামিক ও মূর্তিপূজার এক অন্যতম আচার-রীতি। কারামেতা গোষ্ঠী ‘শিয়া’দের একটি দল। কুরামিতাহ রাজ্যের সাথে সম্পর্কের কারণে তাদের এই নামকরণ করা হয়, যা ফাতেমীয় রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আর এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হলেন হামদান ইবনে আশআছ। তাকে কুরমুত বলা হতো তার দৈহিক খর্বতার কারণে।

কারামেতা দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ৩১৭ হিজরীর সামান্য আগে, যখন কারামেতা গোষ্ঠী মক্কার উপকণ্ঠে অবিরাম আক্রমণ চালাচ্ছিল এবং শাম, ইয়েমেন এবং অন্যান্য স্থান থেকে আগত হজ্ব যাত্রীদের সংখ্যা বছরের পর বছর হ্রাস পাচ্ছিল। মুসলিম আলেমগণ ৩১৭ হিজরিতে ফতোয়া দিলেন- জীবন রক্ষার জন্য এখন ফরজ হজ্ব আদায় না করলে কোন সমস্যা নেই, সেটা জায়েয।

সেই বছরেই, হজ্বের মওসুমে তৎকালীন কারামেতা গোষ্ঠীর নেতা আবু তাহের আল-কারমাতি মক্কায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। এবং সিদ্ধান্ত মোতাবেক হত্যাযজ্ঞ চালালেন। হাজার হাজার মানুষের লাশ পড়ল মক্কার বুকে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণ অনুসারে মৃতের সংখ্যা ছিল হাজার হাজার, অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ।

ঐতিহাসিকরা আরও বর্ণনা করেছেন যে, কারামেতা গোষ্ঠী ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হজ্ব প্রতিরোধ করে রেখেছিল। এবং তারা এটিকে মূর্তিপূজার মতো প্রাক-ইসলামিক অভ্যাস হিসাবে বিবেচনা করেছিল।

বিভিন্ন মহামারীর প্রকোপ

১৮১৪ সালে হেজায অঞ্চলে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের ফলে প্রায় ৮০০০ লোক মারা গিয়েছিল, তাই সে বছর হজ্বে বাঁধার সৃষ্টি হয়েছিল।

১৮৩৭ সালে হজ্বের মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে একটি মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। এবং তা ১৮৯২ অবধি অব্যাহত থাকে। এই সময়ে দিনে এক হাজার করে হাজী মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় মহামারী। সে বছরও হজ্বের মৌসুমে একটি মহামারী দেখা দিয়েছিল, সেই মহামারীটি ভারত থেকে এসেছিল বলে ধারণা করা হয় এবং এতে তিন চতুর্থাংশ হজ্ব যাত্রী মারা গিয়েছিলেন।

প্রথম কলেরা মহামারী উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয়েছিল। এবং এটি ‘এশিয়ান কলেরা’ নামে পরিচিত ছিল। এটি ভারতের কলকাতা শহর থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া হয়ে মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব আফ্রিকা এবং ভূমধ্যসাগর উপকূল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এর আগেও বেশ কয়েকবার ভারত থেকে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে। এই সময়কালে, হাজার হাজার হজ্ব যাত্রী মহামারীটিতে মারা যায়, যার সংক্রমণ পূর্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ার মূলকেন্দ্র থেকে মক্কায় যাত্রাপথে স্থানান্তরিত হয়েছিল।

১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে টাইফয়েড বা আমাশয় জ্বরের মহামারী মদীনা থেকে আগত একটি কাফেলা থেকে ছড়িয়ে পড়ে। এবং খুবই দুর্বলভাবে তা অব্যাহত থাকে এবং পরে আর বেশী ছড়ায় না। একপর্যায়ে তা মিনায় শেষ হয়ে যায়। ১৯৮৭ খৃষ্টাব্দে মেনিনজাইটিসের প্রাদুর্ভাব। ৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে গুরুতর এবং অত্যন্ত সংক্রামক মেনিনজাইটিসের ফলে কমপক্ষে ১০০০০ জন আক্রান্ত হয়।

‘শত বছর আগের হজ্ব’ বইয়ে মহামারীর কিছু আলোচনা

রাশিয়ান পরিব্রাজক আবদুল আজিজ, যিনি ১৮৯৮ থেকে ১৮৯৯ এর মাঝামাঝি সময়ে হেজায পরিদর্শন করেছিলেন, তিনি তার স্মৃতিকথায় লেখেছেন যে মহামারী সাধারণত আরাফাত থেকে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে এবং মিনা থেকে প্রবল গতিময়তায় সাথে সংক্রমণ ঘটায়। যদি আরাফাতে মহামারীর প্রকোপ না থাকে, তাহলে আশা করা যায় মহামারীর আর বিস্তার ঘটবে না। আবদুল আজিজ আরও বলেন, মক্কা ও মদিনায় ৩০ জন রোগীর জন্য কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা ছিল এবং একটি মিনি হাসপাতাল ছিল।

তো বোঝা গেল যে, আগেও বহুবার হজ্বের কার্যক্রম সীমিত করা হয়েছে বিভিন্ন কারণে। এখানে মাত্র কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। আরো অনেক ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে ইতিহাসের ধূসর পাতায়। তাই আমরা বলি, ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন কোন ব্যক্তি কাবার বর্তমান ব্যবস্থা সম্পর্কে এমন আজেবাজে মন্তব্য করতে পারে না, যা তার নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। কেউ হয়ত বলতে পারেন, অতীতের পরিস্থিতি আর বর্তমানের প্রেক্ষাপট তো আর এক না। তাহলে কেনো এমন সিদ্ধান্ত? হ্যা এখানে ভেবে দেখা দরকার যে, অতীতে অবস্থা নাযুক হয়ে যাওয়ার পর আপনা আপনিই হজ্ব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই এখন এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যেন সেই অন্ধকার বীভৎস অতীত আবার ফিরে না আসে। পরিস্থিতি নাযুক হওয়ার আগেই চুড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। এতে দোষের কী আছে?

The post হেজাযে দুর্যোগ : যখন হজ্ব বন্ধ হয়েছিল appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/2UGPAYA

No comments:

Post a Comment