Friday, September 10, 2021

যমুনার জল দেখতে কালো

রাকিবুল হাসান:

ঐতিহ্যের শহর বগুড়া। লাল মরিচ আর দইয়ের জন্যও বিখ্যাত এ শহর। বগুড়া যাচ্ছি শুনলেই অনেকে আবদার করেন, তার জন্য যেন বগুড়ার দই নিয়ে আসি। আমার বড় মামা ছিলেন ডায়বেটিসের রোগী; তিনি দইয়ের আবদার করতেন না। আবদার করতেন লাল মরিচ আর হলুদের। আমি ইতস্তত করতাম। তিনি বলতেন, ‘একদিন বগুড়া যাব। দোকানের জন্য ট্রাকভরে মরিচ আর হলুদ নিয়ে আসবো।’ কিন্তু মামার আর বগুড়া যাওয়া হয়নি। চলে গেছেন ওপারে, আমাদের স্পর্শসীমার বাইরে।

বগুড়ার যমুনার তীরবর্তী উপজেলা সারিয়াকান্দি। এই সারিয়াকান্দিতেই আমার বোনের শ্বশুরবাড়ি। নদী-বিধৌত সারিয়াকান্দির মানুষদের সুখ-দুঃখ একটাই, তা হলো যমুনা। যমুনা নদীর পানির মতই স্বচ্ছ আশেপাশে বসবাস করা মানুষদের মন। এবার বগুড়া গিয়েছি অনেকদিন পর; করোনা আসার পর আর বগুড়া যাওয়া হয়নি। অনেকদিন পর বেড়াতে গেলে আন্টি ছাড়তে চান না। কাজের দোহাই যেন দিতে না পারি, তাই বাসায় ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। গেলে সপ্তাহখানেক থাকি, খাইদাই, ঘুরাঘুরি করি।

একদিন বিকেলে সপরিবারে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য প্রেম যমুনার ঘাট। এখানে দুটি ঘাট আছে। একটি কালিতলা ঘাট ও অপরটি প্রেম যমুনার ঘাট। বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন অনুসারে, ২০০০ সালে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে সারিয়াকান্দির এই কালিতলা, দীঘলকান্দি (প্রেম যমুনার ঘাট) ও দেবডাঙ্গায় পানি উন্নয়ন বোর্ড ৫৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনা নদীর ডান তীর রক্ষার্থে গ্রোয়েন বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এই গ্রোয়েন বাধগুলোর জন্য যমুনা নদীর ভাঙ্গনের কবল থেকে সারিয়াকান্দি রক্ষা পেয়েছে। সেই সঙ্গে পর্যটককেন্দ্রে রুপান্তরিত হয়েছে এই বাঁধগুলো। ঈদে-পার্বণে এই ঘাটগুলো দর্শনার্থীদের ভীড়ে গমগম করে।

বর্ষায় প্রেম যমুনার ঘাট সবচে সুন্দর লাগে। ঘাটের সিঁড়িতে সারি করে বাঁধা থাকে নৌকা। দূরে সবুজাভ চর। সূর্য ডুবতে থাকলে সেই সবুজ ঘন হতে হতে কালো হয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। খানিক পর চাঁদের আলোয় আবার জেগে উঠে। যমুনার জলে চাঁদের ছায়া পড়ে। যমুনা হেসে উঠে। মনে হয় যমুনা কোনো যুবতী মেয়ে; সর্বাঙ্গে তার সৌন্দর্যের মহিমা।

এখন বর্ষা। ঘাটে অটো এসে থামতেই ছোট্ট এক বালক এসে বললো, ‘নৌকায় ঘুরবেন? ভালো নৌকা আছে।’ আমরা বললাম, ‘আগে কিছুক্ষণ ঘাটে আড্ডা দেই, তারপর নৌকা।’ বালক আমাদের পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করতে লাগলো। একটু পরপর এসে বলছে, ‘চলেন না। এই বিকেলে নৌকায় ভাসতে ভালো লাগবে। খুব ভালো নৌকা।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি ড্রাইভার?’ সে মুচকি হাসলো। আশপাশে থাকা কয়েকজন ড্রাইভার বললো, ‘সে এই ঘাটের সবচে বড় ড্রাইভার।’ বালক বোধহয় লজ্জা পেলো। আমাদের ফটোসেশান শেষ হলে সিদ্ধান্ত নিলাম, ছাদখোলা ট্রলারে করে প্রেম যমুনার ঘাট থেকে কালিতলা ঘাটে যাব। তখন সন্ধ্যা নামছে। বালকটি আমাদেরকে নৌকায় তুলে দিয়ে নেমে গেলো। নৌকা ছেড়ে দিল যমুনায়। তখন বুঝতে পারলাম, বালকটি মূলত এখানে পর্যটকদের নৌকায় ঘুরতে উৎসাহিত করে। এর বিনিময়ে সে প্রতিদিন কিছু টাকা পায়।

যমুনার বুকে ভেসে চলছে আমাদের ট্রলার। এখানকার ভাষায় নৌকা। নৌকা যাচ্ছে চরের পাশঘেঁষে। চরে কাশফুল ফুটে আছে। বাতাসে দুলছে। যমুনার বুকে ভাসতে ভাসতে দেখলাম সূর্য ডোবার দৃশ্য। সূর্যের হলুদ আলোয় পুরো যমুনার জল হলুদাভ হয়ে গেছে। আমার মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘হৃদয়-যমুনা।’ তিনি লিখেছেন, ‘যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ, এস ওগো এস, মোর
হৃদয়-নীরে/তলতল ছলছল/কাঁদিবে গভীর জল/ওই দুটি সুকোমল/চরণ ঘিরে/আজি বর্ষা গাঢ়তম;/নিবিড় কুন্তল সম/মেঘ নামিয়াছে মম/দুইটি তীরে/ওই যে শবদ চিনি/নুপুর রিনিকিঝিনি/কে গো তুমি একাকিনী/আসিছ ধীরে!

বগুড়ায় এলে মাগরিবের পর এই কালিতলা ঘাটে বসে থাকি। যমুনার জল ছুঁয়ে আসা উদ্দাম বাতাসে মনে হয় সব দুঃখ নাই হয়ে যায়। আমি দশটাকার বাদাম কিনি; পা ঝুলিয়ে বসি কালিতলার শানবাঁধানো ঘাটে। সামনে কেবল অথৈ জল, সমুদ্রের গর্জন। কোনো বসতি নেই; দূরে কোথাও দেখা যায় না চর। বিশাল এই যমুনার সামনে বসে তখন নিজেকে খুব ছোট্ট মনে হয়।

কালিতলা ঘাট কেন্দ্র করেও জমে উঠেছে পর্যটকদের আনাগোনা। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দোকানপাট, খাবারের দোকান। একটি পর্যটনকেন্দ্র কেবল সৌন্দর্য বাড়ায় না, বাড়ায় কর্মসংস্থানও। এই কালিতলা ঘাটে খেলনা বিক্রি করেও অনেকে সংসার চালাচ্ছেন। এই ঘাটে জম্পেশ একটা চা পাওয়া যায়। চায়ের জন্য ঘাট থেকে একটু ভেতরে যেতে হয়। হাসিব ভাই খাইয়েছিলেন একবার। সন্ধ্যা নেমে গেছে। সঙ্গে বাচ্চা-শিশুও রয়েছে। তাই চা খাওয়ার ফুরসত হয়নি। খেলনা কিনে, ফুচকা খেয়ে ফিরতে হলো।

বোনের ননদের শ্বশুরবাড়ি যমুনার মধ্যখানে এক চরে। চরের নাম—চরঘাগুয়া। কালিতলা ঘাট থেকে যমুনার মধ্যখান দিয়ে ট্রলারে যেতে পৌনে একঘণ্টা লাগে। সেই চরে গেছি তিন বছর হয়ে গেছে। আবার সেই চরের উদ্দেশ্যে যমুনায় নৌকা ভাসালাম একদিন। যমুনার মধ্যখানে গিয়ে মনে হলো, চারদিকে শুধু জল আর জল। বসতি থেকে অনেক দূরে; নৌকা ডুবে গেলে বেঁচে থাকবার মতো কোনো আশ্রয়ও পাওয়া যাবে না। চরঘাগুয়া তখনো পৌঁছিনি। আরও দেড় দুই কিলোমিটার বাকি। আপু বললেন, ‘আজ থেকে দশ বছর আগে যখন আমার বিয়ে হয়, তখন এখানেও বসতি ছিল।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এখানে তো পানি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। পাড় তো আরও অনেক দূরে।’ আপু বললেন, ‘সব নদীর গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে।’ আমি যেন কল্পনায় দেখতে পেলাম, কোলাহলমুখর এক বসতি। সকালে কায়দা হাতে মক্তবে যাচ্ছে চরের বালক, মকতব থেকে ফিরে যাচ্ছে স্কুলে। সারাদিন কাজ করে ঘরে ফিরছেন বাবা। কুপি জ্বালিয়ে খেতে বসছেন মা। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, মকতব নেই, স্কুল নেই। সব বিলিন হয়ে গেছে নদীর গর্ভে। বাড়িটাও যাবে। তারা বাড়ি ছেড়ে ছুটে চলছেন অজানা কোনো গন্তব্যে।

গতবার যখন এসেছিলাম, চরে বিদ্যুৎ ছিল না। সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে চলত সব। মোবাইলে নেট পাওয়া যেতো না। এবার এসে দেখি অনেককিছুই বদলে গেছে। কুরবানির ঈদের আগে বিদ্যুৎ এসেছে। বিদ্যুৎ আনার ব্যবস্থা করেছে বোনের ননদ-জামাই সোহেল ভাই৷ তিনি বগুড়ার এক আলিয়া মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলেন কয়েকমাস আগে। বিদ্যুৎ এসেছে, এসেছে মোবাইলের নেটওয়ার্কও। এখন ফোরজি নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় অনায়াসেই। ওই চরে বসে ফাতেহের নিউজ আপ দিতে কোনো সমস্যাই হয়নি।

চরঘাগুয়ার বয়স শতবর্ষের বেশি। তবে নদীভাঙন থেমে নেই। ভাঙতে ভাঙতে এখন আপুদের বাড়ির কাছেই চলে এসেছে। আপুরা সারিয়াকান্দিতেও বাড়ি করছেন, ছাদ ঢালাই হয়ে গেছে। কিন্তু অনেক মানুষ নদীভাঙনের ভয়ে তটস্থ। তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে বলে, আল্লাহ ভরসা৷ কপালে যা আছে, তাই হবে। আপু চরের এক স্কুলের হেডমাস্টার। স্কুলটি কয়েকবছর আগে সরকারি হয়েছে। সেই সারিয়াকান্দি থেকে আপু ক্লাস করানোর জন্য যমুনা পাড়ি দিয়ে এখানে আসেন৷ তার শ্বশুর-শাশুরি চরেই থাকেন।

বাইকে করে আমাকে ঘুরতে নিয়ে গেলেন সোহেল ভাইয়ের ছোট ভাই সুমন ভাই। চরের কাঁচা পথ, এবড়োথেবড়ো। কিন্তু তিনি যেভাবে বাইক চালাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিলো এসব খনাখন্দ কোনো ব্যাপারই না। তাকে বললাম, শহরের কোনো উবারচালককে যদি তিনগুন টাকা দেয়া হয়, তবুও তারা এই পথে বাইক চালাতে পারবে না। নির্ঘাত এক্সিডেন্ট করবে। সুমন ভাই বললেন, ‘বাইকটা দশ হাজার টাকায় কিনেছি। বাজারে ইলেকট্রনিকসের দোকান আছে। মালামাল বাইকে করেই আনি। টাকা কম খরচ হয়। দান কম হলেও সার্ভিস দিচ্ছে বেশ ভালো।’

চরে জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন কৃষি কাজ। বাইক চালাতে চালাতে সুমন ভাই বললেন, ‘সবচে বেশি আয় পাটে। যেমন আমরা যতটুকু পাট করেছি, তাতে মজদুরদের মাইনেসহ খরচ হয়েছে এক লাখ টাকা। আমরা সেই পাটের এক তৃতীয়াংশ বিক্রি করেই খরচ তুলে ফেলেছি। বাকিটুকু লাভ। সারাবছর পাট বিক্রি করব। পাটের বাজার খুব ভালো।’

বাইকে যেতে যেতে দেখলাম—প্রায় সবাই পাট করেছে। রাস্তার পাশে পাট শুকানো হচ্ছে। কেউ শোলা থেকে পাট আলাদা করছে। সব জায়গায় পাটের গন্ধ। দেখলাম ঘোড়ার আস্তাবল। ঘোড়া কয়েকটা ঘাস খাচ্ছে। সুমন ভাইকে বললাম, ঘোড়া দিয়ে কী করে? তিনি বললেন, ‘ঘোড়ার গাড়িতে করে ধান, পাট ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিস আনা নেওয়া করা হয়। যেহেতু পাকা পথ নেই, ট্রাক নেই, ঘোড়ার গাড়িতেই কাজ চালিয়ে নিতে হয়।’

পুরো দেশে বর্ষা হলেও চরে বর্ষার কিছুই বুঝা যায় না। তাদের কাছে সারাবছরই বর্ষা। তাদের জমিতে পানি উঠে না। চরে দু ধরণের ধান হয়। এক—কাতারি ধান। দুই—উনচল্লিশ ধান। সুমন ভাই বললেন, ‘বন্যার পর উনচল্লিশ ধানের ফলন বেশ ভালো হয়। এবং এই ধান গাছ বন্যার পানিতে মরে না। যত পানিই হোক। তাই চরে এ ধানের ফলন বেশি করে সবাই। চালটা হয় খুচ চিকন।’

বাইকে করে আমরা চলে এলাম বেড়াপাঁচবাড়িয়া ঘাট। আগে যখন এসেছিলাম, এখানে কিছুই ছিল না। এ ঘাট যমুনা লাগোয়া। এখন এসে দেখি এখানে একটি ফেরি দিয়েছে নৌ কর্তৃপক্ষ। কালিতলা ঘাট থেকে বেড়াপাঁচবাড়িয়া ঘাট ফেরির যাতায়াত। ঘাটে অনেক ট্রলার। পাড়ে অনেক দোকান। পাড় যেন না ভেঙে যায়, তাই পাথর দিয়ে তৈরী করা হয়েছে ঘাট। বাঁধানে হয়েছে পাড়। সুমন ভাই ইঙ্গিত করে একটি স্কুল দেখালেন ঘাট থেকে বিশ-পঁচিশ গজ দূরে। বললেন, ‘আমি এই স্কুল থেকে ফাইভে বৃত্তি পেয়েছি। এটাই ছিল এ স্কুলের প্রথম বৃত্তি। এইযে ঘাট দেখছেন, তখন এটা ছিল বিশাল বসতি। স্কুল গমগম করতো ছাত্র-শিক্ষকে। কিন্তু নদী সব কেড়ে নিয়েছে। বসতি নিঃশেষ হয়েছে, স্কুল পরিত্যক্ত হয়েছে। এখন তো কোনো বসতি দেখছেন না।’

চরে দুধরণের জমি হয়। এক—খাস জমি। যে জমিগুলো কিনে নেয়া হয়। দুই—দখলি জমি। সুমন ভাই বললেন, ‘আমাদের অধিকাংশ জমি খাস জমি। আমার দাদা ছিলেন পড়ুয়া লোক। তিনি ছিলেন আমিন। জায়গা-জমির বিষয় তার নখদর্পণপ। তখন তিনি অনেক খাস জমি করে নিয়েছিলেন।’

চরের বাজার এবং দোকানগুলোর দিকে তাকালে চরের অর্থনৈতিক জরিপ বুঝা যায়। এতবড় দোকান, ফ্রিজ আছে, কিন্তু এক লিটারের কোনো পানীয় নেই। জিজ্ঞেস করায় দোকানী বললেন, ‘এক লিটার দুই লিটার পানীয় কয়জন কিনবে? ২৫০ মিলির পানীয় বেশি চলে।’ বাজারেও একই অবস্থা। দামী কোনো জিনিসের দোকান পাওয়া যায় না। পাঁচবাড়িয়া ঘাটে কোনো দোকানে ফ্রিজ নেই। অথচ এটা ফেরিঘাট।

বিকেলে যখন ফিরছি, যমুনার জোয়ারে শুকনো ভূমি অনেকখানি ডুবে গেছে। নৌকা আমাদের আরও দূরে। অগত্যা হাঁটুপানি ভেঙে নৌকার কাছে আসতে হলো। আবার ভাসলাম যমুনার বুকে। যমুনা বারবার রাক্ষসী থাবা বসিয়েছে এই চরে। তবুও চরের মানুষদের যমুনার মন বুঝেই চলতে হয়। অভিমান করে লাভ হয় না। কত সমাজ, কত সংসার ভেঙে দিল এই যমুনা! তবুও যমুনা কবি-লেখকদের যতটা সমাদর পেয়েছে, আর কোনো নদী তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। যমুনাকে নিয়ে গান বেঁধেছে অনেক বাউল, কবিতা লিখেছে অনেক কবি। যমুনায় ভাসতে ভাসতে, ট্রলারের পেডেলে হাত রেখে মাঝি গান ধরলো:

আমার যমুনার জল দেখতে কালো,
চান করিতে লাগে ভালো
যৌবন মিশিয়া গেলো জলে;

 

The post যমুনার জল দেখতে কালো appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/3z0QWiP

No comments:

Post a Comment