Friday, March 27, 2020

মহামারী বিপর্যয়ে সচেতনতা : অষ্টাদশ শতকের হানাফি ফকিহের ব্যাখ্যা

আবদুল্লাহিল বাকি

১.

বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্র একটি ভয়ঙ্কর ভাইরাস কোভিড -১৯ খুব দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। করোনাভাইরাস (চীনা: 冠状病毒, ইংরেজি: Coronavirus) হলো এমন একটি ভাইরাস, যা সমজাতীয় স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিকে আক্রান্ত করে। মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস শ্বাসনালী সংক্রমণ ঘটায়। করোনাভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে সাধারণভাবে সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এরকম কয়েক প্রকারের ভাইরাস পাওয়া যায়। কিন্তু নতুনভাবে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রমণ দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘২০১৯-এনসিওভি’ নামকরণ করে।

স্বল্প সময়ে ধীরে ধীরে সব দেশেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে। পৃথিবীর ইতিহাসের বড় বড় ও ভয়ঙ্কর মহামারী– প্লেগ অব জাস্টিনিয়ান, ব্ল‍্যাক ডেথ, স্মল পক্স, কলেরা, ইবোলা ইত‍্যাদির মত এই রোগ বর্তমানে মহামারীর আকার ধারণ করেছে। কিন্তু লেপ্রোসি, স্মল পক্স, কলেরা ইত্যাদির জন‍্য যেমন টিকা, ভ‍্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে, তেমন কোন দাওয়াই এখনো করোনার জন‍্য আবিষ্কৃত হয়নি। আপাতত ভাইরাসের সংক্রমণ এড়ানোর জন‍্য জমায়েত ও সম্মিলন এড়ানোর আদেশ দেয়া হচ্ছে। অনেক দেশে জরুরী ভিত্তিতে সঙ্গনিরোধ (Quarantine) আইন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

ইসলাম যেহেতু সার্বজনীন ধর্ম, সেহেতু এর প্রাসঙ্গিকতা কোন স্থানেই থেমে নেই। করোনা ভাইরাসের ক্রমবর্ধমান সংক্রমণকে কেন্দ্র করে ইসলাম সম্পর্কিত অনেক প্রশ্নের চর্চা সমাজে ও যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে হচ্ছে। ইসলামে ইবাদত ও আরাধনার কিছু পদ্ধতি আছে, যার জন‍্য সম্মেলনের জরুতর হয়। যেমন, নামাজ; নামাজ প্রত‍্যেকের উপর ফরজ আইন এবং এলাকায় জামাত অনুষ্ঠিত করা ফরজে কেফায়া। তেমনিভাবে যারা কাবা শরিফে ওমরাহ করেন, তারা জমায়েত ছাড়া সেটা করতেই পারবেন না। এছাড়া সম্মিলিত দোআ, ওয়াজ-মাহফিল ইত‍্যাদি ধর্মীয় ইস‍্যুর জন‍্য ধর্মপ্রাণ লোকেরা একত্র হয়।

ধর্মীয় আরাধনাকে কেন্দ্র করে একত্র হওয়া ছাড়াও আরো ধর্মীয় প্রশ্নের চর্চা হচ্ছে সমাজে। যেমন ইসলামে ছোঁয়াচের ধারণা বলতে কিছু আছে কি না? মহামারীর প্রকোপ থেকে রক্ষা পাবার জন‍্য সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে নাকি তা তাকওয়ার বিপরীত? ইত‍্যাদি।

এক্ষেত্রে অনেক আবেগী তরুণ ও অদূরদর্শী ধর্মীয় ব‍্যক্তিত্বরা বাংলাদেশে ও বাংলাদেশের বাইরে প্রান্তিক চিন্তার শিকার হয়েছেন। কিন্তু দীনের রুসুখ ও তাফাক্কুহ-সম্পন্ন আলেমগণ পরিস্থিতিকে বিবেচনায় রেখে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

২.

মহামারী প্রকোপ আজকের তুলনায় আগের যুগে অনেক বেশি ছিল। তাই এসব প্রশ্নগুলো আমাদের ঐতিহ‍্যের আলেমদের সামনেও এসেছিল। তারাও এর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ফিলিস্তিনের গাজা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘আল কাওয়ারিসুত তবিয়িয়‍্যা ফি বিলাদিশ শাম ও মিসর’ (শাম ও মিসরের প্রাকৃতিক দুর্যোগ) নামক একটা এমফিল পত্রে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক যত দুর্যোগ আছে, যেমন দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস, মহামারী, পঙ্গপালের হামলা ইত‍্যাদির মধ‍্যে মুসলমান ফকিহ ও চিকিৎসকগণ সবচে’ বেশি লেখালেখি করেছেন মহামারী বিষয়ে। বোঝা যায়, ইসলামী ট্রাডিশনে মহামারীকে ঘিরে উক্ত প্রশ্নগুলো সবসময়ই আবর্তিত ছিল। মহামারীকে নিয়ে আলেমগণের পৃথক অনেক গ্রন্থেরও অস্তিত্ব আছে। কিন্তু জ্ঞানজগতের কাকতালীয় দুর্ভাগ্যও বলতে হয় যে, অনেক আলেম মহামারী নিয়ে লিখেছেন। সাথে সাথে তাদের মৃত‍্যুর কারণও ছিল তার যুগের মহামারী।

এর মধ‍্যে তাজুদ্দিন সুবকির কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি মহামারী সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘জুযউন ফিত তাউন’। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি ৭৭১ হি. সালে মহামারীতে ইন্তেকাল করেন। শিহাবুদ্দিন ইবনে আবি হাজালা তিলমেসানী লিখেছিলেন মহামারী বিষয়ে ‘আত-তিব্বুল মাসনুন ফি দাফইত তাউন’ (মহামারী মোকাবেলায় শরীয়ার প্রতিকার)। অথচ তিনি ৭৭৬ হি. সালে মহামারীতে ইন্তেকাল করেন। এছাড়াও আছেন ঐতিহাসিক ইবনুল ওয়ারদি। যিনি ‘আননাবা আনিল ওবা’ নামে বিবরণমূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন মহামারী নিয়ে। এর মধ‍্যে তার পূর্বের যুগগুলোর মহামারীর কথা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তার যুগের বিবরণ কিছুটা লিপিবদ্ধ করে আর সামনে এগুতে পারেন নি। ৭৪৯ হি. সালের মহামারী তার প্রাণ নিয়ে যায়।

ইবনে হাজার আসকালানি রা. (৭৭৩ – ৮৫২ হি.) তার যুগে মহামারীর প্রকোপ উত্তরোত্তর বৃদ্ধির কারণে একটা গ্রন্থ রচনা করেন মহামারী নিয়ে। নাম ‘বাজলুল মাঊন ফি ফাদতিত তাউন’ (মহামারীর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনায় স্বল্প প্রয়াস) নামে। এই গ্রন্থে তিনি বলেছেন, “আল্লাহ মহামারী সৃষ্টি করেছেন কাফের সম্প্রদায়ের শাস্তি ও আজাবস্বরূপ। এক্ষেত্রে তিনি ঐসব বর্ণনা দ্বারা প্রমাণ দিয়েছেন, যাতে মহামারী দ্বারা পূর্ববর্তী জাতিদেরকে ধ্বংস করে দেয়ার বিবরণ আছে। আর তিনি মহামারীকে মুসলমানদের জন‍্য রহমতস্বরূপ বলে মত দিয়েছেন। দলিল দিয়েছেন ঐসব হাদিস দ্বারা যাতে বর্ণিত হয়েছে, মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত‍্যুবরণ করলে মুমিনরা জান্নাতে যাবে।”

এই গ্রন্থ লেখা শুরু করার কিছুদিনের মধ‍্যেই তার দুই মেয়ে আলিয়া ও ফাতেমা ৮১৯ হি. সালে মারা যায় সেই মহামারীতে। কতক ধর্মতাত্ত্বিক রসিকতা করে বলেছেন, এই গ্রন্থটা লেখাই হয়তো তার কন‍্যাদ্বয়ের মহামারী আক্রান্ত হবার কারণ। ৮১৯ হিজরীতে একসাথে তার দুই মেয়ে মারা যাবার পর তিনি সেই গ্রন্থটা লেখা বাদ দেন। ৮৩৩ হিজরীতে, তার বক্তব‍্য অনুযায়ী, কিছু বেদাতীর বাড়াবাড়ির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ঐ গ্রন্থের বাকিটুকু সম্পন্ন করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এর কিছুদিন পর তার শেষ মেয়ে যাইনে খাতুন প্লেগাক্রান্ত হয়ে মারা যান।

এছাড়াও আরো অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে মহামারীকে কেন্দ্র করে। এর মধ‍্যে উল্লেখযোগ্য হল, দার্শনিক ইয়াকুব আল-কিন্দীর (২৫৪ হি.) ‘রিসালাতুন ফিল আবখারাতিল মুসলিহাতি লিল জাওয়ি মিনাল আওবিয়া’ (পরিবেশকে মহামারী-শোধন করতে কিছু উপকারী ধূম্র)। আছে হাফেজ ইবনে আবিদ্দুনয়ার (২৮১ হি.) ‘কিতাবুত তাওয়াইন’। আছে ইবনুল কায়‍্যিম জাওযিয়ার (৭৫১ হি.) ‘কিতাবুত তাউন’। বদরুদ্দিন যারকাশী (৭৯৪ হি.) লিখেছেন ‘রিসালাতুন ফিত তাউন’। জালালুদ্দিন সুয়ূতী (৯১১ হি.) লিখেছেন ‘মা ওরায়ার ওয়াউন ফি আখবারিত তাউন’ এবং ‘আল মাকামাতুত তাউনিয়‍্যা’।

পঞ্চাদশ শতকের একজন যুগসচেতন আলেম ছিলেন ইদরিস বিন হুসামুদ্দিন বাদলিসী (৯৩০ হি. মোতাবেক ১৫২৪ ঈ.)। তিনি একবার হজ্বযাত্রা করেছিলেন তুরস্কের কনস্টান্টিনোপল থেকে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ার সমুদ্র পথে। কিন্তু ফেরার পথে তিনি জানতে পারলেন, মিসরে মহামারীর প্রকোপ চলছে। তাই মিসরে আর ঢুকলেন না, প্রবল ইচ্ছা থাকার পরও। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দামেস্ক ও হালাবের কতক আলেম তার সমালোচনায় রত হলেন। তখন তিনি তাদের জবাবে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, নাম ‘রিসালাতুন ফিত তাউন ওয়া জাওয়াযুল ফিরারি আনহু’ ( মহামারী থেকে পলায়নের বৈধতা)। এর আরেক নাম ‘আল-ইবা আন মাওয়াকিইল ওবা’।

কিন্তু আমাদের কাছে সবচে’ বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হলো আলজেরিয়ায় ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক, হানাফি ফকিহ, বিচারক ও দার্শনিক হামদান বিন উসমান খাজার (১৭৭৩ – ১৮৪২ ঈ.) একটি গ্রন্থ ‘ইতহাফুল মুসান্নিফিন ওয়াল উদাবা বি-মাবাহিছিল ইহতেরাযি আনিল ওবা’ (মহামারী থেকে সতর্কতার আলোচনা : লেখক ও সাহিত‍্যিকদের জন‍্য একটি উপঢৌকন)। তার এই বই নিয়েই এখানে কিছু কথা লিখব

৩.

হামদান জন্মগ্রহণ করেছেন ১৭৭৩ সালে। কোরানের হাফেজ হয়েছিলেন শৈশবে। দীনের প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেছেন। তারপর প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে ১৭৮৪ সালে তার মামার সাথে ইস্তাম্বুলে গমন করেন, আলজেরিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে ত‍ৎকালিন উসমানী সুলতানের কাছে হাদিয়া প্রদান করতে। এগার বছরের হামদানের উপর এই সফর বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। এখান থেকেই তার অপ্রতুল তৃষ্ণা জাগে সকল প্রকারের জ্ঞান বিজ্ঞান শেখার প্রতি। ইস্তাম্বুল থেকে ফিরে এসে তিনি উসুলুল ফিকহ, ফিলোসফি, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ অন‍্যান‍্য আধুনিক বিষয় শিক্ষার জন‍্য উচ্চ বিদ‍্যালয়ে ভর্তি হন। এসকল বিষয়ে জ্ঞানার্জনের ফলে তিনি মহামারী বিষয়ে এরকম অসাধারণ একটি গ্রন্থ উপহার দিতে পেরেছেন।

তার পিতা উসমান খাজা একজন গণ‍্যমান‍্য হানাফি ফকিহ ও প্রশাসনিক ব‍্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি উসমানী সাম্রাজ‍্যের আলজেরিয়ার রাজপ্রতিনিধি দলের (The regency of Algiers) সাধারণ মহাসচিব ছিলেন। তার ইন্তেকালের পর তার পুত্র হামদান খাজা সেই পদে অধিষ্ঠিত হন। এর পাশাপাশি তিনি সাধারণ মানুষদের দীনি বিষয়ের শিক্ষকও ছিলেন। এর কিছুদিন পর তিনি তার মামার সাথে ব‍্যবসা করে আলজেরিয়ার ধনী লোকদের একজন হয়ে উঠেন। এর ফলে তিনি কনস্টান্টিনোপলসহ প্রাচ‍্য ও পাশ্চাত‍্যের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছেন। এরই সুবাদে ফ্রেঞ্চ, ইংরেজি ও তুর্কিসহ অন‍্যান‍্য কিছু ভাষা আয়ত্ব করতে পেরেছেন। তাছাড়া তিনি যেহেতু ফকিহ ছিলেন, সেহেতু বিভিন্ন দেশের উরফ (Social custom), রাজনৈতিক ব‍্যবস্থাপনা বুঝতে তার সুবিধা হয়েছিল। ১৮৩০ সালে আলজেরিয়ায় ফরাসিদের উপনিবেশবাদের সূচনা হয়। তখন থেকেই হামদান বিন উসমান খাজা বিভিন্নভাবে এর বিরুদ্ধে লড়াই করে গিয়েছেন।

তার উল্লেখযোগ‍্য গ্রন্থগুলোর মাঝে আছে, ‘আ-মিরআত’ (দর্পন)। এই গ্রন্থটা আলজেরিয়ায় ঐতিহাসিকভাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি আলজেরিয়ায় ফরাসি সাম্রাজ‍্যবাদ কায়েমের পর দেশ ও জনগণের অবস্থা তুলে ধরেছেন। আরব, তুর্কি ও বারবারদের জীবনাচার, সংস্কার, সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রের ব‍্যবস্থাপনা তুলে ধরেছেন। তিনি এটা আরবিতে লিখেছেন। ফরাসি ভাষায় তর্জমা করেছেন ১৮৩৩ সালে তার বন্ধু হাসুনাত দাগিস, ‘Aperçu historique et statistique sur la Régence d’Alger’ নামে।

এছাড়া তিনি ‘আল-মিরআত’ গ্রন্থের একটা সংক্ষিপ্তসার লিখেছেন ‘মুজাক্কিরাহ’ নামে। লিখেছেন ‘হিকমাতুল আরিফ বি-ওয়াজহিন ইয়ানফা’ আল-মাসআলা : লাইসা ফিল ইমকানি আবদা’, এই গ্রন্থটা তিনি একটা দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে রচনা করেছেন। সম্ভাব‍্যতার ক্ষেত্রে নতুনত্ব বলে কিছু আছে কি নেই? অর্থাৎ আমরা যেসব বিষয়কে সম্ভাব‍্য বলে স্বীকার করি সেগুলো কি আদি থেকেই সম্ভাব‍্য, নাকি এমন সম্ভাব‍্য বিষয়ের অস্তিত্ব আছে, যা আদিতে সম্ভব ছিল না। পরবর্তীকালে সম্ভাব‍্যতার গুণ লাভ করেছে। এই প্রশ্নে তিনি ইমাম গাজালীর মতকে সমর্থন করে বিরুদ্ধবাদীদের মত খণ্ডন করেছেন।

ফিকহের ক্ষেত্রে তিনি ফিকহে হানাফির মতন গ্রন্থ ‘নুরুল ইযাহ’র তুর্কি তর্জমা করেছেন ১৮৩৯ ঈ. ‘ইমদাদুল ফাত্তাহ’ নামে।

৪.

হামদান বিন উসমান খাজার সময়ে অনেক মানুষ ভাইরাস জনিত রোগের কারণে মারা যেত, যেহেতু তখনও মানুষের স্বাস্থ‍্য-সচেতনতা ও কঠিন রোগ প্রতিরোধক বিভিন্ন টিকা ও ভ‍্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। ১৭৯৩ সাল থেকে একটা মারাত্মক ভাইরাস জনিত রোগ পীতজ্বর (Yellow fever) মানুষের মাঝে ব‍্যাপকভাবে সংক্রমিত হতে থাকে। এশিয়ায় এর প্রভাব না দেখা গেলেও আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় এই মহামারীর প্রকোপে প্রতিবছর প্রায় দুই লক্ষ লোকের মত আক্রান্ত হত ও মারা যেত ত্রিশ হাজারের মত লোক। আর হামদানের মাতৃভূমি আলজেরিয়া হল উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় ভূমধ‍্যসাগরের তীরে অবস্থিত আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তর দেশ। তাই পীতজ্বরের প্রভাব সেখানে একটু বেশিই পড়েছিল।

এছাড়া লেখকের এই গ্রন্থ রচনার প্রেক্ষাপট মনে করা হয় ১৮১৭ সালের প্রথম কলেরা মহামারীকে। এর শুরুটা হয়েছিল রাশিয়ায়। সেখানে এতে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। দূষিত পানির মাধ্যমে এই রোগ পরে ব্রিটিশ সেনাদের মধ্যে ছড়ায়। এরপরে তা ভারতে ছড়ায়, সেখানেও ১০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতেও কলেরা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। স্পেন, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ইতালি, জার্মানি ও আমেরিকার পাশাপাশি আফ্রিকায় কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। এসব অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

এছাড়াও আলজেরিয়ায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাইরাস মহামারীর আকার ধারণ করে। ১৭৮৭ সালে উসমানী সালতানাত থেকে একটা জাহাজ আলজেরিয়ায় আগমন করে। সেখান থেকে মারাত্মক একটা ভাইরাস ছড়ায়। যা মহামারীর আকার ধারণ করে। একে আঞ্চলিকভাবে নামকরণ করা হয়েছিল ‘আল ওবাউল কাবির’ নামে। এটার প্রভাবে শুরুর দিকে দিনে প্রায় পাঁচশ’জন করে মানুষ মারা যেত। এর স্থিতি ছিলো প্রায় দশ বছর। ১৭৯৯ সালে ফান্সের নেপোলিয়ান বোনাপার্টের হামলার সময় আলজেরিয়ায় একটি মহামারী শুরু হয়। যার সংক্রমণে প্রতিদিন ১২০ জন করে মানুষ মারা যেতে থাকে।

এতসব মহামারীর মধ্যে ধর্মীয় যেসব প্রশ্ন ওঠার কথা সেগুলো ওঠাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে চরমপন্থা ও মধ্যপন্থার মানুষ আলজেরিয়ার সমাজেও ছিল। এসব প্রশ্নের উত্তরের উদ্দেশ্যেই হামদান বিন ওসমান খাজা মহামারী সম্পর্কিত মূল্যবান গ্রন্থটি লিখেছিলেন আরবি ভাষায় ১৮২৬ সালে। তারপর তুর্কি ভাষায় এর অনুবাদ করেন ‘সিতারুল ইতহাফ’ নামে। এবং গ্রন্থটি উসমানী খিলাফতের সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ খানকে হাদিয়া হিসেবে দেন। এ গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম উম্মাহকে সচেতনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান করা, পাশ্চাত্য সভ্যতার উপকারী দিক— বিশেষত তারা চিকিৎসার ক্ষেত্রে আধুনিক গবেষণার আলোকে রোগের যেসব কারণ নির্ণয় করেছে, রোগের প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে, সেগুলো গ্রহণ করা।

খন্ডন করেছেন ওইসব রক্ষণশীলদের যারা কোন ধরণের পরিবর্তন মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। যারা কেবলই ভরসাকারী, যারা আল্লাহর ইচ্ছার উপর সকল বিষয়ের দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা ঘরে বসে ঘুমায়। যারা মহামারী ও ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কোন ধরণের সতর্কতামূলক পদক্ষেপ ও তা থেকে বাঁচার মাধ্যম গ্রহণ করে না। এই পুস্তকটি লেখক ভাগ করেছেন একটি ভূমিকা, তিন অধ্যায়, উপসংহার ও একটি পরিশিষ্ট দিয়ে। ভূমিকার অধীনে নয়টি রচনা আছে আর উপসংহারে আছে পাঁচটি বিষয়ের বর্ণনা। গ্রন্থটির ধর্মতাত্ত্বিক মূল্য আরো বেড়ে গিয়েছে এজন্য যে গ্রন্থটির শুরুতে সে যুগের আট জন শ্রেষ্ঠ ফকিহ ও বিজ্ঞ আলেমের অভিমত যুক্ত করা হয়েছে।

ভূমিকায় প্রথম প্রবন্ধেই তিনি ইলমে কালামের একটি মাসালা দিয়ে শুরু করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আহলুস সুন্নাহর মধ্য হতে উসুলুদ দীন ও ইলমে কালামের সাথে যার নূন্যতম সম্পর্ক রয়েছে সেও জানে, সর্বসম্মতভাবে পৃথিবীর সকল আলেম একমত যে, আল্লাহ তাআলাই বান্দা ও তার সকল কাজকর্মের ও পাপ-পুণ্যের সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহ ভাগ্যকে পূর্ব থেকে নির্ধারণ করে রেখেছেন। রোগ-ব্যাধি, সুস্থতা-অসুস্থতা, দারিদ্র ও ঐশ্বর্য, ওষুধ-রোগমুক্তি— সবই আল্লাহ পূর্ব থেকে নির্ধারণ করে রেখেছেন।’

দ্বিতীয় প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘ভাগ্য আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করে দেবার পরও আপন হিকমতে তা বান্দার থেকে লুকিয়ে রেখেছেন। এবং পৃথিবীতে প্রকাশ্য যা কিছু রয়েছে তার মাঝে সাবাব মুসাব্বাব তথা কারণ কার্যকারণের সম্পর্ক সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’ এই দুই প্রবন্ধের মাধ্যমে যেন তিনি ওই ধারণাকে পূর্বখন্ডন করতে চাচ্ছেন যা তৈরি হতে পারে, রোগ প্রতিরোধে উপায় উপকরণ গ্রহণের আহ্বান জানালে।’

তৃতীয় প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘জেনে রাখ, আল্লাহ মানুষকে আদেশ দিয়েছেন হাত দিয়ে হোক বা অন্য কিছু দিয়ে, নিজের থেকে সকল ধরনের কষ্ট, বালা, মুসিবত ইত্যাদি যা প্রাণনাশের কারণ হয়– তার প্রতিরোধ করতে। রোগের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করা শরীয়তের নির্দেশনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ রোগ সৃষ্টি করেছেন এবং তার প্রতিরোধ-ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে কোন কারণ ছাড়াই রোগকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি উপকরণ সন্ধান করার আদেশ দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে উপকরণের সাহায্য নেয়া তাকদীরের বিপরীত বিষয় নয়। বরং এটাই তাকদীর। কারণ এখন যে আমার রোগ হবে, সেটা যেমন তাকদীরের পাতায় লেখা আছে, এমনিভাবে এটাও লেখা আছে যে, এই ওষুধ সেবন করার পর আমি আরোগ্য লাভ করব।’

চতুর্থ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলার উপর সিদকে তাওয়াক্কুল, সকল কারণ, উপকরণ বর্জন, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা-উদ্দেশ্য ও চূড়ান্ত ক্ষমতার সামনে মৃতদেহের মতো পড়ে থাকা— সুফিসাধনার অতি উচ্চ মাকাম, যা আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। এবং এটি আল্লাহর বিশেষ ব্যক্তিত্বদের গুণ। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মুত্তাকির চেয়ে অধিক আল্লাহকে ভয় করেন এবং আল্লাহর প্রতি সবচেয়ে বেশি তাওয়াক্কুল তার‌ই রয়েছে। তবুও তিনি স্বাভাবিকভাবে কারণ ও উপকরণ ব্যবহার করেই জীবন যাপন করেছেন। তাছাড়া সাহাবাদেরকে তিনি এসব ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি থেকে নিষেধ করেছেন। যদিও আপন ইজতিহাদের আলোকে একবার সাহাবীদেরকে বলেছিলেন খেজুরের ফলন বৃদ্ধির জন্য গাছের নর-মাদি মিলনের বিশেষ প্রক্রিয়াটি অবলম্বন না করার জন্য। কিন্তু এতে পরের বছর ফলন কম হল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তোমাদের দুনিয়ার ব্যাপারে অধিক জ্ঞাত।’

পঞ্চম প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘কোন সন্দেহ নাই যে, কোন কিছু কার্যের কারণ হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য শরীয়তের মুখাপেক্ষী নয়। বরং অনেক কার্যের কারণ নির্ধারিত হয় যেমন শরীয়তের মাধ্যমে, তেমনিভাবে ইলহাম এবং অভিজ্ঞতার আলোকেও নির্ধারিত হয়। শরিয়াগত দিক থেকেও এর গ্রহণযোগ্যতা আছে, যতক্ষণ না সেটা দীনের কোন মৌলিক নীতিমালার বিরোধী হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আরবদের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করতে কোন অসুবিধা নেই।’ এখানে আরব শব্দটি শুধুমাত্র উপমারূপে ব্যবহৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে আরবদেরকে নির্দিষ্টকরণ উদ্দেশ্য নয়, বরং সকল কিছুর অভিজ্ঞতাই এর অধীনে আসবে। তাছাড়া আলেমদের ইজমা তথা ঐক্যমত্য দ্বারাও এ বিষয়টি সাব্যস্ত। কারণ, আমরা শুধুমাত্র কোরআন হাদিস থেকেই রোগব্যাধির বিষয়ে জানিনি। বরং সাথে সাথে অনেক রোগ ও এর প্রতিকারের ব্যাপারে আমরা গ্রিক চিকিৎসা-দর্শন থেকে জেনেছি। এবং এসব চিকিৎসা গ্রহণ করা যে জায়েজ, এ ব্যাপারে আলেমগণ একমত। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জ্ঞান মুমিনের হারানো ধন, যেখানেই সে তা পাক, সেই হবে এর অধিক হকদার। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে অভিজ্ঞতা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ধর্ম ও ন্যায়পরায়ণতা কোন বাধা সৃষ্টি করে না।’

ষষ্ঠ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘কোন কারণ অথবা উপকরণ অবলম্বন করলেই যে ফলাফল চলে আসবে, এমন ধারণা করা ভুল। হতে পারে মাঝে কোন বাধা রয়েছে, বা সেই ফলাফলে পৌঁছার জন্য আরো কয়েকটি কারণ বিদ্যমান রয়েছে। কারণ অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এমন অনেক জিনিস আছে যার কারণ একাধিক। উদাহরণ স্বরূপ, কারো ক্ষেত্রে দেখা গেল যে, জাহাজে আরোহন করা তার জন্য আল্লাহর হুকুমে ডুবে যাওয়ার কারণ হয়েছে। কিন্তু জাহাজে আরোহন করার কারণ পাওয়া যাওয়ার পরেও অনেকের ক্ষেত্রে ডোবা সাব্যস্ত হয়না। হতে পারে মাঝে আরো কারণ রয়েছে, যা তাকে ডুবে যাওয়া হতে রক্ষা করেছে। যা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তেমনিভাবে কুষ্ঠরোগের মত বেশ কিছু রোগ রয়েছে যা সাধারণত মানুষকে আক্রান্ত করার কারণ। কিন্তু কখনোবা দেখা যায়, স্পর্শের পরও এই রোগ অন্যের মাঝে সংক্রামিত হচ্ছে না। এর বিভিন্ন কারণ হতে পারে। হয়তো তার মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি অথবা তার দেহ হয়তো কুষ্ঠরোগকে ভেতরে গ্রহণ করতে চাচ্ছে না ইত্যাদি এমন সব কারণ, যা আমাদের জ্ঞানের ঊর্ধ্বে। এই সম্ভাব্যতা দ্বারা মুতাআসসিবুন বা চরমপন্থীরা প্রমাণ পেশ করে থাকে। কিন্তু তাদের প্রমাণের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। কারণ, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি হতে পালাও যেমনভাবে বাঘ থেকে পালাও।’

সপ্তম প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, আমাদের যুগে ও আমাদের যুগের কিছুপূর্বে আফরাঞ্জ তথা ইউরোপিয়ানরা প্রকৃতি বিজ্ঞান, গণিত ও প্রকৌশলবিদ্যায় চূড়ান্ত অগ্রগতি অর্জন করেছে, এমনকি চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশল, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি যেন তাদের ভূষণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সাথে সাথে তারা সততাও রক্ষা করেছে। কারণ তারা স্বীকার করে যে, এসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল তারা অর্জন করেছেন মুসলমানদের গ্রন্থাবলী থেকে। এবং এক্ষেত্রে তারা আপন অভিজ্ঞতা ও গবেষণার আলোকে আরো অনেক বৃদ্ধি করেছেন যার ফলে আজ শাস্ত্রগুলো তাদেরই প্রতীক বহন করে চলছে। চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষা করা ফরজে কেফায়া। মুসলমানরা বর্তমানে তা বিভিন্ন কারণে শিখতে পারছে না। বরং তারা এই দুর্যোগময় সময়ে দ্বীনি জ্ঞান বিজ্ঞান ও আরবি সাহিত্যের পাঠকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এটাতে কোন অসুবিধা নেই। ‘মানুষ যা জানে না তার শত্রু’ এই মূলনীতি কোন মুসলমানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হলেই সমস্যা ও প্রকৃত অসুবিধা।’

অষ্টম প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘রাজা বাদশা দায়িত্বশীলদের উচিত,তারা যেন তাদের অধীনে যারা আছে তাদের সাথে একজন স্নেহশীল দয়ালু পিতার আচরণ করেন। তাদের উচিত তাদের অধীনস্থদের ভিতর যেসব ক্ষতিকর বিষয় অনুপ্রবেশ করে সেগুলো সংশোধন করা। ক্ষতিকর রোগ কিভাবে তার জাতির মাঝে প্রবেশ করছে এবং তা প্রতিকারের উপায় কী? সে সম্পর্কে সম্মক অবগতি লাভ করা, সাথে সাথে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া– তার দায়িত্ব। রক্ষণশীল লোকদের সাথে গলা না মিলিয়ে তার উচিত ধর্মের নামে সমাজে যেসব প্রথা ও কুসংস্কার প্রচলিত আছে সেগুলো পরিবর্তন করা, কারণ তাতে হয়তো কখনো ক্ষতি দূর হবে অথবা কোন উপকার সাধিত হবে।’

নবম প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে মহামারীর ক্ষেত্রে এক ধরণের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়। এজন্য তারা যে বিশেষ-ব্যবস্থাটি অবলম্বন করে, তার নাম হলো كرنتينه (Quarantine)। এর অর্থ হলো অন্যের সঙ্গ হতে সতর্ক ও দূরত্ব অবলম্বন করা। এর অনেক সুরত আছে। একটি সুরত হলো, মহামারী আক্রান্ত কোন দেশ থেকে কেউ ইউরোপে আগমন করলে অথবা ইউরোপীয় কাউকে মহামারী-আক্রান্ত মনে হলে, তারা তাকে একটি বিশেষ ঘরে কিছুদিনের জন্য আবদ্ধ রাখে। যাতে এই কিছুদিনের মধ্যে তাঁরা নিশ্চিত রূপে অবগত হতে পারে, তার মাঝে রোগ আছে কি নেই। যখন তারা পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝতে পারবে যে, তার মাঝে রোগটি নেই, তখন তাকে ছেড়ে দিবে। এক্ষেত্রে তারা অতিরিক্ত সতর্কতার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যাতে শরিয়াগত দিক থেকে কোন বিরোধ নেই শুধুমাত্র আগমনকারীদেরকে কষ্ট দেয়া ছাড়া। আর বড় ক্ষতি ঠেকানোর জন্য ব্যক্তিগত ও ছোট ক্ষতিকে মেনে নিতে অসুবিধা কী? ইউরোপিয়ানরা এর উপকারিতা অনেকদিন যাবত দেখে আসছে। এ

গ্রন্থের প্রথম অধ‍্যায়ে তিনি মৃত্যু, ধ্বংস, মহামারী ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকার পক্ষে-বিপক্ষে আয়াত ও হাদীসগুলো উল্লেখ করে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘হাদিসগুলো জমা করার পরে আলিমগণ ও হাদিসের ব্যাখ্যাকারগণ বলেছেন, এই হাদিসগুলোর মাঝে কোন বিরোধ নেই। এক্ষেত্রে মূলনীতি হল, রোগ মহামারী ইত্যাদি ঠেকাতে আসবাব ও উপকরণ অবলম্বন করা শরীয়তসম্মত বিষয়। তবে তিরস্কারযোগ্য বিষয় হল, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুকে প্রকৃত প্রভাবশালী বলে বিশ্বাস করা এবং এই বিশ্বাস করা যে, আসবাব অবলম্বন আল্লাহতালার লিখিত ভাগ্যকে পরিবর্তন করে দেয়। ভাগ্যে যা লেখা আছে তা ঘটবেই।’

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, {ولا تلقوا بايديكم إلي التهلكة} (অর্থ: তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।) এখানে উল্লেখিত তাহলুকা তথা ধ্বংস কয় প্রকার এবং সেগুলোর হুকুম কি সেটা তিনি ইমাম গাজ্জালীর বরাতে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ধ্বংস তিন প্রকার। ১. এমন ধ্বংস, যার কারণ ও অস্তিত্ব পাওয়া গেলে কার্য তথা ধ্বংস‌ও সংগঠিত হয়ে যাবে। যথা, আগুনের নিজেকে নিক্ষেপ করা। ২. এমন ধ্বংস, যার কারণ অস্তিত্ব পাওয়া গেলে কার্য তথা ধ্বংস সংঘটিত হওয়া অতি সম্ভাব্য। কিন্তু কখনো কখনো বিভিন্ন কারণে তা সংঘটিত হয় না। যেমন, মহামারী আক্রান্ত লোকের সাথে মেশা। ৩. এমন বিষয়, লোকমুখে যার কারণে ক্ষতির কথা শোনা যায় কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। যেমন, বদ ফাল। প্রথম প্রকারের হুকুম হল তা থেকে সর্তকতা অবলম্বন করা সকলের মধ্যেই ফরজ। দ্বিতীয় প্রকারের ব্যাপারে হুকুম হল তা থেকে সর্তকতা অবলম্বন করা জায়েজ। তবে সতর্কতা অবলম্বন না করা হারাম নয়, কিন্তু যদি শরীয়তের আদেশ থেকে থাকে তাহলে ভিন্ন কথা। তৃতীয় ব্যাপারে কথা হল, তা থেকে দূরে থাকা নিন্দনীয়। কিন্তু শরীয়তের কোন নস না পাওয়া গেলে তা হারাম হবে না।’

এই গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায় তিনি রচনা করেছেন ওই সকল লোকের কথার জবাবে যারা কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাকে ইসলামের বিপরীত ভাবে। সেই চরমপন্থীদের আপত্তি তিনি তুলে ধরেছেন, ‘অনেকে বলে, কোয়ারেন্টাইন বিদেশি শব্দ ও এই ব্যবস্থাটি কাফেরদের থেকে আগত, ইসলামী ঐতিহ্যে এর কোন অস্তিত্ব নেই। আর কাফেরদের অনুসরণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ।’ এর উত্তর‌ও তিনি দিয়েছেন যে, ইসলাম সবকিছুর বিধান নাম উল্লেখ করে করে লেখা হয়নি। বরং অনেক কিছুর বিধান পরবর্তীতে নজিরের উপর কিয়াস করে জানতে হয়েছে। কোয়ারেন্টাইন বর্তমান সময়ে একটি নতুন বিষয়। ইসলামে মহামারী থেকে পলায়নের যে আদেশ দেয়া হয়েছে তার ওপর কিয়াস করে এটাকেও জায়েজ বলা উচিত।

তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি পাঁচটি পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন। কোনটাই আমাদের যুগের কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতির সাথে মিল রাখে না। তখনকার পরিবেশ-সমাজ অনুযায়ী যে পদ্ধতি ভালো ছিল, অথবা যা চিকিৎসাশাস্ত্রে লেখা ছিল সে পদ্ধতিই হামদান উল্লেখ করেছেন। পদ্ধতিগুলোতে দেশের মানুষের চেয়ে বাইরের মানুষদের ব্যাপারে অনেক বেশী সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যেন তিনি ধরেই নিয়েছেন যে, মহামারী অন্য দেশ থেকে স্বদেশে আসে। আর দেশীয় লোকদের মধ্য হতে মহামারী আক্রান্ত অথবা সন্দেহভাজনদেরকে নিজ ঘরে অবস্থানের পরামর্শ না দিয়ে, এখানে তিনি কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য পৃথকভাবে বিশাল দুর্গের ভেতর নিরাপদ বাসস্থান তৈরি করার পরিকল্পনা প্রদান করেছেন। এক্ষেত্রে তার যুগে তিনি যা দেখেছেন, অধ্যয়ন করেছেন তার প্রভাব ছিল।

সাথে সাথে তিনি ইস্তাম্বুলের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা পালনের সমালোচনা করেছেন। কারণ তারা ইউরোপীয় চিকিৎসার নিয়ম কানুন না মেনে মন মর্জি মোতাবেক নামমাত্র কোয়ারেন্টাইন পালন করে। তিনি বলেছেন, ‘ইস্তাম্বুল বাসীদের কোয়ারেন্টাইন পালন মানে হল সঙ্গতা কমিয়ে ফেলা। কিন্তু দেদারছে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠে, বাজারে, দোকানে, হাম্মামখানায়, বিনোদনের বিভিন্ন স্পটে।’ গ্রন্থের শেষদিকে লিখেছেন তারও কোয়ারেন্টাইন পালনের সুযোগ এসেছিল দুবার স্পেনে ভ্রমণে যাওয়ার পর। সেখানে তিনি আদর্শ কোয়ারেন্টাইন পালন দেখে এসেছেন। এবং এর উপকারিতাও উপলব্ধি করেছেন।

এই গ্রন্থের উপসংহারে তিনি পাঁচটি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ১. প্রতিটি দেশে কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একজন করে প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হোক। ২. প্রত্যেক দেশের অবস্থা অনুযায়ী তার উপযোগী কোয়ারেন্টাইন বাস্তবায়ন করা হোক। ৩. বিশেষভাবে খিলাফতের রাজধানী ইস্তাম্বুলের দুই পাশে দুইটা কোয়ারেন্টাইন আলয় স্থাপন করা হোক। ৪. এক্ষেত্রে ইউরোপিয়ানদের পরিকল্পনার সহযোগিতা নেয়া হোক, এবং তা জায়েজ। ৫. এই পুস্তকটি রচনার কারণ হলো একদল চরমপন্থীর ভুল ধারণা ভেঙে দেয়া, যারা বলে কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা পালন করা কুফুরী।

মহাপ্রাণ হামদান বিন উসমান খাজা ভেতরে স্বজাতির কুসংস্কার বিদূরণ ও বাইরের উপনিবেশিক শাসনের মোকাবেলা করতে করতে ১৮৪২ সালে ইন্তেকাল করেন। তাকে কবর দেয়া হয় আবু আইয়ুব আনসারীর কবরস্থানে। আল্লাহ তার কবরের উপর রহমতের শিশির বর্ষণ করুন।

~সহায়ক গ্রন্থ:

১. হামদান খাজা, ইতহাফুল মুসান্নিফিন ওয়াল উদাবা বি-মাবাহিছিল ইহতেরাযি আনিল ওবা, প্রকাশ : দারুত তিবাআ আমিরাহ, ১৯৩৩ ঈ.

২. শারিফাহ বিন আফরাজ, হামদান বিন উসমান খাজা : মাসারুহুস সিয়াসিয়‍্যু ওয়া কিতাবাতুহুত তারিখিয়‍্যাতু, এমফিল পত্র, জামিয়া মুহাম্মদ বুদিয়াফ – মসিলা, আলজেরিয়া, শিক্ষাবর্ষ : ২০০৭ – ২০০৮ ঈ.

৩. মুহাম্মদ হামযা মুহাম্মদ সালাহ, আল কাওয়ারিসুত তবিইয়‍্যা ফি বিলাদিশ শাম ওয়া মিসর, এমফিল পত্র, জামিয়া ইসলামিয়া গাজা, শিক্ষাবর্ষ : ২০০৯ ঈ.

৪. হামুদি হুদা, আল আমরায ওয়াল আওবিয়াতু ফিল জাযায়ের আওয়াখিরাল আহদিল উসমানী, ইউনিভার্সিটি অব বুইরা, আলজেরিয়া, শিক্ষাবর্ষ : ২০০৭ – ২০০৮ ঈ.

৫. হাফেজ আহমাদ বিন হাজার আসকালানী, বাজলুল মাউন ফি ফাদলিত তাউন, দারুল আছিমাহ, রিয়াদ

The post মহামারী বিপর্যয়ে সচেতনতা : অষ্টাদশ শতকের হানাফি ফকিহের ব্যাখ্যা appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/3dxphwz

No comments:

Post a Comment