Thursday, July 7, 2022

চামড়া-সিন্ডিকেট : সরকার কী করতে পারে?

রাকিবুল হাসান নাঈম:

কয়েক বছর ধরে কোরবানির পশুর চামড়া বিপনন ও সংরক্ষণ নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। চামড়ার দাম পড়ে গেছে কল্পনাতীত। অথচ অর্থমূল্য বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া শীর্ষ পাঁচ পণ্যের একটি হলো চামড়া। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের ১২ মাসে অর্থাৎ জুলাই-জুনের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়েছে ১২৪ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। এর আগের অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার ডলারের। এ হিসেবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বেড়েছে ৩২ দশমিক ২৩ শতাংশ। রফতানি বাড়লেও দেশে চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার জন্য এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। তবে গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার মারাত্মক দরপতনের জন্য সরকারকেও দোষারোপ করছেন অনেকে। সংশ্লিষ্টগণ জানিয়েছেন, সরকার আরেকটু উদ্যোগী হলে চামড়ার বাজারে উন্নতি ঘটবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চামড়া  খাতটি দেখভালের জন্য নেই কোনো মন্ত্রণালয়, দপ্তর কিংবা বোর্ড। অথচ ক্ষুদ্রতম খাত রেশম উন্নয়নে পৃথক বোর্ড আছে, তুলা উন্নয়নেও আছে। ফলে খাতটির উন্নয়ন দেখভালের দায়িত্ব যেমন সরকারের কোনো সংস্থার হাতে নেই, দীর্ঘদিনের খেয়াল-খুশিতে এ খাতে গড়ে ওঠা ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙারও কোনো উদ্যোগ নেই। এর খেসারত গুনতে হচ্ছে কোরবানির চামড়ার হকদার এতিম-দুখীদের, সংকোচিত হচ্ছে রপ্তানি সম্ভাবনা। প্রতিবছর ঈদুল আজহার দিন কয়েক আগে কোরবানির পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে রপ্তানির বিপরীতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তার ব্যবস্থা করা ছাড়া এ শিল্পে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যত কোনো কাজ নেই। ট্যানারি শিল্প শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও ট্যানারি পল্লী স্থাপনে প্রকল্প নেওয়া ছাড়া এ মন্ত্রণালয়ও খাতটির জন্য কিছু করেনি।

আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন নেই

চামড়ার দরপতনের পেছনে সরকারকে দায়ি করেন ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারী মো. সাখাওয়াতুল্লাহ। ফাতেহকে তিনি বলেন, ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের কারণে এ শিল্পের উৎপাদন ও রপ্তানি দুটোই কমেছে। স্থানান্তরের সময় অনেকগুলো ট্যানারি বন্ধ করে দেয়া হয়। তখনই চামড়ার বাজার পড়ে যায়। এর আগে কখনো বাজার পড়েনি। ২০১৮-১৯ সালে সংকট কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করেছি, পারিনি। ২০২০ সাল গেলো করোনায়। ২০২১-২২ সালে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আবার সমস্যায় ফেলে দিল। কিন্তু সব ঠিক থাকলে, বাধা সরাতে পারলে, আমরা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারব।’

বাধাটা কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাভারে যে ট্যানারি পল্লী করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মানের নয়। ট্যানারি পল্লীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন নেই। ২০০৩ সালে প্রকল্প নিয়ে গত ১৬ বছরে প্রকল্পের আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত না করেই হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের কারণে এ শিল্পের উৎপাদন ও রপ্তানি দুটোই কমেছে। সিইটিপির সার্টিফিকেশন না থাকায় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ধনী দেশগুলোর ক্রেতারা বাংলাদেশি প্রক্রিয়াজাত চামড়ার কোনো পণ্য নিতে আগ্রহী নয়।’

তবে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা সরকারও করছে বলে জানিয়েছেন ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের এই নেতা। তিনি বলেন, সরকারকে আমরাও সাহায্য করছি।

মধ্যস্বত্বভোগী সমস্যা

চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার পেছনে মধ্যস্বত্বভোগীদের দায়ী করেছেন ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ। তিনি ফাতেহকে বলেন, মধ্যস্বত্বভোগী না থাকলে গরিবরা বঞ্চিত হবে না। চামড়ার বাজার আবদ্ধ মওসুমি ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের হাতে। তাদের হাত পেরিয়ে আমাদের হাতে আসে। আমরা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি দিয়ে কখনও চামড়া কিনি। দাম যা কমার কমায় মওসুমি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা।’

চামড়ার বাজারের এই অবনতি ঠেকাতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে বলে জানান তিনি । সমাধান হিসেবে ফাতেহকে তিনি বলেন, এই অবনতি ঠেকানোর একটাই উপায়, চামড়া সরাসরি ট্যানারী মালিকদের হাতে তুলে দিতে হবে। মালিকরা তো সরাসরি চামড়া কালেকশন করবে না। সেজন্য থানা ও জেলায় চামড়া সংরক্ষাণাগার তৈরী করতে হবে। সেখান থেকে ট্যানারি মালিকরা সংগ্রহ করবে।

চামড়া রফতানি

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালে একবার চামড়া শিল্পের উন্নয়নের কথা ঘোষণা করেন। তখন তিনি বলেন, ক্রাস্ট লেদার ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়ানো হবে। এজন্য কাঁচা চামড়া ও ওয়েট ব্লু (লোম ছাড়ানো চামড়া) রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হবে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ক্রাস্ট লেদার ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া ছাড়াই শুধু জিয়াউর রহমানের ঘোষণার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কাঁচা চামড়া রপ্তানি নিষিদ্ধ করে দেয়। তখন থেকেই চামড়া খাত পুরোপুরি ট্যানারি মালিকদের তালুবন্দি হয়ে পড়ে।

সাভারে যে ট্যানারি পল্লী করা হয়েছে,  তাতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন না থাকার কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ধনী দেশগুলোর ক্রেতারা বাংলাদেশি প্রক্রিয়াজাত চামড়ার কোনো পণ্য নিতে আগ্রহী নয়। এ কারণে এপেক্স, বে, ওরিয়নসহ যেসব বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে জুতাসহ চামড়াজাত বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে, তারা অন্য দেশ থেকে চামড়া আমদানি করে তা দিয়ে পণ্য তৈরির পর রপ্তানি করছে। চামড়ার রফতানি ফেরাতে ২০১৭ সালে বর্তমান সরকার ওয়েট ব্লু (লোম ছাড়ানো চামড়া) রপ্তানির অনুমতি দেয়। উক্ত বছর সরকার চামড়াকে ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’  বলেও ঘোষণা করে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রক দপ্তরের নিয়ন্ত্রক জনাব মো. মাকসুদুল মান্নান ফাতেহকে বলেন, চামড়া রপ্তানির অনুমতি তিন-চার বছর আগেই দেয়া হয়েছে। এবারও সেটা বলবৎ থাকবে। যেহেতু চামড়ার দাম একদম পড়ে গেছে, আমরা সেটার উন্নয়ন প্রকল্পে রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছি।’

শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (বিসিক) মোস্তাক আহমেদ ফাতেহকে বলেন, কাঁচা চামড়া রফতানি নিষিদ্ধ। কিন্তু ওয়েট ব্লু (লোম ছাড়ানো চামড়া) রপ্তানির অনুমতি আছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ বছরও অনুমতি দিবে।

এবার ঈদে সরকার কী করছে

সাধারণত ট্যানারি শিল্প শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টগণ বলছেন, চামড়া যথাযথ সংরক্ষণ না করার কারণেই মূলত চামড়ার বাজারদর পড়ে যায়। তাই তারা চামড়া সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব  (বিসিক) কাজী সাখাওয়াত হোসাইন ফাতেহকে বলেন, ‘চামড়াটা যেন নষ্ট না হয়, দামটা যেন সবাই ঠিকঠাক পায়, তাই এবার কয়েকটি বিষয়ে আমরা জোর দিচ্ছি। এক—আমরা ইজারাদারদের বলব, প্রতিটি পশুর হাটের পাশে যেন সুলভ মূল্যে লবন বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। দুই—মওসুমী ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করব, তারা যেন অস্থায়ী কাঁচা চামড়া সংরক্ষণাগার তৈরী করে। স্থানীয় প্রশাসনকেও অনুরোধ করব, তাদেরকে সহযোগিতা করতে এবং উদ্বুদ্ধ করতে৷ কারণ, মওসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়াটা কিনতে দেরী করে। ফলে চামড়াটা নষ্ট হবার উপক্রম হয়ে যায়। এই চামড়াটা যখন তারা আড়তে নিয়ে যায়, প্রায় নষ্ট চামড়া দেখে তারা কম দামে কিনতে চান। এভাবেই একটা সিন্ডিকেট গড়ে উঠে অঘোষিতভাবেই। তাই মওসুমী ব্যবসায়ীরা যদি লবন দিয়ে সংরক্ষণ করে, তারাও দামটা ভালো পাবে। ব্যক্তিপর্যায়েও আমরা এবার উৎসাহিত করব। সবাই তো ত্যাগের জন্যই কুরবানি দেয়। ৮০-৯০ হাজার টাকায় পশু কিনে। সঙ্গে যদি তারা কয়েক কেজি লবন কিনে নিজেরাই চামড়াটা সংরক্ষণ করে, তাহলে চামড়াটা নষ্ট হলো না। মওসুমি ব্যবসায়ীরা লবন দেয়া চামড়াটা কিনবে তাদের থেকে। নয়ত একদিনে পুরা দেশের চামড়া কেনা তো সম্ভব না। পাশাপাশি এবার আমরা টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে কাঁচা চামড়ায় লবন দিয়ে সংরক্ষণ করতে উৎসাহিত করবো।’

শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (বিসিক) মোস্তাক আহমেদ ফাতেহকে বলেন, ‘এবার আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঈদের ১৫ দিনের মধ্যে ঢাকার বাইরের কোনো চামড়া ঢাকায় ঢুকবে না। এই ১৫ দিন কেবল ঢাকার ভেতরের চামড়াগুলো প্রসেস করা হবে। বাইরে যারা আছে, তারা লবন দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করবে। এজন্য আমরা কয়েকটি ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রথমত, লবনের সংকট কাটাতে জেলা-উপজেলা, থানা-ইউনিয়নে লবনের ডিলার নিয়োগ দিয়েছি। দাম একটু বাড়বে। গত বছর হয়তো ১০ টাকা কেজি ছিল, এবার হয়তো ১৩ টাকা থাকবে। কিন্তু লবনের সংকট হবে না। মওসুমি ব্যবসায়ী এবং যারা কুরাবানি দিবে, তারাও যেন চামড়াটা লবন দিয়ে রাখে, এই অনুরোধ করব এবং মানুষকে উৎসাহিত করব। আর জেলা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তারা যেন থানা-ইউনিয়নে অস্থায়ী সংরক্ষাণাগার তৈরী করে। যেখানে যতটা প্রয়োজন।

চামড়া সংরক্ষণের ব্যাপারে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারী মো. সাখাওয়াতুল্লাহ বলেন, ‘এখন গরমের কাল। যারা মওসুমি ব্যবসায়ী, তারা সন্ধ্যা ৭-৮ টার মধ্যে যেন চামড়া সংরক্ষণ করেন এবং রাত ১২ টার মধ্যে চামড়ায় লবন লাগান। এটা না করাতে চামড়া নষ্ট হয়। প্রতি বছর ৪০ শতাংশ চামড়ার গুণগত মান নষ্ট হয় সময়মত লবন না দেয়ার কারণে।

উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২০৬টি ট্যানারি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে ১১৪টি স্থানীয় মানদণ্ড অনুযায়ী বৃহৎ ও মাঝারি আকারের এবং শিল্প অধিদপ্তরে তালিকাভুক্ত। বাকি ইউনিটগুলো ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পর্যায়ের এবং সরকারিভাবে নিবন্ধিত নয়।

The post চামড়া-সিন্ডিকেট : সরকার কী করতে পারে? appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/k2FQqR1

No comments:

Post a Comment