Friday, March 4, 2022

মাওলানা থানবির সুফি-দর্শন ও থানাভবনের বিপ্লব

আবদুর রহমান রাফি:

মাওলানা আশরাফ আলি থানবি ছিলেন বিশুদ্ধ ইসলামের ব্যক্তিক প্রতিভূ—যে ইসলাম পালিত হয়েছে রাসুল ও তার আসহাবের ঐকান্তিক জীবনে…

হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর পরবর্তী সময়কালে সুফিবাদের নামে মরমিজাত বৈরাগ্যের যে উন্মুক্ত স্রোতের উন্মেষ ঘটেছিল বহিরাগত বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিঘাতে, তার প্রবাহ যদিও আজতক গতিশীল, তবে এর ঘনায়মান রূপ ও কলুষ পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এগারো শতকের ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম জনজীবনে। সেই উদ্ভ্রান্ত বিশ্বাসের ছায়ায় আশ্রিত মানুষের সংখ্যা আজকের দিনে সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে সংখ্যালঘু হবার পিছনে মৌলিক অবদান ছিল তিনটি ব্যক্তিত্বের—শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী, আহমদ সারহিন্দি আর আশরাফ আলি থানবি। তারা প্রত্যেকেই আপন শতাব্দীকে করেছিলেন আন্দোলিত, ইসলামের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যে তারা চারপাশকে করেছিলেন সচকিত ও বিশ্বাসী।

নববী যুগের পরিশীলিত তাজকিয়া নয়, তাসাউফ ধারা সৃষ্টির প্রধান স্লোগান ছিল—মানুষের জীবন হতে হবে সম্পূর্ণ অন্তর্মুখী, পরিত্যাগ করতে হবে ইহকাল। এর অবশ্য বাহ্যিক কারণও ছিল কিছু। সে সময়কার ইবাদতমুখী আলেমরা তাওরাত-ইঞ্জিল অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেছিলেন। অবসর সময়ে, অনূদিত তাওরাত ও ইঞ্জিল তারা গভীর অভিনিবেশে নেড়েচেড়ে দেখতেন। এর প্রমাণ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে গাজালির ‘ইহয়াউ উলুমিদ্দিন’ ও অন্যান্য রচনায়।

খ্রিষ্টবাদের ইঞ্জিলীয় রুহ হল বিকৃতি-পরবর্তী সন্ন্যাসবাদ ও অবাধ অনির্বাণ বৈরাগ্যের আগুন; এটি সর্বজনবিদিত সত্য। ঈসা আলাইহিস সালামের জীবন সম্পর্কেও ইতিহাসে বৈরাগ্যের কথা লিপিবদ্ধ আছে, যেমন গোসল বা পানি বিবর্জন। সেগুলোর সত্যতার ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক অবগত। তবে খ্রিষ্টবাদের একটা স্বতন্ত্র ইতিহাস আছে, অবাধ মরমি জীবনধারার।

তাদের মতে মানবিক ক্ষমতা দুটি বিপরীত স্রোতধারায়, তথা পরকাল ও ইহকালের দিকে, একত্রে যাত্রা করতে পারে না। বাইবেল বর্ণনা করে, তুমি একই সাথে খোদা ও শয়তানের সেবাদাস হতে পারো না। টলস্টয় এই চিন্তার ব্যাখ্যায় বলেন, একই সাথে কেউ তার আত্মা ও জাগতিক বিষয়বস্তুর যত্ন নিতে পারে না। যে সহায়সম্পত্তির আশা করলো, সে তার আত্মাকে পরিত্যাগ করল। আর যে জাগতিক সম্পর্ক বিসর্জন দিতে পারে, সে-ই আত্মাকে রক্ষা করতে পারে। অন্যথায় কেউ দুটোই পাওয়ার চেষ্টা করলে শেষ পর্যন্ত কিছুই পায় না।

কীভাবে আত্মচৈতন্যের মধ্যে বসবাস করতে হয়—সে প্রশ্নের উত্তর দেয় খ্রিষ্টবাদ। তবে কীভাবে পৃথিবীতে মানুষের মাঝে সুসমন্বিতভাবে বসবাস করতে হয়—সে প্রশ্নের উত্তর খ্রিষ্টবাদ দেয় না। কেননা বাইবেল বলে, তোমার জীবন ও রুটিরুজি নিয়ে চিন্তা করোনা। তোমার ডান চোখ পাপে লিপ্ত হলে তা উপড়ে ফেলো, তোমার ডানহাত পাপে লিপ্ত হলে তা কেটে ফেলো।

খ্রিষ্টবাদ একটি বিভেদের কথা বলে ধর্মাশ্রিত জনগণের দুটি শ্রেণির মাঝে। পূণ্যের প্রতিশ্রুতি দেয় পাদ্রী সমাজকে, আর সাধারণ মানুষ দিনশেষে জীবনের অনিবার্য স্বাভাবিক দাবি-দাওয়ার দায় নিয়ে প্রভুর প্রেম থেকে বিমুখতার তকমা লাভ করে। তাদেরকে বলা হয় নাফরমান, কারণ তারা সামান্য রুটি ও আহার্যের উপর পরকালকে প্রাধান্য দিতে পারছে না। খ্রিষ্টবাদ মতে, জীবন তো সেটাই—যেখানে আত্মিক আবর্তনই মূল লক্ষ্য থাকে মানবের, আর ইহকাল হয়ে পড়ে বিবর্জিত কলুষের মত। বৌদ্ধ ধর্মেও এই উপাসনাকেন্দ্রিক বিভাজন আছে। সেখানে ধর্মীয় এলিটদের জন্য নির্ধারিত হয় কষ্টকর মহায়ানা , আর সাধারণের জন্য হিনায়ানা ।

মধ্যযুগের আরব সুফিবাদের শাস্ত্রীয় ও ব্যবহারিক ঝোঁক সেই মরমিবাদ, সেই খ্রিষ্ট্রীয় বৈরাগ্যের একপাক্ষিক চরিত্রের দিকে ধাবমান ছিল। যেখানে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে পৃথিবী, মানবের দেহবৃত্তের বিবিধ চাহিদা। সুপেয় খাদ্য-পানীয়, পরিশীলিত দৈনন্দিন জীবন অথবা বিবাহের মতো বিষয়গুলো পরিগণিত হত পাপাচার হিসেবে, যেমন খ্রিষ্টবাদের মরমি পরিবেশে, ঠিক তেমনই তখনকার আরব সুফিবাদে। পর্বতচূড়ার ধ্যানমগ্ন পাদ্রীর মৌনতা মুসলিম সুফিদের মনে এই অন্তর্যাত্রার প্রতি আগ্রহ-আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিত। সেই থেকে ক্রমশ সুফিরা মুরাকাবার সংস্কৃতি আনেন, তাকে সজ্জিত করেন বহু স্তর ও মর্তবার বন্ধনে। মুকাশাফা–মুশাহাদা প্রবিষ্ট করান ইসলামি ধর্মাচারের আবশ্যিক তালিকায়। একটা বিশাল দল তৈরি হয় এই নতুন সুফি ধারার নতুন বিশ্বাসের ক্রোড়ে।

পারসিক ও ভারতীয় সভ্যতার সাথে তখনকার মুসলিম সভ্যতা পরিচিত হচ্ছিল পরস্পর অবাক কৌতূহলে। দুটি সভ্যতার মিলনে দুটি পক্ষ থেকেই আদান-প্রদান হয় কম-বেশি। আরব সভ্যতার ছায়ায় তারা শুধুমাত্র গ্রহণের জন্য এলেও তাদের সভ্যতা আরবে প্রভাব ফেলে, বিভিন্ন পর্যায়ে। ইবাদতের ক্ষেত্রে সুফিরা তাদের সর্বেশ্বরবাদী দর্শনকে উপঢৌকন হিসেবে গ্রহণ করে। নিজেদের রঙে তাকে চিত্রায়িত করে গভীর অভিনিবেশে। তারপর জন্ম নেয় ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’।

মাওলানা আকরম খাঁ বলেন, ‘প্রাথমিক সুফিগণের সাধনা যুগের অবসান ঘটার পর ইসলাম ধর্মের; বরং প্রকৃত ইসলাম ধর্মের নামকরণে (বিশুদ্ধ ইসলামের নাম চালিয়ে) মুসলমান সমাজের দিকে দিকে যেসব মারাত্মক অনাচারের প্রাদুর্ভাব ঘটিয়াছিল সেই যুগের মুসলমানদিগের আচার-ব্যবহার, তাহাদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির পরিচয় লইলে তাহা সুস্পষ্টভাবে জানিতে পারা যায়। বস্তুত ইহারা ইসলামের পরিবর্তে আর একটা উদ্ভট ধর্মেরই সৃষ্টি করিয়া লইয়াছিল। ইহা আমাদের কল্পিত কথা নহে, বহু বিজ্ঞ আলেম ও এমাম মুক্তকণ্ঠে এই অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন।’

উপমহাদেশে সেই সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস ও আচারে মিশ্রিত সুফিবাদ আসে আরবের বিভিন্ন বাণিজ্যযাত্রা ও যুদ্ধযাত্রার মধ্য দিয়ে। তারা মানুষের মাঝে ইসলাম প্রচার করেছিলেন সত্য, তবে সেই পুরনো আন্দোলনের একেকজন কর্মী হিসেবেও গড়ে তুলছিলেন নবদীক্ষিত সেইসব মুসলমানদের। ভারতে একমাত্র তারাই ইসলাম প্রচার করেনি, বিশুদ্ধ বিশ্বাসের আলেম ধর্মপ্রচারকও ছিলেন তখন। তবে সুফিরাই ছিল অধিক, তাদের চিন্তাই ছিল ব্যাপক। মনসুর হাল্লাজও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা সময় যাপন করেছেন ভারতে, দাওয়াত দিয়েছেন মানুষদের। অধ্যাপক আকবর আলি খান তার ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটনের অভিমত উদ্ধৃত করেছেন যে, তখন উপমহাদেশে বিধর্মীদের ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে জীবিত পীরদের থেকেও মৃত পীরদের প্রভাব ছিল বেশি। তাদের মাজারে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে দান-দক্ষিণা করে সফলতা পেলে মানুষ ইসলামের ছায়ায় আশ্রিত হত। এই বক্তব্য থেকে তখনকার মাজারকেন্দ্রিক তৎপরতার চূড়ান্ততা উপলব্ধি করা যায়।

মরহুম খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ বলেন, সেই সময় কতিপয় ভবঘুরে, পর্যটক ফকির ও মিসকীন মুসলমান উপমহাদেশে আগমন করেন এবং হিন্দুদের মন্দির আর মগদের গির্জার মোকাবেলায় বিখ্যাত সুলতানুল আরেফিন বায়েজিদ বোস্তামি ও শেখ আবদুল কাদের জিলানির নামে কয়েকটি মিথ্যা কবর ও জিয়ারতকেন্দ্র গড়ে তুলেন। অথচ এই বুজুর্গ ব্যক্তিগণ কখনো ভারতের এই দারুল কুফরে আগমন করেননি। এই সমস্ত কবরের সাহায্যে তারা লোকজনকে সমবেত করার এবং নিজেদের জীবিকা নির্বাহের একটি পথ তৈরি করে নিয়েছিল। এবং এগুলোই পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে মুসলমানদের গমনাগমনের মূল কেন্দ্র হয়ে পড়েছিল।

কিন্তু নবীজি যে ইসলাম পালন করেছেন এবং মানুষদের শিখিয়েছেন সেখানে ইহকাল ও পরকাল, জীবন ও মৃত্যু এবং দেহ ও আত্মার সুসমন্বিত সমতার বোধ নিহিত ছিল। খ্রিষ্টবাদের সেই সর্বগ্রাসী মরমিবাদের প্রেক্ষাপটে রাসুল এসে ঘোষণা দিলেন, ‘আমাদের ইসলামে বৈরাগ্যের কোনো স্থান নেই।’ আল্লাহ কুরআনে নাযিল করলেন, সে সব বৈরাগ্য তারা নিজেরাই উৎপাদিত করেছে আবশ্যক করে নিজেদের উপর। ইসলাম হল খ্রিষ্টবাদের ঊর্ধ্বের এক জীবনবোধ। এই বিষয়টি অনেকে প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন—Islam is Christianity re-oriented toward the world; ইসলাম হল জগৎ সংসারায়িত খ্রিষ্টবাদ। একটা গির্জার আবহে থাকে রহস্যময়তা, আর মসজিদের আবহে থাকে বুদ্ধিচর্চা। ইসলাম শুধুমাত্র আত্মিক তৎপরতার দিকে যেভাবে আহ্বান করে না, তেমনি বস্তুবাদকেও মেনে নেয় না তার অনুসারীদের ভাবনা ও বিশ্বাসে। মনে রাখতে হবে, দ্বৈততা দুরূহ কোনো তত্ত্বদর্শন না। এটি মানব জীবনেরই চূড়ান্ত সত্যরূপ। একজন সনেট লেখক কবি তাঁর কাব্যের জগতে বিচরণ ছাড়াও অংক কষতে থাকেন ছন্দ ও শব্দের। কাব্য ও অংক একত্রে যেভাবে সম্ভব, ইসলামের ইবাদত ও জীবনোপকরণ আহরণ তেমনি একত্রে পরিচালনা করা মুসলিমদের জন্য সম্ভব। বরং বলা চলে, এটি তাদের চূড়ান্ত সত্য—যেহেতু তারা যুগপৎ রক্ত-মাংস ও আত্মার সমন্বিত রূপ।

মাওলানা থানবি সেই প্রেক্ষাপটের ভারতে এসেছিলেন, যেখানে তাসাউফের নামে চলে নাস্তিকতার চর্চা, ধর্মপালনের নামে চলে বেদাত। তার একমাত্র মিশন ছিল ইসলামকে ‘ইসলাম’ করে তোলা, যা-কিছু ইসলাম বিরুদ্ধ ও বহির্ভূত সেগুলোকে সর্বপন্থায় প্রতিহত করা। বিশাল এক মহীরুহ বটবৃক্ষের মতো তিনি আপন ব্যক্তিত্বের ছায়া বিস্তার করেন উপমহাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে। অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করলেন, পাঠ-পঠন ধারাবাহিক করলেন ইসলামি বিশুদ্ধ আকিদা। একটা প্রজন্ম গড়ে তুললেন, যারা বলতে পারে ও লিখতে পারে একাধারে। শুধু পারে যে তাই নয়; বরং তাদের কর্ম ও প্রয়াসই আশরাফ আলি থানবির চিন্তান্দোলনকে দিয়েছিল পরিপূর্ণতা ও চিরায়ত প্রভা। সমাজব্যবস্থা নিয়ে ছিল তার স্বতন্ত্র ভাবনা। সর্বোপরি তিনি ইসলামের মধ্যকালীন তাসাউফ দর্শনকে পরিত্যাগ বা পরিশুদ্ধ করে প্রথমকালের তাজকিয়া-কার্যে প্রত্যাবর্তিত হতে চেয়েছিলেন। এবং তিনি সফল হয়েছিলেন আপন উদ্দেশ্যে। কর্মব্যস্ত একটা কাল অতিবাহিত হবার পর পাল্টে যায় উপমহাদেশের ধর্মীয় বৃত্ত, মুসলিম সামাজিক প্রেক্ষাপট ও ইসলামি আধ্যাত্মিকতার প্রচলিত অনৈসলামিক রূপ।

থানবি শুধু সাধারণ মানুষের জন্যই লেখেননি। সুগভীর তাত্ত্বিক বহু গ্রন্থ ও বিভিন্ন রচনা আছে তার। একজন লেখক হিসেবে তাঁকে পরিমাপ করার পূর্বে সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি। ‘আদাবুল মুআশারা’-এর মত জনসাধারণের জন্য লিখিত গ্রন্থের বিবেচনায়, তাকে লঘু লেখক ভাববার কোনো অবকাশ নেই। ‘আনফাসে ঈসা’ বা ‘তানজিহে ইবনে আরাবি’ও সামনে রাখতে হবে তাকে বিবেচনা করার পূর্বে।

সংস্কার ছোটখাটো পরিসরে অনেকেই হয়তো করেছে, কিন্তু বৃহৎ পরিসরে সংস্কার আনয়নের ক্ষমতা সবার থাকে না। শতাব্দীর ক্রান্তিতে দু-একজন করে তেমন মহামনীষী পৃথিবীতে আসেন। মাওলানা থানবি সেই মহা সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলেন। তার সংস্কার কার্যের সুফিতাত্ত্বিক দিকটিতে আমাদের আলোচনা আবর্তিত হবে এই প্রবন্ধে। বিভিন্ন গ্রন্থ ও বয়ান বক্তৃতায় তিনি যে আধ্যাত্মিকতা– যে নিখাদ তাজকিয়ার নতুন বিনির্মাণ করতে চেয়েছিলেন সেগুলো আমরা খতিয়ে দেখব। তার অনেক কিছুই আমাদের চারপাশে আজকের সময়ে পরিত্যাজ্য, তারই সিলসিলায় গড়ে ওঠা খানকাগুলোতে। তাদের বিশ্বাস ও ভাবনায় থানবির পরিপূর্ণ গ্রহণ জরুরি, যেহেতু তারা থানবিকে অনুসরণের দাবি তোলেন। সর্বাগ্রে সেগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকাটা দরকার।

চার সুফি সিলসিলা

মাওলানা থানবি দেওবন্দী অধ্যয়নকালেই (১৮৮১ইং) চিঠির মাধ্যমে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী থেকে বায়াত লাভ করেন। দেওবন্দের একাডেমিক পড়াশোনা সমাপ্ত করার পর তিনি হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন হেজাজ অভিমুখে। হজ্ব শেষে শায়খের সাথে সাক্ষাৎ করে নতুনভাবে বায়াত নেন, এবং দীর্ঘদিন সেখানেই অবস্থান করেন তার সাথে।

একসময় স্বদেশে ফিরেন। কানপুরের জামিউল উলুম মাদ্রাসায় অধ্যাপনা শুরু করেন, সাথে আধ্যাত্মিক সবকও নিয়মিত পালন করতে থাকেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে বিপুল ভাবাবেগ তার মাঝে নেমে আসে। অন্তরে ব্যাকুলতা জাগে শায়খের জন্য। তখন অধ্যাপনা ছেড়েই রওনা দেন হেজাজভূমে দ্বিতীয়বার। ছয়মাস অবস্থান করেন শায়খের দরবারে। অবিচ্ছিন্ন সোহবত লাভে ধন্য হতে থাকেন এ সময়ের মাঝে। তার স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যম ও সুদৃঢ় মনোবলের দরুন একসময় শায়খের প্রতিচ্ছায়ায় পরিণত হন—মেজাজ ও মানসিকতায়, আখলাকে। এভাবেই তিনি ভারতে প্রসিদ্ধি পান জ্ঞান, খোদাভীরুতা, ইবাদত ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে।

তার শাইখ তাকে ওসিয়ত করে বলেছিলেন স্বদেশ থানাভবনে ফিরে যেতে, তার খানকার পুনর্জাগরণ করতে—যার পরিচিতি ছিল ‘খানকায়ে এমদাদিয়া’ বা ‘দুক্কানুল মারেফা’ নামে। তিনি একসময় হিন্দুস্তানে ফিরলেন এবং স্বদেশ থানাভবনের খানকায় এলেন। সেটা ছিল ১৮৯৭ ঈসায়ীর কথা। এই খানকাতেই তিনি অবস্থান করেছেন মৃত্যু (১৯৪৩ ই.) পর্যন্ত।

একাধারে তিনি নকশবন্দিয়া, চিশতিয়া, কাদেরিয়া ও সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। তার শায়েখ হাজী ইমদাদুল্লাহ ছিলেন হিন্দুস্তানে এই চার তরিকার মোহনা, তাই থানবিও এই চার সিলসিলার বায়াত পেয়েছিলেন একত্রে। তার ইসলাহী ও তরবিয়তী কার্যক্রমে এই চার পদ্ধতিই বাস্তবায়িত হয়েছিল সফলভাবে।

মূলত তিনি যে তরিকা ও পন্থার আক্ষরিক অনুসরণ করতেন–সেটা একমাত্র ‘শরিয়ত’। কারণ এখানেই বিদ্যমান আত্মশুদ্ধির সকল পন্থা, উত্তম গুণাবলির সকল স্তর। তিনি শরিয়ত আর তরিকতের মধ্যকার বিভেদ মুছে দিয়েছিলেন। এবং তরিকতকে শরিয়তের খাদেম হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তাসাউফকে পরিশুদ্ধ করেছিলেন বেদাত ও ভ্রান্ত আকিদা থেকে। তিনি লিখেছিলেন, শরিয়তের মানদণ্ডে যা কিছু ভুল, তাকে সুফিবাদের নামে বৈধতা প্রদানের কোনো সুযোগ নেই। কারণ, সুফিরা এমন কোনো মহামানব না যাদের উপর শরিয়তের বাধ্যবাধকতা নেই। যারা শরিয়তের গন্ডি ছিন্ন করবে তাদের তাসাউফেরও থাকবে না কোনো গ্রহণযোগ্যতা।

সমকালীন আলেমদের মন্তব্য

থানবি সমসাময়িক আলেমদের দৃষ্টিতেও লাভ করেছিলেন মর্যাদার আসন। সাধারণত বিভিন্ন বিষয়ের ক্ষণজন্মা আলেমদের ক্ষেত্রে যে সমস্ত বিশেষণ ব্যবহার করা হয়, থানবির কালের মহান আলেমরাও তার ক্ষেত্রে সে সব ব্যবহার করেছেন।

জাহেদ কাওসারী তার ‘মাকালাতে কাওসারি’ গ্রন্থে ভারত-পাকিস্তানের আলেমদের অবদান চিহ্নিত করতে গিয়ে লিখেছেন, হাদীস শাস্ত্রের পঠন পাঠন ও সুন্নাহর জ্ঞান মানুষের মাঝে প্রচারের ক্ষেত্রে গভীর মনোনিবেশ করেছিলেন হাকীমুল উম্মত মাওলানা থানবি। তিনি ছিলেন জ্ঞানবোদ্ধা, ক্ষণজন্মা মনীষী, হিন্দুস্তানে সকল আলেমদের নেতা, প্রায় পাঁচশত গ্রন্থের লেখক, আলেমে রব্বানী এবং উপমহাদেশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

অসংখ্য আলেম ও মাশায়েখ তাকে ভারতের মুসলিম সংস্কারক বা বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ নামে ভূষিত করেছেন। অনেকে তাকে ‘মুহিউস সুন্নাহ’ নামেও অভিহিত করেছেন। সাইয়্যেদ সুলাইমান নদবী তাকে ‘হাফেজুল হাদীস’ বলেছেন।

আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ তার প্রশংসায় লেখেন, মাওলানা হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলি থানবি ইন্তেকাল করেছেন ১৩৬২ হিজরিতে। তিনি বেঁচেছিলেন ৮১ বছর। এরই মাঝে তার রচনা ও গ্রন্থের সংখ্যা পৌঁছেছে হাজারের উপর। এই সৌভাগ্য, এই শ্রেষ্ঠত্ব আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন দান করেন। অন্যস্থানে তিনি আরো লেখেন, আধুনিক কালের একজন মহান লেখক হলেন—হাকীমুল উম্মত, শায়খ, ফকিহ, ইবাদতগুজার, দুনিয়াবিমুখ, মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আশরাফ আলি থানবি।

সাইয়েদ সুলাইমান নদভি লেখেন, হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলি থানবির ধর্মীয় জ্ঞানবৃত্তিক প্রভা বিচিত্র রঙে চিত্রায়িত হয়েছিল। তিনি একাধারে ছিলেন কুরআনের অনুবাদক, তাজবীদ বিশারদ, মুফাসসির, কুরআন-নিসৃত ফিকহি আহকামের ব্যাখ্যাকার, এবং কুরআনকে ঘিরে যেসব সংশয় তৈরি হয় সেগুলোর উত্তরদাতা। ছিলেন হাদীস শাস্ত্রে বিজ্ঞ, হাদিসের সূক্ষ্ম বিষয়ের অনুপম ব্যাখ্যাকার। ছিলেন ফকিহ, হাজার ফিকহি মাসআলার উত্তর তিনি দিয়েছেন, আধুনিক বিভিন্ন মাসআলায় মত প্রদান করেছেন, ফতোয়া দিয়েছেন পুর্ণ বিচক্ষণতা ও সতর্কতার সাথে। ছিলেন একজন সফল বক্তা, তার বক্তৃতা সংকলিত হয়েছে, হয়েছে প্রকাশিত। ছিলেন সুফি সাধক, তাসাউফের উচ্চ মর্তবায় তিনি আরোহণ করেছিলেন, শরিয়ত আর তরিকতের মধ্যকার ফেনায়িত শতাব্দীব্যাপী সংঘাত তিনি মিটিয়েছিলেন। ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক পীর, অগণিত মুরিদ তার সোহবতে এসে জীবনকে সংশোধন করেছে। ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক, উপমহাদেশের মাটি থেকে অসংখ্য ভ্রষ্টাচার তিনি বিদূরিত করেছিলেন। তার রচনাবলি সমগ্র ভারতবর্ষ ছাপিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে আজ। সেগুলোর অনুবাদ হচ্ছে ইংরেজি, আরবি, বাংলা, গুজরাটি বা সিন্দির মতো বহু ভাষায়।

অন্যস্থানে তিনি আরও লেখেন, শতাব্দীর সংস্কারক যিনি থাকেন, তার মাঝে সেই শতাব্দীর সমস্ত উত্তমতার–সমস্ত বৈভবের সম্মিলন ঘটে সুনিপুণভাবে। হিজরি চতুর্দশ শতাব্দীর সূচনা হয় ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও বিপুল জ্ঞান-বিজ্ঞানের বা বুদ্ধিবৃত্তিক রচনার বিপ্লব সঙ্গে নিয়ে, নাস্তিক ও বিধর্মী বিদ্বেষী লেখকরা ইসলামকে আঘাত করতে থাকে। সেই প্রেক্ষাপটে থানবির সংস্কারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ছিল সময়ের দাবী। তার মাঝে এই শতাব্দীর জ্ঞানবৃত্তিক উৎকর্ষের সম্পূর্ণটুকু উদ্ভাসিত হয়েছিল। একজন থানবি ছিলেন কালোত্তীর্ণ সমস্ত আলেমদের তালিকার সর্বপ্রথম নাম—যদি তার জীবনকালের সীমাবদ্ধতার সাথে তাঁর রচনাবলির আধিক্যের পরিমাপ করে দেখা হয়। সেদিকে দৃষ্টিপাত করলে যে কেউ আশ্চর্য হতে বাধ্য।

সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি হিন্দুস্তানের সমাজে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, আশরাফ আলি থানবি দারুল উলুম দেওবন্দের সূর্য-সন্তানদের একজন ছিলেন। তিনি বিশুদ্ধ আকিদা প্রচার করতেন, সংশোধন করতেন মানুষের অন্তর ও চরিত্র। সর্বোপরি তাদেরকে আহবান করতেন আল্লাহর দিকে। একাই তিনি একটা বুদ্ধিবৃত্তিক একাডেমীর কর্ম আঞ্জাম দিয়েছিলেন। তার গ্রন্থাদি ও পুস্তিকা সংখ্যা আট শতাধিকেরও উপরে। সেগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল হিন্দুস্তানে।

এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলামে তার পরিচয় এসেছে, An eminent scholar, theologian, and Sufi, he lead a very busy life, teaching, preaching writing and lecturing and making occasional journeys. A prolific writer, his works exceed one thousand in number. This are mostly on tafsir, hadith, logic, kalam and tasawwuf. (থানবি ছিলেন একজন জ্ঞানী আলেম, ফকিহ, সুফি। দীর্ঘ একটা কর্মব্যস্ত জীবন তিনি পার করেছেন অধ্যাপনা, সৎকর্মের প্রতি আহ্বান, গ্রন্থনা, বক্তৃতা ও ভ্রমণ করে। বহুগ্রন্থপ্রণেতা একজন লেখক ছিলেন তিনি, তাঁর রচনার সংখ্যা এক হাজারেরও উপর। অধিকাংশই তাফসির, হাদীস, মানতেক, কালাম, আকিদা এবং তাসাউফ–বিষয়ক।)

সংস্কারখাতে তার অবদান

ভারতবর্ষের দর্শন, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে পৌত্তলিকতা ছিল প্রকট। অতি পূর্বকাল থেকেই এখানে ছিল বহু ঈশ্বর, বিবিধ রূপকথা। ছিল অসংখ্য-অগণিত ধর্মীয় উৎসব ও প্রচলিত হোলি। বানোয়াট কল্পিত ইতিহাস, কাল্পনিক মহাপুরুষ বা হিরো সেসবের ক্ষেত্রে পালন করত কার্যত ভূমিকা। আর এ সব বিশ্বাস ও প্রচলন মুসলিমদের নিস্তরঙ্গ জীবনেও প্রভাব ফেলেছিল। তাদের মাঝে সেগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজের ওতপ্রোত অনুষঙ্গ হিসেবে। ইসলামের শিক্ষা বা কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান থেকে দূরবর্তীতার কারণেই তাদের অধঃপতন ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছিল। মুসলিমদের জীবন আর হিন্দুদের জীবন সেসময় একটি পরিবারের মতো একদেহে লীন হয়ে গিয়েছিল—প্রতিটি জনপদে, প্রতিটি এলাকায়।

মাওলানা থানবিকে আল্লাহ এইসব কলুষ থেকে হিন্দুস্থানের মুসলিমদের পরিশুদ্ধ করার জন্য নির্বাচিত করেছিলেন—তাওফিক দিয়েছিলেন। ঘনায়মান ভ্রষ্টাচার থেকে তিনি নিখাদ সত্যকে বের করে এনেছিলেন। তার চারপাশের মুসলিম সমাজকে বাস্তবিকভাবেই মুসলিম করে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি ইসলামের শেকড়ায়িত শিক্ষা-জ্ঞান প্রচার করেছেন, লিখেছেন শক্তিমান নবতর রচনাবলি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে গিয়ে প্রচার করেছেন সত্য-ন্যায়ের কথা, বিশুদ্ধ করেছেন মানুষের আকিদা, তাদেরকে মুক্ত করেছেন বেদআত ও হিন্দুয়ানী আচার-প্রথা থেকে।

মালফুজাত

মালফুজাত বলা হয় মহান কোনো ব্যক্তিত্বের মুখনিঃসৃত বাণীকে। মাওলানা থানভী প্রতিদিন খানকায়ে এমদাদিয়ায় জোহরের নামাজের পর সর্বস্তরের মানুষের জন্য একটি মজলিসের ব্যবস্থা করতেন—কথা বলতেন তাঁর ছাত্র, মুরিদ এবং সাধারণ আগতদের সাথে অনির্দিষ্ট বহু বিষয়ে। বিভিন্ন সময় তিনি তাদের বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতেন। অনেকে তার এইসব মজলিসের বয়ান–কথাবার্তা লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। সেই লিপিবদ্ধ বাণী সংকলিত হয়েছে ৬২ খণ্ডে। সেগুলোর মাঝে সন্নিবেশিত হয়েছে নিগূঢ় প্রজ্ঞা, জ্ঞান, কৌতুক, গল্প ঘটনা, সাহিত্য, শিষ্টাচার, বিতর্ক, খন্ডন ও সত্যপথের বয়ান। এই মালফুজাতের গভীর প্রভাব ছিল মুসলিম রুচিশীলতার বিনির্মাণ ও উত্তম কর্মের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে।

আফতাব আলম নদবী তার মজলিসের অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, মাওলানা থানবির মজলিস ছিল— এলেম, তারবিয়ত ও তাজকিয়ার প্রাণকেন্দ্র। সেখানে তিনি মানুষের সামনে সুফিবাদের সারবত্তার সৌন্দর্য তুলে ধরতেন। ইলমী পর্যালোচনা করতেন, শোনাতেন পূর্ববর্তী আধ্যাত্মিক বুজুর্গদের ঘটনা। যখন তিনি সে সব ঘটনা বর্ণনা করতেন, তার চারপাশে একটি ঐশী নৈঃশব্দ্য নেমে আসতো—নেমে আসতো প্রশান্ত আবহ। তিনি অনুভব করতেন বিমুর্ত আনন্দ।

থানবির কর্মের মৌলিক নীতি

ক. অন্যের হক

তিনি তার ভক্ত ও মুরিদদের সর্বাগ্রে আদেশ করতেন মানুষের হক পরিপূর্ণরূপে আদায় করতে। এ ক্ষেত্রে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। কারণ তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, বহু মানুষ ইবাদত পালনে ও জিকির অজিফা আদায়ে চূড়ান্ত ব্যয় করে প্রচেষ্টার, কিন্তু অন্যের হক আদায়ের ক্ষেত্রে থাকে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত। মানুষ সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শরিয়তের আদেশ অমান্য করে খুব সহজভাবে। তাই তিনি সামাজিক সম্পর্ক ও অন্যের হক আদায়ের বিষয়ে জিকির-ওজিফা বা নফল আমলের চেয়েও অধিক গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলতেন, আমি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য রাখি, যেন আমার থেকে বা আমার কোনো মুরিদ থেকে সাধারণ মানুষ কষ্ট না পায়। হোক সেই কষ্টপ্রদান দৈহিক—যেমন প্রহার বা ঝগড়া, হোক তা সম্পদকেন্দ্রিক—যেমন অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পত্তির ভোগদখল, হোক তা সম্ভ্রমকেন্দ্রিক—যেমন কারও নামে গীবত বা তাকে অপদস্ত করা, হোক তা অন্তর্গত দুঃখপ্রদান—যেমন খারাপ আচরণ বা কাউকে শঙ্কিত করা। যদি এমন কোনো আচরণ কারও থেকে প্রকাশ পেয়ে থাকে, তার উপর আবশ্যক হল সেই কর্মের কারণে যার সাথে সেই আচরণটি সংঘটিত হয়েছে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আমি যখন কাউকে শরিয়তের অন্যথা করতে দেখি, সেটা আমাকে কষ্ট দেয় অবশ্যই। তবে যখন কাউকে অন্যের হকের ক্ষেত্রে অনাচারে লিপ্ত দেখি, তখন তা আমার হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তাদেরকে তিনি এ সব অনাচার ও ধ্বংসের পথ থেকে মুক্তি দেন।

খ. ধর্মীয় সহজতার নীতি

তিনি দ্বীনের ক্ষেত্রে সহজতার কথা বলতেন, কঠিনতা আরোপ করতেন না। মানুষকে দুর্বোধ্যতার ভয় দেখিয়ে তিনি ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দিতেন না, বরং এর সুশীল বৃত্তে তাদেরকে টেনে আনতেন। বয়ান বক্তৃতায় তিনি গম্ভীর মূর্তিতে আবির্ভূত হতেন না, এ কারণে সকলের কাছেই ছিলেন সমাদৃত ও গ্রহণীয়। তার দরবারে বিচিত্র পেশার বহু মানুষ ছুটে আসত। তাদের কেউ থাকতেন হয়তো সরকারি কর্মকর্তা, কেউ ডাক্তার, কেউ অধ্যাপক, কেউ রাজনৈতিক নেতা, কেউ আবার ইঞ্জিনিয়ার অথবা ব্যবসায়ী। ধনী-গরীব সকলেই নির্বিশেষে।

তিনি প্রত্যেক পেশার লোকজনের জন্য ইসলামের মান্যতার সহজতর পন্থা বাতলে দিতেন। তাদেরকে তিনি আপন পেশা পরিত্যাগ করে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে খানকায় আশ্রিত হতে বলতেন না। তাদেরকে স্ত্রী সন্তান আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে পর্বতচূড়ায় ধ্যানমগ্ন হবার আদেশ দিতেন না। ধনীদেরকে সমস্ত সম্পত্তি দান করতে বলতেন না। বরং বলতেন দীনের রুহটাকে নিজের মাঝে ধারণ করতে, ভালোবাসা আনতে আপন এবাদতের প্রতি, সর্বোচ্চ অনুসরণের চেষ্টা করতে সুন্নতের, পূর্ববর্তী নেককার মনীষীদের জীবনপন্থা আঁকড়ে থাকতে প্রগাঢ়ভাবে এবং সেইসাথে আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ও সম্পদের মাঝেই বসবাস করতে। এভাবেই তিনি ইহকাল ও পরকালের উভয় কল্যাণের মাঝে সমন্বয় সাধন করেছিলেন। এই পথেই তিনি আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত সৌন্দর্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অব্যাহত অনুশীলনে।

কোনো এক প্রাসঙ্গিকতায় তিনি লিখেছেন, ইসলাম সহজ, জীবনের সত্য সক্ষমতার সহচর। মানুষের অসংখ্য বৈচিত্র্যময় পেশা ও কর্মের মধ্য দিয়েই তারা ইসলামটাকে পালন করতে সক্ষম; কোনো প্রতিকূলতাই এ ক্ষেত্রে তাদের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। সকল কর্মব্যস্ততার মাঝেই তারা শরিয়ত ও তার সমস্ত হুকুম পরিপূর্ণরূপে আদায় করতে পারে। শাশ্বত সত্য–ইসলাম তোমাদের অন্তরে স্পষ্ট হয়ে যাবার পর কোনো ওজর আপত্তি বাস্তবিকভাবেই আর বাকি থাকে না। তখন প্রকাশিত হয় ইসলামের সহজতা, উপযোগিতা, স্বভাবজাত আনুকূল্য এবং জীবনের সকল চাহিদার ক্ষেত্রে এর সতস্ফুর্ত স্বীকৃতি।

গ. মরমিবাদ নয়, প্রয়োজন উত্তম আখলাক

তিনি মানুষের সাথে মানুষের পারস্পরিক আচরণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। জোর দিতেন সে ক্ষেত্রে সৌন্দর্য ও সুষমা আনয়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ। রহমতুল্লাহ নদবী লেখেন, আশরাফ আলি থানবির আধ্যাত্ম-কার্য পূর্ববর্তী সুফিদের পন্থার অনুগামী ছিল না, শিক্ষার ক্ষেত্রেও তিনি কারও অনুকরণ করতেন না। এর মূল লক্ষ্য ছিল দ্বীন ও শরিয়তের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে রাসূলের সুন্নাহর পুনঃপ্রতিষ্ঠা। অতীন্দ্রিয় অনুভব উপলব্ধি, কাশফ কারামত বা আধ্যাত্মিক স্বপ্নের চেয়েও বেশি মূল্য ছিল তার কাছে বিশুদ্ধ আক্বীদা, ইবাদত ও আখলাকের।

মাওলানা থানবি এ বিষয়ে বলেন, মানুষ আমার মজলিস থেকে মনুষ্যত্ব শিখবে, অর্জন করবে আখলাক—এটিই আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়, সূক্ষ্ম উপলব্ধির সুফিয়ানা মজলিসের চেয়ে এবং সমাজে প্রসিদ্ধ সুফিতত্ত্বের নিগূঢ় বোধ কপচানোর চেয়ে। আমি আমার চারপাশের মানুষদের বারবার একটা কথা বলি যে—যেই মানুষটি ওলি হবার পদ্ধতি শিখতে চায় বা ওলিদের ছাড়িয়ে যেতে চায় সে যেন কোনোভাবেই আমার মজলিসে না বসে। আর যে মনুষ্যত্ব ও উত্তম চরিত্রের শিক্ষা নিতে চায় সে-ই শুধু আমার কাছে আসুক। মনুষ্যত্ব ও চারিত্রিক শিক্ষা জীবনের মৌলিক অপরিহার্য অংশ। আর ওলী হবার পদ্ধতি হল বাড়তি শুদ্ধাচার। কারণ, মানুষ যখন পূর্ণাঙ্গ মানবতা থেকে বঞ্চিত থাকে, তখন অন্যেরা তার থেকে কষ্ট পায়, দুঃখ অনুভব করে। কিন্তু যারা ওলী হবার চেষ্টা করেও ওলী হতে পারেনি, তার থেকে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না—সেই না পারার কারণে।

তাকী উসমানী খানকায়ে এমদাদিয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখেন, খানকায়ে এমদাদিয়া ছিল নিয়মতান্ত্রিক জীবনাচার শেখার এক অনন্য কেন্দ্র। সেখানে বিশুদ্ধ করা হত মানুষের আচার, ভাবনা ও বিশ্বাস। শেখানো হত ব্যক্তি ও সমাজকেন্দ্রিক শিষ্টাচার। এই খানকায় ছিল প্রতিটি বিষয়ের সুদৃঢ় শৃঙ্খলা যা কেউ লঙ্ঘন করতে পারত না। সত্তাগতভাবে এই শৃঙ্খলা ছিল মুসলিম আদর্শিক সমাজের জীবন্ত দৃষ্টান্ত। বলা যায়, এই খানকা—খানকায়ে এমদাদিয়া ছিল মানুষের উত্তম বিনির্মাণের কারখানা, এখানে তাদেরকে সজ্জিত করা হত উন্নত চরিত্র ও সদাচারের ভূষণে।

ঘ. তরিকতের উপর শরিয়তের প্রাধান্যতা

শরিয়তকে তরিকতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান থানবির সংস্কারের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তার এই নীতি সুফিবাদের বৈরাগী উন্নাসিক চেতনা-স্রোতের বাঁধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেখানে প্রত্যাখ্যান করা হত শরিয়তকে, মূল্যহীন সাব্যস্ত করা হত নামাজের মত বাহ্যিক ধর্মীয় কার্যক্রমকে।

তিনি সর্বদা সর্বসাধারণ বা আলেমদের এই চিন্তাকেন্দ্রিক ভুল থেকে সতর্ক করতেন যে, অন্তরের পরিশুদ্ধিকরণই চূড়ান্ত লক্ষ্য, শরিয়তের বাহ্যিক মান্যতার খুব একটা দরকার নেই। স্পষ্ট করে বলতেন, শরিয়তের মান্যতা ও সুন্নাহর অনুসরণই অধিক গুরুত্ববহ। আর শুধু তরিকত বা অন্তর্মুখিতা দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় না। তার কাছে প্রকৃত তাসাউফ বা সুফিবাদের অর্থ ছিল শরিয়তের আনুগত্যের মধ্য দিয়ে অর্জিত আন্তরিক বিশুদ্ধতা। তিনি বলতেন, আমাদের একমাত্র পন্থা হল সেটা যা আল্লাহ আমাদের জীবনের জন্য প্রণয়ন করেছেন—শরিয়ত। যারা বলতে চায়, শরিয়ত ছাড়াও পরকালীন মুক্তির অন্য আরো বিভিন্ন পন্থা আছে, তারা মিথ্যাবাদী। যদি কাউকে শূন্যে ভাসতে দেখো, তাহলে এই ‘মহান কারামতের’ ভেলকিতে ধোঁকাগ্রস্থ হয়ে যেও না। আগে খোঁজ নাও শরিয়তের আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রে তার অবস্থান কেমন। এবং মনে রেখো, রাসূলের অনুসরণ ব্যতীত তরিকত মূল্যহীন, সমস্ত মরমিধারা বেকার।

সুফিবাদের সংস্কার

সুফিবাদের ক্ষেত্রে থানবির সংস্কারকে অনেকে যুগোপযোগী অভিধায় নির্দিষ্ট করতে চান। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তিনি সুফিবাদকে যুগের উপযোগী করেননি; বরং ইসলামের তাজকিয়া-কার্য থেকে মধ্যকালীন মরমিবাদ হটিয়ে সেটিকে প্রথমকালের নিরেট শুদ্ধাচারে রূপান্তরিত করেছিলেন, এবং প্রত্যাবর্তিত করেছিলেন রাসূলের আদর্শে।

সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি লেখেন, থানবির আন্দোলন থেকে হিন্দুস্তান সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে আকিদার বিশুদ্ধির ক্ষেত্রে, নিষ্কলুষ অন্তরে আমল করে আল্লাহর দিকে মুখাপেক্ষী হবার শিক্ষায়। মানুষ তার রচনাবলির মাধ্যমে যে পরিমাণ উপকৃত হয়েছে, তার তুলনা মিলেনা অন্য কোনো আলেমের রচনায়। তাজকিয়া ও ইহসানের সহজায়ন ও খাঁটিত্ব আনয়নের ব্যাপারে আল্লাহ তাকে বিশেষ তাওফিক দিয়েছিলেন। তিনি রীতিমতো একজন ইমাম ও মুজতাহিদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন বলা চলে। একপর্যায়ে আলেম ও গুণীজনরা এ ক্ষেত্রে তার অনন্যতার স্বীকৃতি প্রদান করেন। তিনি তাসাউফের শিক্ষা দিতে গিয়ে—এর গুরুত্ব ও সর্বক্ষেত্রে এর উপযোগিতা বোধগম্য করানোর জন্য একাধারে হাতে-কলমে শেখাতেন, রচনা করতেন এবং বক্তৃতা দিতেন। তার পদ্ধতির সুফল এল দ্রুতই। বিবিধ পেশা ও অঞ্চলের মানুষজন ছুটে আসতে লাগলো—যারা হয়তো পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে বিপন্ন হয়েছিল, বা আধুনিক ধর্মদ্রোহী চিন্তাধারার শিকার হয়েছিল, অথবা ঝুঁকে পড়েছিল নাস্তিকতার দিকে। এছাড়াও তার ছায়ায় আশ্রিত হয়েছিল বেকার, চাকুরীজীবী, মূর্খ, বুদ্ধিজীবী, গরীব, ধনী নির্বিশেষে সকলে। এভাবেই তখনকার বস্তুবাদী আগ্রাসনের পৃথিবীতে ইসলামের আত্মিক শুদ্ধাচার কর্মের একটা অটল সাম্রাজ্য দাঁড়ায় ভারতবর্ষে, সেটি প্রতিষ্ঠা পায় আধুনিক সংস্কৃতির বিপুল স্রোতের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থানে। তার সুফিতাত্ত্বিক বিদ্যাপীঠ–খানকাহে এমদাদিয়া থেকে একশ চল্লিশজন বড় মনীষী আধ্যাত্মিক শিক্ষালাভ করে বের হয়েছিলেন। তাদের মধ্য থেকে প্রসিদ্ধ কয়েকজন হলেন—সাইয়েদ সুলাইমান নদভি, মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানী—যিনি ছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাতাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, মাওলানা যফর আহমদ থানভী—যিনি পাকিস্তানের মহান আলেম ছিলেন, মাওলানা অসিউর রহমান, মাওলানা আবদুল বারী নদভি।

সংস্কারখাতে থানবির মৌলিক চিন্তা নিয়ে কথা বলার পূর্বে দেখে নেয়া যাক সংস্কারক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার শর্তগুলো কী—যেগুলো তালিকাবদ্ধ করেছেন ইবনে হাজার আসকালানী, সুয়ুতি, মুনাবি ও অন্যান্যরা।

সেগুলো হল:

১. তিনি সুন্নাহর অনুসারী হবেন, বেদাতি নন।
২. তিনি সুন্নাহর পুনর্জাগরণ করবেন, বিদূরিত করবেন বেদাত।
৩. জ্ঞানের উচ্চতার ক্ষেত্রে তাকে থাকতে হবে সুপ্রসিদ্ধ।
৪. সেই জ্ঞানকে কাজে লাগাবেন তিনি হক প্রতিষ্ঠা ও বাতিলকে রোধ করার মিশনে।
৫. এই প্রসিদ্ধি হতে হবে সংস্কারহীন কোনো এক শতাব্দীর সূচনায়।
৬. ইসলামে অনুপ্রবিষ্ট সকল অনাচার দূর করবেন তিনি এবং সাধারণ মানুষ যেসব বিষয়ে হোঁচট খায় সেখানে হোঁচট খাবেন না।
৭. তার দৃষ্টিভঙ্গি হবে হিকমত ও প্রজ্ঞার, মৌলিক পয়েন্ট কখনো তার দৃষ্টিছাড়া হবেনা শরিয়তের বহুবিধ বিষয়ে।
৮. মানুষ তার রচনাবলির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে হবে।

এ সকল শর্ত সামনে রেখে থানবির জীবনকে মেলালে একটিও বাদ পড়বে না। কারণ সকল শর্তের প্রতিটিই ছিল তার জীবনের ঐতিহাসিক সত্য। তার জীবনীকারদের বক্তব্য পড়ে দেখা যেতে পারে। তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন এসব ক্ষেত্রে তাঁর অনন্যতার কথা। আবুল হাসান আলি নদভি বলেন, থানবির আন্দোলন থেকে হিন্দুস্তান সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে আকিদার বিশুদ্ধির ক্ষেত্রে, নিষ্কলুষ অন্তরে আমল করে আল্লাহর দিকে মুখাপেক্ষী হবার শিক্ষায়। মানুষ তার রচনাবলির মাধ্যমে যে পরিমাণ উপকৃত হয়েছে, তার তুলনা মিলেনা অন্য কোনো আলেমের রচনায়।

সাইয়েদ সুলাইমান নদভি লেখেন, হাকীমুল উম্মত, মুজাদ্দেদে তরীকা, আলিমে রব্বানী শাইখ আশরাফ আলি থানবি ফিকহ আর তাসাউফের মধ্যকার বহু শতাব্দীব্যাপি চর্চিত বিভেদ ও সংঘাত মিটিয়েছিলেন আপন রচনাবলি ও বক্তৃতার মাধ্যমে। আল্লাহ তার বয়ান, রচনা ও ব্যাবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল মানুষকে উপকৃত করেছেন। তিনি ঈমানের রুহ ও সারবত্তা তুলে ধরতেন তাদের সামনে, ফিকহি মাসআলার জটিলতা ভেঙে দিতেন, সুফিবাদের গভীর বিষয়াদি সহজ করে তুলতেন; সর্বোপরি আল্লাহপ্রদত্ত প্রজ্ঞার বিতরণ করতেন। আলেমরা তাকে হাকীমুল উম্মত (জাতিসত্তার চিকিৎসক) নামে ভূষিত করেছিলেন। এবং তিনি হকদারও ছিলেন বাস্তবিকভাবে এই ভূষণের। ইসলামি সুফি ধারার বিশুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অপরিসীম।

সুফিবাদের সংস্কারে তার চিন্তাধারা

থানবির সময়কালে হিন্দুস্থানের বিভিন্ন ভ্রান্ত সুফিয়ানা বলয় ও গোষ্ঠী ছিল, যারা তাসাউফ বলতে শুধু কিছু রেওয়াজ, অতি মানবীয় বিশ্বাস বা কুরআন সুন্নাহ বহির্ভূত আকিদা ছাড়া আর কিছুই বুঝতো না। তিনি সেই প্রেক্ষাপটে যা কিছু সংস্কার এনেছিলেন, সেগুলোই আমাদের এই লেখার মৌলিক আলোচ্য ও শেষ আলোচনা।

ক. তাসাউফের হাকিকত

তার সময়ের মানুষরা তাসাউফ নিয়ে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত ছিল। একদলের দাবি থাকতো তাসাউফ বেদাত—কুরআন সুন্নাহর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যদল বিশ্বাস করত, তাসাউফ মানে শুধু কিছু জিকির, মুরাকাবা, কাশফ, ইলহাম, আত্মিক উপলব্ধি বা ঊর্ধ্বজাগতিক বোধ; এবং এগুলোই ইসলামের আসল উদ্দেশ্য—যারা এগুলো করতে পারে তাদের উপর শরিয়তের বাধ্যবাধকতা থাকে না। তখন তার থেকে ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক বিভিন্ন অবস্থা প্রকাশিত হয়, বিভিন্ন কারামত প্রকাশ পায়। এবং সেটাকেই তারা ধর্মীয় অগ্রগতির চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য করতো।

তখন তিনি উভয় প্রান্তিকতার বিরুদ্ধে উচ্চকিত হলেন বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যাবহারিকভাবে। তার গ্রন্থ, বয়ান, বক্তৃতায় বলতে থাকলেন, তাসাউফ বা ইহসান শরিয়তের অন্তর্গত এক বিধানের নাম; আর কাশফ, অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি, মহাজাগতিক স্বপ্ন বা শরিয়তের মারফতি সীমালংঘন ইসলাম বহির্ভূত সংস্কৃতি। এগুলো ইসলামে অনুপ্রবিষ্ট অনাচার। তাজকিয়ার সাথেও এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই।

তাসাউফের আসল উদ্দেশ্য হল জীবনের বাহ্যিক ও ভেতরগত বিশুদ্ধ বিনির্মাণ। বাহ্যিক শুদ্ধতা আসে নেক কর্মের মাধ্যমে। আর ভেতরগত শুদ্ধতা আসে আল্লাহর স্মরণ, উত্তম আখলাক অর্জন, মন্দাচার থেকে মুক্ততা এবং শরিয়ত ও সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যের মাধ্যমে। এ সবের পর যদি আল্লাহ তার অন্তরে বিশেষ কোনো অবস্থা অবতীর্ণ করেন, তবে সেটা আল্লাহ প্রদত্ত একান্ত রহমত। আর যাদের চরিত্র বিনষ্ট হয়ে গেছে, বঞ্চিত রয়েছে যারা মানবিক গুণাবলি থেকে, তারা আসল তাসাউফ ও সুলুক থেকে হাজার ক্রোশ দূরে—যতই তারা আকাশে উড্ডয়ন বা উপকরণহীনভাবে জলের উপর পদব্রজ করুক। মাওলানা থানভী লেখেন, তাসাউফের প্রকৃত সারবত্তা হল, কুরআন সুন্নাহর জ্ঞান, জীবনের বাহ্যিক আভ্যন্তরীণ প্রতিটি ক্ষেত্রে সেগুলোর সফল বাস্তবায়ন এবং পূর্ণাঙ্গ তাকওয়া অর্জন। যে সমস্ত এলহাম, কাশফ, অন্তর্জাত ও ঐশী উপলব্ধির চিন্তা-দর্শন সমাজে প্রচলিত—সে সব তাসাউফের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুলুকের পথেও সেগুলো কাঙ্খিত না। অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক জিকির, তাকওয়া ও অন্তরের প্রবৃত্তি থেকে মুক্তির মাধ্যমে সেগুলো অনিচ্ছাকৃতভাবে অনেকের অর্জিত হতে পারে। তবে যতটুকু কুরআন সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্যশীল, সেটুকুই শুধু গ্রহণীয়; বাকিগুলো পরিত্যাজ্য। আর উদ্ভূত আধ্যাত্মিক ব্যাকুল-ব্যগ্র অবস্থাগুলো যদি নবীজির জীবনের সাথে খাপ খায়, তবে তা উত্তম। অন্যথায় এটি মূল্যহীন; কিন্তু যার মাঝে এটি প্রকাশ পায় তাকে তিরস্কার করা যাবেনা—কারন সে আত্মনিয়ন্ত্রনের বেষ্টন থেকে বেরিয়ে গেছে।

তিনি বলেছিলেন, আমি বিশ্বাস করি, কুরআন সুন্নাহর জ্ঞানই ওলিত্বের চূড়ান্ত অর্জন, সুফিবাদের সর্বোত্তম মর্তবা।

তার মুরিদ আবদুল বারী নদবী লেখেন, বর্তমানে আলেমদের মানসিকতায় প্রবিষ্ট একটা গুরুতর ভুল ধারণা হল, প্রচলিত সুফিতাত্ত্বিক চিন্তাধারা ও পন্থাই বুঝি প্রকৃত তাসাউফ। এ কারণেই ইশরাকি দর্শনের অনুসারীরা (Illuminationists) এবং ব্রাহ্মণ সাধু ফকিররা মুসলিম সুফিদের বলয়ে নিজেদের আবিষ্কার করতে পেরেছে। এই ধারার প্রধানতম স্লোগান ছিল ‘সুফিবাদের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম ও ধর্ম নেই’। এই মতাদর্শের প্রভাবে তাসাউফ নির্দিষ্ট ধর্মের শৃংখল থেকে স্বাধীন হয়ে পড়ে। ইসলাম ছাড়াও অপরাপর যে কোনো ধর্মবিশ্বাসের আনুকূল্যে এই নাম প্রবাহিত হয়। কিন্তু আদতে এই চিন্তার ধারকদের মতাদর্শ, বাহ্যিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে আরও ঊর্ধ্বের মহিমান্বিত এক বিষয় হল সুফিবাদ। অবশ্যই সে সব উদ্ভট বিশ্বাস ভ্রষ্ট আকিদা–ভ্রান্ত দাবি।

থানবিও এ মতাদর্শের অস্বীকারে বলেন, প্রতিটি অন্তর্মুখী অভিযাত্রা—প্রতিটি আত্মিক পরিশোধন কর্মই তাসাউফ নয়। তাসাউফ শুধু সেটাই যা ইসলামি শরিয়তের সমস্ত হুকুমের অনুগত। তাসাউফ হল সেই আধ্যাত্মিক প্রয়াস যা আখেরাতে মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসবে, যার মাধ্যমে লাভ করা যাবে জান্নাত। তাসাউফ হল সেই তাজকিয়ার নাম। কুরআনে এসেছে—সফলকাম তারাই, যারা আত্মার তাজকিয়া করে, অন্তরকে বিশুদ্ধ করে। আর সফলতা আসে শুধু শরিয়তের আনুগত্যের মাধ্যমে, তার অন্যথা করার মাধ্যমে নয়।

ব্রাহ্মণ সুফি সাধকদের দৈহিক অনুশীলন ও অন্যান্য আচার তাসাউফের অন্তর্ভুক্ত না, মুসলিম সুফিদের অনেকেই সেগুলোর চর্চা করে। যতই দাবি করা হোক, যতই সেগুলোর উপর তাসাউফ নামের প্রলেপন দেয়া হোক, সেগুলো অর্থহীন। তাসাউফে সেগুলোর সামান্যতম মূল্যও নেই। সারহীন কিছু বিশ্বাস, কিছু কর্মের সমষ্টি সে সব। আল্লাহর দরবারে অগ্রহণযোগ্য। আর শরিয়তের বিরুদ্ধ পথে হেঁটে কেউ আল্লাহর রহমত ও জান্নাত লাভ করতে পারে না।

থানবির রচনাবলির সমগ্র দেহে এই শুদ্ধ বিশ্বাসের সমর্থন আছে। তিনি এই চিন্তাধারা প্রকাশ করেছেন তার গ্রন্থ ও বয়ানসমগ্রে—কুরআন সুন্নাহর দলিল, সাহাবায়ে কেরামের জীবনপন্থা ও সুস্থ বিবেকের বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে। তার কাছে যে কেউ বায়াত গ্রহণের জন্য এলে সর্বপ্রথম তিনি তাকে ফরজ ওয়াজিবের মান্যতার আদেশ দিতেন, বলতেন–মানুষের সাথে পারস্পরিক বোঝাপড়া উত্তমতা ও সৌন্দর্যের চর্চা করো।

খ. বায়াতের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু

যখন মানুষের আকিদা বিশুদ্ধ হয় এবং শরিয়তের ব্যক্তিকেন্দ্রিক হুকুম তার জানা থাকে, তখন কোনো শায়খের হাতে বায়াত নেয়া মুস্তাহাব। সেই শায়েখ হবেন দ্বীনের উপর দৃঢ়পদ, দুনিয়ার ব্যাপারে অনাকাঙ্ক্ষী, সর্বপ্রকার অনিষ্টতা থেকে সম্পর্কহীন। মানুষ তার হাতে হাত রেখে জিকির ও ধ্যানের শপথ নেবে, অর্জন করবে ইহসান।

মাওলানা থানবি বায়াতকে শায়খ আর মুরিদের মধ্যকার একটা আত্মিক বন্ধন–হৃদয়জ আত্মীয়তা হিসেবে দেখতেন। সেখানে শায়েখ সত্য ন্যায়ের পথ প্রদর্শন করেন, আর মুরিদ অনুসরণ করে তাঁর প্রদর্শিত পথ। থানভী এই বায়াত-ব্যবস্থার বাহ্যিক রূপটাকে আবশ্যক মনে করতেন না।

তিনি লেখেন, বায়াতের আছে দুটি সত্য—অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক। আভ্যন্তরীণ রূপ হল—পীর আর মুরিদের মধ্যকার আত্মিক সম্পর্ক, যদিও উভয়ই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। আর যদি আত্মিক সম্পর্কটি হয় নবী আর উম্মতের মাঝে, তখন নবীর ভূমিকা থাকে ধর্ম প্রচার, উম্মতের কর্তব্য থাকে সেই দাওয়াত গ্রহণ ও ঈমান আনয়ন। নবীর দাওয়াতে সাড়া দেয়ার যে বায়াত, তার কাঙ্খিত আবশ্যকীয়তা হল ইসলামের সকল বিধানের আনুগত্য ও মান্যতা। আভ্যন্তরীণ বায়াতের পূর্ণাঙ্গ রূপ ও উদ্দেশ্য এটুকুই। প্রসিদ্ধ একটা বক্তব্য আছে—যার মুরুব্বী নেই তার মুরুব্বী শয়তান। এখানে মুরব্বির অর্থ হল নবী। সাধারণ উম্মতের কোনো সাধারণ মুরুব্বী সেখানে উদ্দেশ্য নয়—যদি বক্তব্যটি আসলেই হাদিস হয়ে থাকে। নবীর সাথে প্রতিটি উম্মতের এই আত্মিক সম্পর্ক নির্মাণ করা ফরজ। এর পরবর্তীতে হাতে হাত রেখে প্রথম বায়াতের দৃঢ়তা প্রণয়নের জন্য যে বায়াত গ্রহণ করা হত, তার নাম বায়াতে ঈমান। যেমন উবাদা বিন সামেত থেকে বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেন, একবার রাসুলের চতুর্পাশে একদল মানুষ উপবিষ্ট ছিল, সে সময় রাসুল বললেন–আমার থেকে বায়াত নাও… তখন আমরা ইসলামের যাবতীয় বিষয়ের মান্যতার উপর বায়াত নিলাম। পক্ষান্তরে যদি আত্মিক সম্পর্কটি হয় উম্মতেরই দুটি সদস্যের মাঝে, নবুয়তের পরবর্তীকালে যা সংঘটিত হয়ে থাকে ‘পীর-মুরিদী’ নামে, তাহলে সেটির মৌলিক উদ্দেশ্য হল ইসলামি ও ঈমানী বন্ধন সৃষ্টি করা। এই বায়াত ফরয-ওয়াজিব বা সুন্নত হবার পক্ষে কোনো দলিল নেই। নবীজি থেকে সাব্যস্ত হওয়ার কারণে সর্বোচ্চ মুস্তাহাব। যারা এই বায়াতকে ফরজ বা ওয়াজিব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান কুরআনের ‘তোমরা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার মাধ্যম তালাশ করো’ – বক্তব্যের দলিল উপস্থাপন করে, তারা কুরআনের ভুল ব্যাখ্যায় লিপ্ত। এই আয়াতের অর্থ, তোমরা আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য সন্ধান করো। অন্যদিকে এই বায়াতকে সুন্নতে মুয়াক্কাদাও বলা যাবে না। কারণ এটি নবীজির সর্বকালীন জীবনপন্থা ছিল না। হঠাৎ হঠাৎ তিনি বায়াত করেছেন সাহাবিদের। অসংখ্য অগণিত সাহাবি এমন ছিলেন যারা এই নির্দিষ্ট বায়াত গ্রহণ করেননি নবীজি থেকে।

এই হল আভ্যন্তরীণ রূপ। আর বাহ্যিক রূপ হল, হাতে হাত রেখে বা কাপড় স্পর্শ করে আধ্যাত্মিক বায়াত। এটির হুকুম—এটি বৈধ, মুস্তাহাব বা সওয়ার কাজ না। কারণ, নবীজির থেকে এই বায়াতের যে সমস্ত বর্ণনা পাওয়া যায় সেগুলো তার ইবাদতকেন্দ্রিক কর্ম ছিল না, বরং ছিল স্বাভাবিক একটি কার্যক্রম। মানসিক অভ্যাসের অনুগামী। আরবদের মাঝে যে কোনো চুক্তির ক্ষণে হাতে হাত রেখে দৃঢ়তা আনয়ন একটি প্রচলিত স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হত।

তিনি এ ব্যাপারে আরও বলেন, পীর মুরিদের মাঝে এই যে বাহ্যিক বায়াত, এর হুকুম সর্বোচ্চ বৈধ। আর আভ্যন্তরীণ বায়াতের হুকুম সর্বোচ্চ মুস্তাহাব। বায়াত নিয়ে বাড়াবাড়ি বা মতাদর্শ লালন যে, এটিই পরকালীন মুক্তির শর্ত এবং এর পরিত্যাগকারীকারীকে ভর্ৎসনা করা হল—দ্বীনের বিষয়ে সীমালংঘন। যদি কেউ বায়াত ছাড়াই পুরো জীবনটা কাটিয়ে দেয়, কোনো ওস্তাদ থেকে দ্বীনের পূর্ণ জ্ঞানার্জন ও ইখলাসের সাথে সেগুলোর উপর আমল করে, সে নাজাত লাভ করবে এবং আল্লাহর নৈকট্য পাবে। তবে অভিজ্ঞতার ফলাফল হল, একজন আধ্যাত্মিক মুরুব্বী ছাড়া দ্বীনের ক্ষেত্রে অবিচলতা অর্জিত হয় না; এবং সে ক্ষেত্রে শুধু সোহবত সংস্পর্শই যথেষ্ট। বায়াতের বাধ্যবাধকতা নেই।

আমল ও সত্যাশ্রয়ী জীবনযাপন ছাড়া শুধু বায়াত বিশেষ উপকার বয়ে আনে না। থানবি বলতেন, কিছু মানুষের ধারণা, শাইখ বুঝি মুরিদকে এক পলকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছে দেন। বিষয়টি যদি এমনই হত, তাহলে সাহাবায়ে কেরামের কোনো পরিশ্রমের দরকার পড়ত না ইসলামের ক্ষেত্রে। কারণ রাসূলের চেয়ে অধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ব উম্মতের মাঝে নেই। এই তড়িৎ পরিপূর্ণতার চিত্র যদিও কদাচিৎ সংঘটিত হয়েছে অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাচক্রে, কিন্তু তার উপর ভিত্তি করে সামগ্রিক মূলনীতি প্রণয়ন করা যাবে না। কারণ কারামত সর্বকালীন নয়। মানুষ কারামতের উপর নির্ভরশীল হলে, তা হয় বৃহৎ অনাচার।

তিনি সারহীন এই সম্পর্ক– আমলহীন প্রচলিত বায়াতের সমালোচনা করতেন। বলতেন, আমি আশ্চর্য হই মাঝে মাঝে কিছু মানুষের আচরণ দেখে। তাদেরকে আমল করতে বলা হলে নাখোশ হয়, তারা শুধু ‘বায়াত’ সনদটুকু কামনা করে। এ কারণেই যে সমস্ত পীর আমলহীন শুধু বায়াতের সনদ দিয়েই ছেড়ে দেয়, তাদের মুরিদদের আনন্দ থাকে দেখবার মতো। কারণ আমল কঠিন, অন্যদিকে বায়াত-সংস্কৃতি হল শখের বিষয়। তাই আমি বায়াত করিনা; মুরীদদেরকে আমল করতে বলি। ফলশ্রুতিতে তারা অন্তরে আমার প্রতি অসন্তোষ পুষে রাখে।

গ. জিকির নিয়ে কিছু কথা

অনেকের ধারণা, শুধুমাত্র জিকিরের মাধ্যমেই আমল-আখলাক এর বিশুদ্ধতা অর্জন হয়ে যায়। তাদের দলিল হল সেই হাদিসে কুদসি, যেখানে আল্লাহ বলেন—‘আমি জিকিরকারীদের সঙ্গী’। এ হাদীসের সারকথা হিসেবে তারা বলেন, জিকিরের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নিকটবর্তী হয়; আর বান্দা যখন আপন রবের নিকট অবস্থান করে তখন সে গুনাহে লিপ্ত হতে পারেনা। মূর্খ সূফীদের মাঝে এই মতাদর্শের ব্যাপক প্রসিদ্ধি আছে। তারা ভাবে, জিকির হল পীরের কাছ থেকে পাওয়া এক মহাক্ষমতা। এটি থাকলে আর কোনো শুদ্ধাচারের প্রয়োজন নেই।

থানবির সিলসিলায় জিকিরের অবস্থান তৃতীয় পর্যায়ে। তার প্রথম লক্ষ্য ছিল শরয়ী আমলের পর্যালোচনা এবং মনুষ্যত্বের দীক্ষাপরবর্তী অনুশীলন। যারা জিকিরকে চূড়ান্ত অর্জন হিসেবে দাঁড় করাতে চাইতেন, তিনি তাদের খণ্ডন করে প্রায় বলতেন, জিকিরের ক্ষেত্রে এমন মনোভাব লালন করা জঘন্য ভুল। কোনো হাদিসে উল্লিখিত আল্লাহর স্মরণের অর্থ হল–অন্তরের ক্রমাগত পরিশোধনের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত হবার প্রয়াস। সুতরাং জিকিরের কথা বলে অন্তরের পরিশোধন ও নফসের এসলাহকে নাকচ করা যাবে না।

জিকির অজিফা ইত্যাদি তাঁর কাছে পরিগণিত হত শুধুমাত্র আমল ও আত্মিক সংশোধনের মাধ্যম হিসেবে।

ঘ. মুজাহাদার স্বরূপ

মুজাহাদা হল মন্দ প্রবৃত্তির সঙ্গে ক্রমাগত বিরুদ্ধাচরণের সাধনা। ইসলামে একে গণ্য করা হয়েছে নফসের জিহাদ নামে। মাওলানা থানবি মুজাহাদা সম্পর্কে লেখেন, মানবের আত্মিক চাহিদা দুটি খাতে প্রবাহিত—প্রাপ্য হক ও আকাঙ্ক্ষিত মনোলিপ্সা। প্রাপ্য হক পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে হবে; এটি ছাড়া দেহ দুর্বল হয়ে যাবে। কারণ দেহের চালিকাশক্তি এর থেকেই অর্জিত হয়। অন্যদিকে আকাঙ্ক্ষা করতে হবে পরিত্যাগ। কারণ এটি অতিরিক্ত, এটি ছাড়াও জীবন স্বাচ্ছন্দভাবে চলতে পারে। মুজাহাদার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হল, প্রাপ্য হক গ্রহণের পর আকাঙ্ক্ষিত মনোলিপ্সার বিবর্জন।

তবে মুজাহাদার বিষয়ে অতিরঞ্জন বা ছাড়াছাড়ি—উভয় সংকটের ক্ষেত্রেই তিনি বিরোধ অবলম্বন করেছিলেন। জীবনের মৌলিক চাহিদার সাড়া দিতে তিনি যেমন তাগাদা দিতেন, উগ্র সাধু ফকিরদের ক্ষুৎপিপাসায় কাতর বিপন্ন সাধনাপন্থা অনুগমনের ক্ষেত্রেও তেমনি প্রদান করতেন বাধা। অতিরঞ্জিত সাধনার বিষয় তিনি লেখেন, সুফিরা একপর্যায়ে ভাবতে লাগলো, অন্তরের ঘোর বিরোধীতার মধ্য দিয়েই শুধু আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়। এই বিরোধিতা যত বেশি প্রকট হয়–যত আধিক্যের ইন্ধন লাভ করে, নৈকট্যও সেই অনুপাতে বৃদ্ধি পায়; যদিও শরিয়ত সেটাকে সেই স্বরূপে সমর্থন না করে। তাদের অনেকে নিজেদের জন্য হারাম করে নিয়েছিল আহার্য মাংস, সুপেয় ঠান্ডা পানি। পাপ হিসেবে গণ্য করেছিল কোমল বিছানায় শয়নকে। ইসলামের বৈধ সৌন্দর্যগুলোকে তারা হারাম সাব্যস্ত করেছিল। ক্রমশ তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রক্তরসহীন হয়ে শুকিয়ে গেলে তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকলো। এমনটিই ছিল তাদের আধ্যাত্মিকতার চরম বাস্তবতা।

থানবি এ সমস্ত সীমালঙ্ঘনকে মূর্খতা ও অন্ধত্ব হিসেবে দেখেছিলেন। এগুলোর কোনো অতীত সমর্থন পাওয়া যায়না প্রথম কালের সুফিদের নিরেট ইতিহাসে। তারা মুজাহাদা করতে গিয়ে শরিয়তের অন্যথা করত না। এগুলোকে তারা অন্তরের কলুষ-ব্যাধির পথ্য ও চিকিৎসা মনে করত। কোনো খাদ্যে ক্ষতির দিক থাকলে শুধু পরিত্যক্ত সেটা। স্বাস্থ্যগত ক্ষতি আর এই খাদ্য পরিত্যাগকে তারা পুণ্য ভাবতো না। যারা খাদ্য-পানীয় বিবর্জিত জীবনকে নেক কাজ ভাবত তারা অবশ্যই গুনাহে লিপ্ত ছিল। কারণ তারা ইসলামি শরিয়তের মাঝে এমন বিষয় প্রবিষ্ট করতে চাচ্ছিল যা শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত নয়। সেগুলো সুস্পষ্ট বেদাত। পূর্ববর্তী সুফিরা খাদ্য-পানীয় পরিত্যাগ করত শুধুমাত্র রোগ বা দৈহিক ক্ষতির বিবেচনায় কদাচিৎ। আর পরবর্তী উদ্ভ্রান্ত সাধকরা এগুলোকে মনে করত ইবাদত, আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম।

ঙ. তপস্যার ইসলামি ব্যাখ্যা

আরবিতে তপস্যার প্রতিশব্দ হল জুহদ। তপস্যার ব্যাখ্যায় গোঁড়া সুফিদের বক্তব্য ছিল পৃথিবী ও তার যাবতীয় অনুষঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্নতার, সমস্ত সম্পর্ক থেকে পলায়নের। মাওলানা থানবি সে ক্ষেত্রে লিখলেন, সেই সুফিদের জন্য আফসোস হয় আমার— তাসাউফটাকে যারা অচল মুদ্রার মত মূল্যহীন বানিয়ে ছেড়ে গেছে। সুফি বৃত্তটাকে পরিণত করেছে জনমানবহীন গহীন জঙ্গলের মতো। তারা মানুষকে পর্বতচূড়ায় ধ্যানমগ্ন হতে প্রলুব্ধ করত, আদেশ দিত বিবাহ ও আত্মীয়-স্বজন থেকে চিরকালীন দূরত্বের ব্যাপারে। তারা চারটি করে মটরশুঁটি নিয়ে প্রতিদিন একটি করে আহার করত। এবং বলতো, এই ত্যাগ ও অনাহার ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য পাওয়া যায় না। আমি ঘোষণা দিচ্ছি—পরিপূর্ণ আরাম আয়েশের মাঝে থেকে, আল্লাহ প্রদত্ত সচ্ছলতার সাথেই আল্লাহর নৈকট্য ও ওলীত্ব লাভ করা সম্ভব। তবে শর্ত হল, সেই আরাম-আয়েশে ডুবে থাকলে হবে না, কোনো শায়খের সংস্পর্শে এসে ইসলামের ব্যাবহারিক দীক্ষা ও অনুশীলন লাভ করতে হবে।

অন্যস্থানে তিনি লেখেন, সুফি হতে গেলে কারও তালি দেয়া চটের কাপড় দরকার হয় না। শুধু নিষ্কলুষ জীবনের ইচ্ছাটা করতে হয়, তার পদ্ধতি শিখতে হয় কোনো মহৎ আলেমের সান্নিধ্যে।

সুফিয়ান সাওরী বলেন, অতীতে সম্পদ অপছন্দনীয় মনে করা হত। কিন্তু আজকের দিনে তা মুমিনের ঢালস্বরূপ। আমাদের হাতে এই দিনারগুলো না থাকলে বাদশাহরা আমাদেরকে পরিত্যাজ্য রুমালের মতো ছুড়ে ফেলত। যার কাছে সম্পদ আছে, সে যেন সেটাকে কল্যাণকর জ্ঞান করে এবং কল্যাণের পথে ব্যয় করে। একটা সময় আসবে যখন দারিদ্রের কষাঘাতে নিজের ধর্মবিশ্বাসের শেষ রক্ষাটা আর হয়ে উঠবে না। সম্পদের হালাল ব্যয়কে অপচয় হিসেবে গণ্য করা হয় না।

তিনি আরো বলেন, দুনিয়া বিমুখতা বা তপস্যার অর্থ মোটা রুক্ষ কাপড় ও শুষ্ক খাবার নয়। তপস্যার মানে হল সম্পদকেন্দ্রিক দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষার সংকোচন।

থানবি লেখেন, কম আহার করা তপস্যা নয়। সেটা বলে বেড়ানোর মতো কোনো মহৎ বিষয়ও না। মানুষ যখন নিজের সক্ষমতা সত্ত্বেও আহার সংকোচন করে, তখন তা আল্লাহর ভান্ডারের খাদ্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে না—এটি মনে রাখতে হবে। তবে গলা পর্যন্ত আহার করাও উচিত না। ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কীর দর্শন ছিল, মানুষ আপন বৈধ চাহিদার সাড়া দেবে পূর্ণাঙ্গভাবে। পরিতৃপ্ত হবে আহারে। পরিশেষে সেই শক্তিকে ইবাদত ও কল্যাণকার্যে ব্যয় করবে। যখন কেউ জানতে পারে, তার জন্য স্বাদু খাবার প্রস্তুত করা হচ্ছে তখন আমল পূর্ণ করার ক্ষেত্রে একটা উদ্যম আসে তার মাঝে। অন্তর উৎফুল্ল হয় সেই খাবারের কল্পনায়। আর অন্তরকে সচল ও স্বতঃস্ফূর্ত রাখতে গেলে সর্বক্ষেত্রেই একটা চালিকাশক্তির প্রয়োজন পড়ে।

মাওলানা থানবি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন দৈহিক সুস্থতা ধরে রাখার বিষয়ে। তিনি খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে কোনো তপস্যা ও আধ্যাত্মিক বিমুখতার অস্তিত্ব স্বীকার করতেন না; কারণ সেগুলোর প্রতিঘাতে জন্ম নেয় মস্তিষ্কের নিষ্ক্রিয়তা। একইভাবে তিনি অতি আহারকেও অপছন্দ করতেন; যার প্রতিক্রিয়ায় হজমশক্তি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ঘুমের ক্ষেত্রেও তিনি একই মতাদর্শ লালন করতেন। বেশি ঘুমালে আলস্য সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে ঘুম বাদ দিয়ে দিলে মানসিক ঘোর ও মাদকাচ্ছন্নতা প্রকাশ পায়। এই দুই অবস্থার উভয়টিই অনুচিত।

চ. কাশফ ও কারামতের মর্তবা

থানবি বলেন, অনেকে কাশফ ও কারামতকে আল্লাহর নিকট বান্দার নৈকট্য ও অত্যুচ্চ পূর্ণতা ভাবে। যদিও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের ক্ষেত্রে এর কোনোই ভূমিকা নেই। কিছু মানুষের স্বভাবজাত যোগ্যতার অন্তর্গত থাকে এগুলো, কাকতালীয়ভাবেই এ সব তাদের প্রকৃতির সাথে আত্মীয়তা রাখে। যেমন কারও চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত দূর পর্যন্ত পৌঁছে, যে সময়টায় অন্যজন দৃষ্টিহীনতায় ভুগে। উদাহরণত মসজিদে অবস্থিত দুই ব্যক্তির একজনের দৃষ্টি বারান্দার পর আর স্পষ্ট দেখতে পায় না, অন্যজনের দৃষ্টি দূরের রাস্তা ছাপিয়ে আরো দূরে চলে যায়। তাহলে কি দ্বিতীয় ব্যক্তি আল্লাহর অধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত? বিষয়টি এমন না। বরং স্বভাবজাত অতিরিক্ত সক্ষমতার সাথে আল্লাহর নৈকট্যের কোনো সম্প্রীতি নেই। আমি শপথ করে বলতে পারি, একজনের ভাগ্যে অসংখ্য-অগণিত কাশফ অর্জিত হতে পারে; কিন্তু তার অন্তরে খোঁজ নিলে আল্লাহর দিকে অগ্রবর্তীতার সামান্যতম আভাসও পাওয়া যাবে না। তবে যদি সে তিন বেলা জিকির করে হৃদয়কে পরখ করে, দেখবে–আল্লাহর দিকে সামান্য হলেও অগ্রসর হয়েছে সে।

তিনি আরো বলেন, কীভাবে কাশফ ওলি হবার প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়, অথচ এখানে ঈমানটাই শর্ত না! যে কারও–যে কোনো ধর্মের অনুসারী বা ধর্মহীন কোনো ব্যক্তিরও কাশফ অর্জন হতে পারে। আদতে কাশফ মহৎ কোনো বিষয় না। কারণ কাফের-পাগল নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষই যদি তপস্যা-আরাধনা ও নির্জনবাস স্থায়ী হয়, তার হাসিল হয়ে যেতে পারে কাশফ। তাই এটির গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে ইসলামের আনুগত্য শর্ত, অন্যথায় এটি পরিত্যাজ্য।

কারামতের ক্ষেত্রে তার মতাদর্শ ছিল, কারামত শুধু সেটাই যা শরিয়তের পূর্ণ অনুসরণ থেকে প্রকাশিত হয় এবং যা সর্বকালীনভাবে ধারাবাহিক নয়। কারণ যখন তা সর্বকালীন হয়ে যায়, তা আর কারামত থাকে না। একইভাবে যদি তা শরিয়তের অনুগত না হয়, তাহলেও তা কারামত হিসেবে বিবেচিত হয় না। উদাহরণত যোগসাধনা বা জাদুর প্রভাবে সৃষ্ট অতি প্রাকৃতিক অবস্থা ও চিত্র। এগুলোকে ঊর্ধ্বকামিতা বলে, কারামত নয়। কারামত শুধুমাত্র শরিয়তের পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যের শর্তে আবদ্ধ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে অবস্থা এমন হয়ে গেছে, যে কারও থেকে অতিপ্রাকৃতিক অবস্থা প্রকাশ পেলেই তাকে কুতুব গাউস নামে ভূষিত করা হয়। তার বিশ্বাস, আকিদা বা কর্মপন্থা যাই হোক—সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা হয় না। অতীতের নেককার সূফীদের চিন্তাধারা ছিল, যদি কেউ শূন্যে ভাসতে থাকে, তাহলে তার এই অবস্থার গ্রহণযোগ্যতার জন্য শরিয়তের ক্ষেত্রে তারা আনুগত্যের বিষয়টিও সমানভাবে লক্ষণীয়। তারা বলতেন, অতি প্রয়োজন না হলে কারামত প্রকাশ করা অনুচিত।

তিনি আরো বলেন, অলি হবার জন্য অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা প্রবাহের প্রয়োজন নেই। বহু সাহাবি এমন ছিলেন তাদের থেকে কখনো কারামত প্রকাশিত হয়নি, অনেকের ক্ষেত্রে আবার শুধু এক দুবার প্রকাশিত হয়েছে। অতিপ্রাকৃতিক অবস্থা অধিকাংশ সময় যোগসাধনার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়। জিকিরের মর্তবা থেকে কারামতের মর্তবা বহু নিচে। ‘আওয়ারিফ’ গ্রন্থের লেখক বলেছেন, যাদের থেকে কারামত প্রকাশ পায় তাদের চেয়েও উত্তম হল যাদের থেকে তা প্রকাশিত হয়নি। সর্বশ্রেষ্ঠ কারামত হল শরিয়তের পথে অবিচল থাকা; সর্বোত্তম কাশফ হল মুরিদের অন্তরের প্রকৃত অবস্থান বুঝে সঠিক পথে তাকে পরিচালিত করতে পারা।

একদল সুফি আছে, যারা ঊর্ধ্বজগতে আলো দেখার ও শব্দ শোনার দাবি করে। তাদের ক্ষেত্রে থানবি বলেন, অনেকে নাকি জিকিরের সময় আরশের নূর দেখে, সেখানকার ধ্বনি শ্রবণ করতে পারে। এগুলো প্রহেলিকা ছাড়া আর কিছু না। প্রথমত, জিকিরের প্রতিক্রিয়ায় এ সব প্রভাবে সৃষ্ট হওয়া অবান্তর। প্রয়োজনও নেই। দ্বিতীয়ত, সাধারণত সে সব আলো ও ধ্বনি কল্পনার প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে—ঊর্ধ্বজগৎ বেয়ে নেমে আসা বাস্তবতা নয়। তৃতীয়ত, যদি বাস্তবিকভাবেই তা ঊর্ধ্বজাগতিক হয়ে থাকে তবুও কী লাভ সেখানে? ইহকাল-পরকাল এ দুটি ভিন্ন জগতের স্পর্শের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারে না। আল্লাহর নৈকট্যের নির্ধারিত শর্ত হল শরিয়তের আনুগত্য। শয়তান জীনও কদাচিৎ ফেরেশতার সাক্ষাৎ পায়, কিন্তু দিনশেষে সে শয়তানই থেকে যায়। একইভাবে মৃত্যুর পর কাফেরও পরকাল প্রত্যক্ষ করে, তবুও সে কাফের থেকে যায়। পরকাল দেখে বা শ্রবণ করে স্রষ্টার স্নেহ ও মায়া অর্জন করা যায় না।

উপসংহার

মাওলানা থানবির রাজনৈতিক দর্শন বা সুফিতাত্ত্বিক চিন্তাধারার প্রভাবে সৃষ্ট ইসলামি বিপ্লবী ধারার নিষ্ক্রিয়তার ক্ষেত্রে অনেকের নিজস্ব চিন্তা থাকতে পারে, সেসবের বিপক্ষে অভিমত হতে পারে। বাস্তবিকভাবেই নিষ্ক্রিয়তা এসেছে। দ্বিমত পোষণের সুযোগ আছে তাই সে ক্ষেত্রে। কিন্তু সুফিবাদের চিন্তাগত ও ব্যাবহারিক বৃত্তে তিনি মধ্যকালীন সমস্ত শৃংখলকে ছিন্ন করেছিলেন, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাসুলের আদর্শ। সুফিবাদের আলোচনায় থানভীকে প্রত্যাখ্যান করার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি বৈপরীত্য থাকাও অনুচিত। পীর মুরিদী সম্পর্কে তার ভাবনা, বায়াতের ক্ষেত্রে তার চিন্তাধারা আমাদের ঘোরলাগা দুঃস্বপ্নগুলোকে ঠেলে নতুনভাবে জাগতে শেখায়। সুফিবাদের পরিচ্ছন্ন আবহে পুনর্বার আমাদের সমন্বিত হতে উদ্বুদ্ধ করে তার বিশুদ্ধ নির্মল আহ্বান।

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করে প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান—পিছনে ফেলে অসংখ্য ভক্ত-মুরিদ ও খলিফা, একটি বিনির্মিত সফল আন্দোলনের সুফল ও কল্যাণ।

সুফিবাদের তাত্ত্বিক পর্যালোচনায় তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হল—
• শারহুল মাসনাভি লি-মাওলানা রুমি
• আত তানবিহুত তারবি ফি তানযিহে ইবনে আরাবি
• আল মুআমালা মাআল বাহালীল ওয়াল মাজাযীব ওয়াল বাল্লাহ
• আত তাশাররুফ বিমা’রিফাতি আহাদীসিত তাসাউফ
• আত তাকাশশুফ আন মুহিম্মাতিত তাসাউফ
• তারবিয়াতুস সালিক ওয়া তানজিয়াতুল হালিক; ইত্যাদি।

একজন থানবি উন্মত্ত সুফি ও তাদের উদভ্রান্ত জীবনপন্থাকে অস্বীকার করেছিলেন; সেই অস্বীকারের সৎসাহস তেমনি আমাদের অর্জন করাও প্রয়োজন। তার কর্মের তাত্ত্বিক পর্যালোচনা হওয়া দরকার আমাদের জ্ঞানবৃত্তিক সমাজে, দরকার তাঁর রচনাবলির বিস্তৃত পাঠ ও পর্যালোচনার। উপমহাদেশের শান্ত মৃত্তিকায় সুফিবাদের আত্মিক রূপটাকে তিনি ইসলামের যতটা গভীর সম্মোহনের রঙে চিত্রিত করেছিলেন, তার অর্ধভাগও বাস্তবায়ন করতে পারেননি বহু দেশের বিভিন্ন সংস্কারক। মানুষ থানবির চিন্তাকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছিল—বিভিন্ন ভাষা ও মাটির সর্বস্তরের জনমানুষ, মূর্খ জ্ঞানী ধনী গরিব নির্বিশেষে সকলে। তিনি বিংশ শতাব্দীর সংস্কারক। কালের মহাপুরুষ।

 

The post মাওলানা থানবির সুফি-দর্শন ও থানাভবনের বিপ্লব appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/sVlCbMx

No comments:

Post a Comment