Friday, July 15, 2022

প্রাকৃতিক বিপর্যয় : যেভাবে পাশে দাঁড়াচ্ছে ধর্মীয় সমাজ

ইবনে আবেদীন:

২০২০ সালে করোনার প্রকোপে যখন সারাবিশ্ব থমকে দাঁড়ালো, কলকারখানা, অফিসসহ সকল কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেলো, বাংলাদেশে তখন সবচেয়ে কঠিন সময় পাড় করছিলেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। অপরদিকে কোভিড–১৯ কে একটি সংক্রামক ভাইরাস হিসেবে ঘোষণা করায় মানবতাও যেন হারিয়ে গেয়েছিল অচিনপুরে! সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে অসুস্থ স্বামীকে ছেড়ে স্ত্রীর বাপের বাড়ি চলে যাওয়া, বৃদ্ধ মাকে রাস্তায় ফেলে সন্তানদের পালিয়ে যাওয়ার মতো নির্মম ঘটনাগুলো ঘটতে ছিল। কোনো মানুষ মারা গেলে তার দাফন-কাফন তো দূরের কথা একান্ত স্বজনেরাও তার লাশ ছেড়ে পালাতে মরিয়া ছিল। ঠিক মানবতার এই চরম সংকটকালে ভাগ্যাহত জীবিত ও মৃত মানুষের পাশে উদার মানবতা ও বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে যারা দাঁড়িয়েছিলেন, তারা হলেন এদেশের আলেম সমাজ, আপামর ধর্মীয় সমাজ।

লকডাউনের সময়টাতে সবার মত আলেমদের কর্মসংস্থানও বন্ধ থাকায় তারাও অনেক সংকটে ছিলেন। কিন্তু এই সংকট আর্ত মানবতার পাশে দাঁড়াতে তাঁদের বাঁধা হতে পারেনি। নিজের যতটুকু আছে তা নিয়েই এগিয়ে গিয়েছিলেন আরেক ভাইয়ের সাহায্যে। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন স্বজনদের ফেলে রাখা লাশের কাফন-দাফনে। কিন্তু মিডিয়া বরাবরের মতোই আলেমদের এসব অবদান থেকে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। বরং নানাভাবে আলেমদের উত্যক্ত করে আসছিল। নানুপুর পীর সাহেবের ছেলেরা যখন তাদের ওয়েলফেয়ার সংগঠন আল মানাহিলের ব্যানারে চট্টগ্রামে পাঁচ শ শয্যার করোনা হাসপাতাল করে মানুষকে সেবা দিচ্ছিলেন, মিডিয়া তখন তুলকালাম করছিল কোন হুজুরের জানাযায় কারা অংশগ্রহণ করে করোনা বাড়ালো তা নিয়ে। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে আপনজনদের ফেলে রাখা লাশগুলোকে যখন ইসলামী আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবকগণ সম্মানের সাথে কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করছিলেন, মিডিয়া তখন ব্যস্ত ছিল কোন আলেমের কত টাকা আছ তার অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরিতে। আসলে আলেম সমাজ নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করেন না। মানবতার সেবা করে প্রচার চান না। যশ-খ্যাতিও কামনা করেন না। যা করেন আল্লাহর জন্যই করেন। আল্লাহর কাছেই তাঁদের প্রাপ্য।

এবারের সীতাকুণ্ড দূর্ঘটনা ও সিলেটের ভয়াবহ বন্যায়ও বরাবরের মতোই এগিয়ে ছিলেন আলেম সমাজ। মিডিয়া আগের মতো এবারও প্রচার না করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে দেশবাসী দেখেছেন আলেমদের স্বেচ্ছাসেবা ও ত্রাণ বিতরণের দৃশ্য। সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপো বিস্ফোরণে আহত-নিহতদের উদ্ধারকার্যের সহযোগিতায় সবচেয়ে তৎপর দেখা গেছে আলেমদের, বিশেষত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কর্মীদের।

দেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কুড়িগ্রামে আকস্মিক ও ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে বন্যার্ত মানুষের জন্য যারা কাজ করেছে তাদের ভেতর আলেমসমাজের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। সংকটের প্রথম দিন থেকে তাঁরা মাঠে থেকে কাজ করছেন। এখন অবধি কাজ করে যাচ্ছেন। এখানে সে সময়ে প্রকাশিত কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্ট অনুসারে আলেমদের পরিচালিত ও নেতৃত্বাধীন কিছু সংগঠন ও সংস্থার ত্রাণ তৎপরতা তুলে ধরা হলো—

আস সুন্নাহ ট্রাস্ট : গত ২৪ জুন পর্যন্ত সুনামগঞ্জে প্রায় ১০০ টন ত্রাণ পাঠিয়েছেন শায়খ আহমদুল্লাহ। তিনি নিজে সুনামগঞ্জের দুর্গম হাওর অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের ক্রয়কৃত ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে ছিল চাল, ডাল, লবণ, সয়াবিন তেল, খেজুর, হলুদ-মরিচের প্যাকেট, চিড়া, শিশুখাদ্য, ছাতু, ওষুধ ইত্যাদি। সুনামগঞ্জ ছাড়াও তিনি সিলেট সহ বন্যা কবলিত অন্যান্য অঞ্চলেও ত্রাণ পাঠিয়েছেন। এবারের কুরবানির ঈদে ‘সবার জন্য কুরবানী’ শিরোনামে দেশব্যাপী ১০০ গরু ও শতাধিক ছাগল কুরবানি করে দরিদ্রদের মাঝে গোশত বিতরণ করেছেন।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ : প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা বিপর্যয়ে জনসেবা করে এরই মধ্যে সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সিলেট বিভাগে বন্যা শুরু হওয়ার একদম শুরু থেকে বানভাসি মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে তারা। মূল দলের কেন্দ্রীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে একযোগে কাজ করেছে দলটির ছাত্র ও যুব সংগঠনসহ সব সহযোগী ও অঙ্গসংগঠন। গত ২৪ জুন দৈনিক কালের কণ্ঠ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমানের দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে আমরা জানতে পারি, তিনি বলেন, ‘দলের আমির ও নায়েবে আমিরের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় আমরা প্রথম দিন থেকে কাজ করছি। দলের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম গত ২১ জুন নিজে ত্রাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছিলেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘কাজের ক্ষেত্রে আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। কেননা এসব অঞ্চলে সহজে ত্রাণ পৌঁছায় না। আমাদের সহায়তার মধ্যে শুকনা ও প্রস্তুত উভয় প্রকার খাবার আছে। ত্রাণসামগ্রী প্রক্রিয়াজাত করতে আমরা সিলেট শহরে দুটি এবং সুনামগঞ্জে একটি পয়েন্ট নির্ধারণ করেছি। বন্যার পানি যেসব এলাকায় নেমে গেছে সেখানে আমরা পুনর্বাসনে সহযোগিতা করছি। মানুষের ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ, বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা ইত্যাদি কাজে সাহায্য করছি। বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তাই আমরা একটি মেডিক্যাল টিমও গঠন করেছি, যারা বন্যাদুর্গত এলাকায় চিকিৎসাসেবা দেবে।’ সিলেট সুনামগঞ্জের বাইরে নেত্রকোনা, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামেও ইসলামী আন্দোলন ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে বলে জানান মাওলানা গাজী আতাউর রহমান।

পিসব : বন্যাদুর্গত এলাকায় পিপলস্ ইমপ্রুভমেন্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ (পিসব) ১৯ মে ২০২২ থেকে ধারাবাহিক কাজ করে যাচ্ছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জে এখন পর্যন্ত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সাত হাজার পাঁচ শ পরিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সিলেট ও সুনামগঞ্জের দুই শতাধিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে মাছ ধরার বিভিন্ন ধরনের জাল, হাঁড়িপাতিল, টিন এবং দুই হাজার মানুষের মাঝে পুষ্টিকর প্রস্তুত খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম, জামালপুর, কিশোরগঞ্জে এক হাজার ৫০০ পরিবারকে ১৬ কেজি করে খাদ্য ও ওষুধ বিতরণ কার্যক্রম চলছে। বন্যা-পরবর্তী স্যানিটেশন, টিউবওয়েল, গৃহ সংস্কার, নৌকা, জাল বিতরণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। ওই প্রকল্প পরিচালনা করছেন মাওলানা ইমরান হুসাইন হাবিবী ও তাঁর সঙ্গীরা।

খেলাফত মজলিস : সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার পরিবারের কাছে সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে খেলাফত মজলিস। বানভাসি মানুষকে সহযোগিতা করতে সিলেট জেলা ছাত্র মজলিসের পাঁচটি স্বেচ্ছাসেবক দল ও জেলা খেলাফত মজলিসের ১০টি স্বেচ্ছাসেবক দল একযোগে কাজ করেছে। তাদের সহযোগিতার মধ্যে আছে শুকনা ও প্রস্তুত করা খাবার। সিলেট বিভাগের বাইরে কুড়িগ্রামেও একটি কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দল কাজ করেছে। দলের কেন্দ্রীয় সহপ্রচার সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুল হাফিজ খসরু জানান, খেলাফত মজলিস কেন্দ্রীয়ভাবে ফান্ড সংগ্রহ করলেও তাদের দলের সিলেট জেলা শাখার নিজস্ব বাজেট এক কোটি টাকা। বন্যার পানি নেমে গেলে তাদের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হবে।

জামায়াতে ইসলামী : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও বন্যার্ত মানুষদের সহযোগিতায় উদারভাবে হস্তপ্রসার করেছে। তারা বড় অংকের বাজেট নিয়ে বিপর্যস্ত অঞ্চলগুলোতে ত্রাণ বিতরণ করেছেন ও করে আসছেন। সিলেটে বন্যাগ্রস্ত লোকদের মাঝে উপস্থিত হয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান নিজে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের ত্রাণ কার্যক্রম চালু রয়েছে।

সিয়ানাহ ট্রাস্ট : একটি গবেষণাধর্মী ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন হলেও জনসেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে সিলেটের সিয়ানাহ ট্রাস্ট। সিলেট বিভাগে যখন প্রথম ধাপে বন্যা শুরু হয়, তখন থেকেই বন্যার্ত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বলেন জানান ট্রাস্টের পরিচালক মুফতি জিয়াউর রহমান। তিনি জানান, প্রথম ধাপের বন্যায় খাদ্য বিতরণ ও পুনর্বাসনে জন্য ১০ লাখ টাকা বিতরণ করেছিল সিয়ানাহ ট্রাস্ট। দ্বিতীয় ধাপে বন্যা শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ১০ লাখ টাকার খাদ্যসামগ্রী, প্রস্তুত ও শুকনা খাবার বিতরণ করেছে তারা। বন্যা-পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা আছে তাদের। পুনর্বাসন প্রকল্পের জন্য সিয়ানাহ ট্রাস্ট্রের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ লাখ টাকা।

সৃজন ঘর : সিলেটের তরুণ আলেমদের সংগঠন ‘সৃজন ঘর’ও বন্যার্ত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত তারা শতাধিক পরিবারকে নগদ অর্থ দান, কয়েক হাজার পরিবারের মধ্যে খাবার ও বিশুদ্ধ খাবার পানি বিতরণ করেছে। তরুণ এই আলেমরা শুধু নিজেরাই সহযোগিতা করছেন এমন না, বরং বানভাসি মানুষের জন্য কাজ করছে এমন একাধিক সংগঠন ও সংস্থার সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সহযোগিতাও করছেন।

দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা থেকেও ১১টি নৌকাসহ বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়েছে বন্যাগ্রস্ত সিলেটে। এ ছাড়া হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশ, আল মুঈন ত্রাণ তহবিল, আল মানাহিল ফাউন্ডেশন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)
সেবা সংস্থা, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম, (পুরান ঢাকার) ইমাম পরিষদ, ইকরামুল মুসলিমিন ফাউন্ডেশন, সাবউ সানাবিল, তাসমিয়া ট্রাস্ট, বাসমাহ ট্রাস্ট,
আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ, বারাকাহ ইত্যাদি সংগঠন ও সংস্থা বানভাসি মানুষের জন্য কাজ করছে।
সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরেও বহু আলেম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ কর্তৃপক্ষ বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন সাধ্যের সবটুকু নিয়ে। এদেশের আলেম ও ধর্মীয় সমাজের এই ত্যাগ, স্বচ্ছসেবা ও স্বেচ্ছাশ্রম মানবতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে জ্বলজ্বল করবে। আগামী প্রজন্ম এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে। মানবতার সেবায় নিঃস্বার্থভাবে আত্মনিয়োগ করবে। এহেন বাস্তবতায় যে কথাটা স্পষ্ট, ধর্মীয় সমাজের রেখে যাওয়া এই দৃষ্টান্তের একটি ক্ষুদে কণাও ধর্মবিরোধী কারো থেকে আশা করাটা যে আকাশ কুসুম কল্পনা— দেশবাসী তা জেনে গেছে।

সূত্র :
১. কালের কণ্ঠ
২. নয়া দিগন্ত ও
৩. বাংলাভিশন সহ জাতীয় দৈনিক সমূহ

The post প্রাকৃতিক বিপর্যয় : যেভাবে পাশে দাঁড়াচ্ছে ধর্মীয় সমাজ appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/RGxO8AU

No comments:

Post a Comment