Monday, July 19, 2021

টিপু সুলতানের লাইব্রেরি

মুহাম্মদ মাসুম মুনতাসির:

দাক্ষিণাত্যের বিশাল অঞ্চল, আরব সাগরের পশ্চিম তীর এবং বঙ্গোপসাগরের পূর্ব উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত বৃহত্তর দক্ষিণ ভারত। এসব অঞ্চল নিয়েই গড়ে উঠেছে মহীশুর রাজ্য। এ রাজ্যের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসক ছিলেন সুলতান ফতেহ আলী টিপু।

মহীশুরের রাজধানী শ্রীরঙ্গপট্টমের কাবেরী নদীর ব-দ্বীপে নির্মিত শক্তিশালী দুর্গটিই ছিল তাঁর লাল প্রাসাদ। মহীশুরের স্থানীয় কানাড়ী ভাষায় ‘টিপু’ শব্দের অর্থ ‘বাঘ’। বাস্তব জীবনেও তিনি ছিলেন বাঘপ্রিয় এবং বাঘের মতো সাহসী। তার এ শৌর্য-বীর্য এবং সামরিক কুশলতায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ইংরেজরা তাকে ‘শেরে মহীশুর’ খেতাবে ভূষিত করেছিল।

তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের অগ্রনায়ক। ১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক গণজাগরণের অন্যতম উৎস। তিনি ছিলেন আধুনিক প্রযুক্তিবিদ। বিশ্বের প্রথম রণাঙ্গনে রকেট আর্টিলারি এবং সামরিক অস্ত্রের প্রয়োগ তিনিই করেছিলেন।

তিনি শাসনকালে বেশ কয়েকটি প্রশাসনিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন এবং একটি নতুন মুদ্রা ও নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মসনের হিসেবে একটি নতুন চান্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন, যার নামকরণ করেছিলেন মুহাম্মদি বা মাওলূদি সাল। তাছাড়া নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রচলন, রেশম শিল্পের বিকাশ, আধুনিক ও ধর্মীয় শিক্ষা সমন্বয়ে জামিআয়ে ওমর নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও মসজিদভিত্তিক মক্তব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ তাঁরই অনন্য কীর্তি।

এসব তো তাঁর স্বীকৃত পরিচয়, কিন্তু আজ তুলে ধরতে চাই তাঁর অনালোচিত এক বিশেষ পরিচয়। টিপু সুলতান শুধু একজন সৃজনশীল যোদ্ধা বা শাসক ছিলেন না, ছিলেন লেখক ও জ্ঞানানুরাগী। বই পড়া এবং দুর্লভ বই সংগ্রহের প্রতি তাঁর শখ ও জোঁক ছিল ভীষণ। তাই রাজ্য পরিচালনার পাশাপাশি তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক সুবিশাল গ্রন্থাগার। সাজিয়ে তুলেছিলেন এক সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। এর বড় একটা অংশ তিনি পৈতৃক সূত্রে পেয়েছিলেন।

প্রাচ্যবিদ চার্লস স্টুয়ার্ট ১৮০৯ সালে রচিত তার ‘আ ডেসক্রিপটিভ ক্যাটালগ অব দ্য ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরি অব দ্য লেট টিপু সুলতান’-এ উল্লেখ করেন, টিপু সুলতানের এ সমৃদ্ধ লাইব্রেরিতে আনুমানিক দুই হাজারের মতো বিভিন্ন বইপুস্তক, পাণ্ডুলিপি, মূল্যবান নথিপত্র এবং নানা দুষ্প্রাপ্য জিনিস সংরক্ষিত ছিল।

এসব সংগ্রহকে আরও অমূল্য করে তুলেছিল ১৬৫৫ সালে প্রকাশিত কুরআন শরীফের স্বর্ণখচিত দুটি মূল্যবান কপি, কুরআনের ৪১টি তফসির গ্রন্থ। সুলতানের অনুরোধে রচিত ৩১৩টি সংক্ষিপ্ত অধ্যায় সংবলিত আইনবিষয়ক গ্রন্থ ‘ফতোয়া-ই-মুহাম্মদি’। ইতিহাসবিদ শামস-ই-সিরাজ আফিফের ‘তাওয়ারিখে ফিরোজ শাহি’, আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’, বাহাদুর সিংহের ‘শাহজাহাননামা’ ও ‘মাজমুয়ায়ে খুররামি’, আওরঙ্গজেবের প্রথম ১০ বছরের ইতিহাস ‘আলমগীরনামা’ এবং তাবাকাত-ই-আকবরি ও ভারতবর্ষের ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি।

এতে আরও ছিল আমির খসরু, ফরিদুদ্দিন আত্তার, নাসাফি, আহমদ-ই-জাম, জুলালী, কামাল খুজান্দি, উরফি, আহসান উল্লাহ প্রমুখ কালজয়ী কবিদের ১৪ কাব্যগ্রন্থ। হাসান আলি-ইজ্জত সংকলিত মিশ্র ফারসি ও দক্ষিণি শে’রের সংকলন ‘মুফাররিহুল কুলুব। ১৭৮৫ সালে রচিত ফরাসি ভাষায় লেখা চিকিৎসা-বিজ্ঞানের একটি বিশেষ গ্রন্থ ও ফার্সি ভাষা অনূদিত মহাভারত। হিন্দু ফকির তত্ত্ব বিষয়ে রচিত গ্রন্থ ‘সওয়াল ও জবাবে দারা শুকো ওয়া বাবা লাল’। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ব্যবহৃত সিলের জন্য সঠিক রাজকীয় প্রতীক ব্যবহারের নিয়মসংবলিত গ্রন্থ ‘জাভাবিত-ই-সুলতানি’। আলী ইবনে হুসাইন কাশেফি লিখিত নকশবন্দি তরিকার সুফিদের জীবনী ‘রাশাহাতে আইনুল হায়াত’, আরবি ভাষায় ধর্মীয় আধ্যাত্মিক সংকলন ‘আইনুল ইলম’ এবং সুফি আউলিয়াদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে স্বয়ং সুলতান টিপুর তৈরিকৃত বর্ষপঞ্জি ‘সহিফাতুল আরাস’।

এছাড়াও ছিল ৩৫টি প্রার্থনা গ্রন্থ, ৪৬টি ঐতিহ্যবিষয়ক গ্রন্থ, আধ্যাত্মিক বিষয়ের ১১৫টি গ্রন্থ, নৈতিক শিক্ষার ২৪টি বই; আইন ও বিচারবিষয়ক ৯৫টি, শিল্প ও বিজ্ঞানের ১৯টি, ইতিহাসের ১১৮টি, ৫৩টি পত্র, ১৯০টি কবিতা, গণিতবিষয়ক ৭টি, জ্যোতির্বিদ্যার ২০টি, অভিধান ২৯টি, দর্শন ৪৫টি, হিন্দি ও দক্ষিণাত্যের ভাষায় ২৩টি; পদার্থ বিজ্ঞানের ৬২টি, গদ্য ৪টি, তুর্কি গদ্য ২টি, ১৮টি রূপকথার গল্পগ্রন্থ এবং ৬টি সরকারি বিভাগের জন্য নির্দেশনাসংবলিত প্রজ্ঞাপন। বিভিন্ন ধরনের ঘোড়া ও ষাঁড়ের নামের একটি সরকারি নিবন্ধন খাতা। মুয়াইয়িদুল মুজাহিদীন ও মাখজানে আ’রাসের একটি কপি, রাষ্ট্রীয় প্রজ্ঞাপনগুলোর একটি সংকলন এবং ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশভিত্তিক বইসহ ইরান সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ একটি বই।

তাঁর সংগ্রহে আরও ছিল প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ধর্ম, ভাষা-সাহিত্য ও পশুপালন বিষয়ক বেশ কয়েকটি বই। শুধু ফার্সি এবং আরবি নয়, বরং কন্নড়, বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত, উর্দু ও ইংরেজি ভাষার বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থ ছিল। ছিল জার্নাল, ক্রনিকল, মানচিত্র, অঙ্কনের নানা মূল্যবান সংগ্রহ।

সবচে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রাচীন এ গ্রন্থালায়ে ছিল ফারসি ভাষায় টিপু সুলতানের নিজের হাতে লেখা তার স্বপ্নঘুমের বিবরণ। দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে রচিত ৩৭টি স্বপ্নের বিবরণী সমৃদ্ধ সুলতানের এ ‘খাবনামা’কে হেঁয়ালি মনে হলেও এটা ঐতিহাসিক মূল্য রাখে। কেননা এতে উঠে এসেছে সেকালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সুলতানের ব্যক্তিজীবন, চিন্তাধারা, বিশ্বাস ও কর্মপন্থার ফিরিস্তি।

তিনি প্রায়ই এসব বই পড়তেন এবং কিছু বই বারবার পড়তেন। কিছু কিছু বইয়ে তিনি পাঠ-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য লিখে রাখতেন। এসব মন্তব্যে গ্রন্থের সারবত্তা লেখা থাকত।

তিনি তার পড়া প্রতিটি বইয়ের ওপর স্বাক্ষর ও সিলমোহর (স্ট্যাম্প) লাগাতেন। সাহিত্যনির্ভর, বিশেষ করে কবিতার বই ও ইতিহাস গ্রন্থে ব্যক্তিগত সিলমোহর এবং রাজ্য পরিচালনা ও অন্যান্য রাজকীয় বিষয়ে সরকারি সিলমোহর ব্যবহার করতেন। অবশ্য কোনো কোনো বইয়ে তিনি ভিন্ন একটি নামেও সই করেছেন। কিছু কিছু সিলের চার কোণে মাওলূদে মুহাম্মদ শব্দটি লেখা ছিল এবং বাঘের ছয়টি ডোরাকাটা দাগ ছিল। আবার সরকারি বিভাগের প্রতি নির্দেশনা সম্বলিত একটি নথিতে ইউরোপীয় স্টাইলের মোম সিলের ব্যবহারও পাওয়া গেছে। এতে ‘ইয়া হাফিজ’ শব্দটি খোদাই করা আছে।

বেশ পরিশ্রম ও দীর্ঘ সাধনার পরেই সুলতান গড়ে তুলেছিলেন অনবদ্য সব গ্রন্থের এক বিপুল সমাহার। কিন্তু সুলতানের রাজ্যের মতো এ লাইব্রেরিও স্থায়িত্ব লাভ করেনি। বরং ১৭৯৯ সালের ৪ মে শেষ ইংরেজ-মহীশুর যুদ্ধে সুলতান পরাজিত ও শহীদ হওয়ার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরা দুদিন তাঁর এ লাইব্রেরি অবরুদ্ধ করে রাখে এবং লাইব্রেরির সব বই, জার্নাল, দলিল, মানচিত্র, ড্রইং এবং অন্যান্য অমূল্য সম্পদ সরিয়ে নেয়। তারা সম্রাটের প্রাসাদও লুণ্ঠন করে। এমনকি সুলতানের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে তার ব্যবহৃত জুতাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। একজন ব্রিটিশ অফিসারের ভাষ্যমতে, ‘এমন একটি ঘরও অবশিষ্ট ছিল না, যা লুটপাটের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে।’

পরবর্তীতে এসব সামগ্রীর সিংহভাগ গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির নির্দেশে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। বর্তমানে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে টিপু সুলতানের সংগ্রহের ৯৪টি অমূল্য পাণ্ডুলিপি রয়েছে।

আর কিছু সামগ্রী মাদ্রাজ, কলকাতা ও বোম্বাইয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিস লাইব্রেরিতে রাখা হয়। কিছু কলকাতায় গভর্নর জেনারেলের লাইব্রেরির শোভাবর্ধন করে। কিছু অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়া হয়। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এবং রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটিকেও দেয়া হয়। কিছু বই প্রেরণ করা হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাস প্রণেতা রবার্ট ওরমের কাছে।

এভাবে মতো টিপু সুলতানের মূল্যবান সব সংগ্রহও লুট করে নিয়ে যায়। কিন্তু তারা লুণ্ঠন করতে পারেনি সুলতানের সুনাম-সুখ্যাতি। বরং করোনার ঠুনকো অজুহাতে ভারত সরকার পাঠ্যবই থেকে টিপু সুলতানের জীবনভিত্তিক রচনাগুলো বাদ দিলেও আজও পাশ্চাত্য লেখকদের কাছে সবচে আকর্ষণের বিষয়- টিপু সুলতানের জীবন ও অবদান।

তথ্যসূত্র:

১. দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান, ভগবান এস কিদওয়াই।
২. আ ডেসক্রিপটিভ ক্যাটালগ অব দ্য ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরি অব দ্য লেট টিপু সুলতান, চার্লস স্টুয়ার্ট।

The post টিপু সুলতানের লাইব্রেরি appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/3BiBEs2

No comments:

Post a Comment