Friday, April 17, 2020

মহামারীর ইসলামী ব্যাখ্যা : ধর্মীয় সমাজে দ্বিধা ও সংশয়

আবুল কাসেম আদিল

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে বাংলাদেশের আলেম সমাজকে এই বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত দেখা গেছে। ইসালামের সামাজিক আমল— যেমন জামায়াত ও জুমার ক্ষেত্রে করণীয় কী, এসব ব্যাপারে অনেককে সন্দিগ্ধ দেখা গেছে। এই দ্বিধা ও সংশয় যতটা না শাস্ত্রীয়, তারচেয়ে বেশি সামাজিক ব্যাপার। অর্থাৎ প্রথম দিকে এই বিষয়ে শাস্ত্রীয় তর্ক দেখা যায় নি। পরে অবশ্য শাস্ত্রীয় আলোচনা শুরু হয়। প্রথম দিকে যে দ্বিধা ও সংশয় দেখা গেছে, এটিকে সামাজিক বলছি এজন্য যে, আমাদের সামাজিক কাঠামোটাই এরকম, এখানে বিজ্ঞদের প্রসিদ্ধি কম। শুরুর দিকে একপাক্ষিক ও প্রান্তিক অশাস্ত্রীয় যেসব আলাপ-আলোচনা চলছিল, তাতে শাস্ত্রজ্ঞদের উপস্থিতি তেমন দেখা যায় নি। অথবা উপস্থিতি থাকলেও ‘বক্তা শ্রেণীর’ গলার নিচে তাদের কণ্ঠ চাপা পড়ে গিয়েছিল। কারণ আমাদের এখানে গবেষকের চেয়ে কথক বেশি। বেশি ও প্রসিদ্ধ। এটি একান্তই সামাজিক সমস্যা।

মহামারী বিষয়ক আলাপের যে সঙ্কট, তাতে যেমন এক শ্রেণীর আলেমের ভূমিকা আছে, তা থেকে উত্তরণ করে তাকে সঠিক পথে প্রবাহিত করার ক্ষেত্রেও আলেমদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আশার কথা হলো, সঙ্কট যেখান থেকে শুরু, সমাধানও এসেছে সেখান থেকেই।

বিশেষতঃ কয়েকটি বিষয়ে আলেমদেরকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখা যায়। ১. এটি আযাব না রহমত ও এতে মুমিনরা আক্রান্ত হবে কি না, ২. সংক্রামক রোগ বলতে কিছু আছে কি না, ৩. মসজিদ বন্ধ করা বা মসজিদে লোক সমাগম সীমিত করা যাবে কি না।

এটি আযাব না রহমত: এ-ব্যাপারে আলেমদের মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ অভিমত হলো, এটি মুমিনদের জন্য রহমত আর কাফেরদের জন্য আযাব। এর সপক্ষে তারা দু’টি হাদীস পেশ করেন। ১. “এটা হচ্ছে আযাব। আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা, এই আযাব দেন। তবে মুমিনদের জন্যে আল্লাহ একে রহমত বানিয়েছেন।” সূত্র: সহীহ বুখারী-৫৭৩৪। ২. “মহামারী আমার উম্মতের জন্য শাহাদাত ও রহমত। আর কাফেরদের জন্য আযাব।” সূত্র: মুসনাদে আহমাদ-২০৭৮৬, তাবরানী-৯৭৪।

যেহেতু এটি স্থির যে, মহামারী কাফেরদের জন্য আযাব আর মুমিনদের রহমত, এ-কারণে অনেকে এই মত ব্যক্ত করেছেন যে, এতে কেবল কাফেরেরা আক্রান্ত হবে; মুমিনেরা আক্রান্ত হবে না। তবে অধিকাংশ বিজ্ঞ আলেম এই অভিমত খণ্ডিত, অবাস্তব ও প্রশস্ত বিশ্বদৃষ্টির অভাব জনিত বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিজ্ঞ আলেমদের অভিমত হলো, এটি কাফেরদের জন্য আযাব ও মুমিনদের জন্য রহমত; এতদসত্ত্বেও মুমিনদের এতে আক্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁরা পাপমোচনের সুযোগ হিসেবে একে রহমত বলে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ মহামারীতে আক্রান্ত মুমিনের পাপ মোচন করা হবে। যেহেতু শুধু মুমিনের পাপ মোচন করা হবে, সেহেতু এটি মুমিনের জন্য রহমত। আর যেহেতু কাফেরের জন্য এমন প্রতিশ্রুতি নেই, সুতরাং এটি তাদের জন্য আযাব।

ব্যাপক মহামারীতে মুমিনেরও যে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, এর স্বপক্ষে তারা কুরআনের আয়াত পেশ করেন। যেমন: “তোমরা এমন ফিতনাকে ভয় কর যাহা বিশেষ করিয়া তোমাদের মধ্যে যাহারা যালিম কেবল তাহাদেরকেই ক্লিষ্ট করিবে না এবং জানিয়া রাখ যে, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।” কুরআন-৮/২৫।

মহামারীতে যে মুমিনেরাও আক্রান্ত হন বা হওয়ার সম্ভাবনার বাইরে নন, এর সপক্ষে বড় প্রমাণ হলো সাহাবীযুগের মহামারী। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা.-এর শাসনামলে ১৯ হিজরীতে তৎকালীন শাম (বর্তমান সিরিয়া, জর্ডান ও ফিলিস্তিন)-এ প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এতে আক্রান্ত হয়ে অনেক সাহাবী মারা যান। যারা মারা যান, তাদের মধ্যে আবু উবায়দা ইবনুল-জাররাহ, মুয়ায বিন জাবাল, ইয়াযিদ বিন আবি সুফিয়ান রা. বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এতে ইসলামী খিলাফাহর অসামান্য ক্ষতি হয়।

সংক্রামক রোগ বলতে কিছু আছে কি না: এ-ব্যাপারে অনেকের অভিমত, ইসলাম সংক্রামক রোগ স্বীকার করে না। কোনো রোগকে সংক্রামক মনে করা ইসলামী বিশ্বাসের পরিপন্থী। এর পক্ষে তারা সহীহ মুসলিমের ২২২২ নম্বর হাদীসটি উল্লেখ করেন। হাদীসটির প্রচলিত অর্থ হলো, “সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই।”

তবে বিজ্ঞ আলেমরা এই মতটিকেও প্রত্যাখান করেন। তারা এটিকে হাদীসের খণ্ডিত চর্চা বলে আখ্যায়িত করেন। কেননা, সংক্রামক রোগ সম্পর্কে অনেকগুলো হাদীস আছে। সেসব হাদীসের প্রতি লক্ষ না রেখে একটি হাদীসের আলোকে অভিমত দেয়া পদ্ধতিগতভাবে ভুল। হাদীসে বর্ণিত আছে— “রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, রুগ্ন উটের মালিক যেন রুগ্ন উটকে কোনোক্রমে সুস্থ উটের সাথে মিশ্রিত না করে।” সূত্র: সহীহ বুখারী-৫৭৭১।

অন্য হাদীসে এসেছে— “আমর সাকাফী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, “সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধি দলে একজন কুষ্ঠরোগী ছিল। তার কাছে রাসুলুল্লাহ সা. লোক পাঠিয়ে জানালেন, তোমাকে আমরা বাইয়াত করে নিয়েছি। তুমি ফিরে যাও।” সূত্র: সহীহ মুসলিম-৪২৫৬।

আরেক হাদীসে আছে— “কুষ্ঠরোগী থেকে এভাবে পলায়ন করো, যেভাবে তোমরা বাঘ থেকে পলায়ন করো।” সূত্র: মুসনাদে আহমাদ ৯৭২০।

এসব হাদীস দ্বারা বোঝা যায়, ইসলাম সংক্রামক রোগ স্বীকার করে। সেক্ষেত্রে আলেমরা “সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই”— এই হাদীস ব্যাখ্যাযোগ্য মনে করেন। ইমাম নববীর সূত্রে তারা উল্লেখ করেন, জাহিলি যুগে রোগের নিজস্ব সংক্রমণ-ক্ষমতা আছে বলে মনে করা হতো। রাসূল সা. তাদের এই ধারণা নাকচ করেছেন। সাধারণভাবে রোগের সংক্রমণ-ক্ষমতা নাকচ করলেও আল্লাহ যে রোগের জন্য চান, বিশেষভাবে সে রোগের সংক্রমণ-ক্ষমতা থাকতে পারে।

এ-ব্যাপারে সবচে সুন্দর ব্যাখাটা করেছেন উনিশ শতকের বিখ্যাত হানাফী আলেম আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ। এটিকে ব্যাখ্যা না বলে অবশ্য তরজমা বলাই শ্রেয়। তার মতে হাদীসটির অর্থ হলো, “তোমাদের কেউ যেন কারো মধ্যে রোগ সংক্রমণের কারণ না হয়, অর্থাৎ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি যেন সুস্থ ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশা থেকে বিরত থাকে। এই হাদীসে উল্লিখিত ‘লা’ শব্দটি নিষেধাজ্ঞাবাচক। যেমন: কুরআনে হাজ্বীদেরকে লক্ষ করে বলা হয়েছে, “হজ্বে কোনো অশ্লীলতা, অনাচার ও বাকবিতণ্ডা নেই।” অর্থাৎ হাজ্বীগণ অশ্লীলতা, অনাচার এবং বাকবিতণ্ডায় জড়াবে না। এই আয়াত এবং উপরোক্ত হাদীসের ধরন ও আঙ্গিক হুবহু এক। হজ্বে অশ্লীলতা নেই অর্থ যেমন হাজ্বীরা হজ্বের সময় অশ্লীলতায় জড়াবে না, তদ্রুপ সংমণ নেই মানে সংক্রমিত করবে না। এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে দুই বিপরীতার্থক হাদীসের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজনে যে ব্যাখ্যা করতে হয়, তারও প্রয়োজন হবে না।

মসজিদ বন্ধ করা বা মসজিদে লোক সমাগম সীমিত করা যাবে কি না: এ-সংক্রান্ত যে তর্ক, এটি একান্ত বাঙালি আলেমদের তর্ক নয়, এটি বৈশ্বিক তর্ক। বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এ-বিষয়ে আলেমদের ভিন্নমত রয়েছে। এক শ্রেণীর আলেম এ-ব্যাপারে কঠোর মনোভাব পোষণ করলেও তরুণ আলেমদের বড় অংশটি শুরু থেকে ইতিবাচক অবস্থান ঘোষণা করেছেন। আলেমদের পরামর্শে সর্বশেষ পুরোপুরি বন্ধ না করে উপস্থিতি সীমিতকরণ সম্পর্কে যে সরকারি নির্দেশনা, বলতে গেলে এতে আলেমদের তেমন দ্বিমত নেই। দু’-চারজনের ভিন্নমত দেখা গেলেও গরিষ্ঠ সংখ্যক আলেম সেই ভিন্নমতের সঙ্গে একমত হন নি। এক্ষেত্রে আলেমরা ইসলামের জননিরাপত্তার বিধান আরোপ করেন। নিরাপত্তার অভাব দেখা গেলে জামায়াতে উপস্থিতির বিধান রহিত হয়ে যায়। এ-সম্পর্কে স্পষ্ট হাদীস রয়েছে। নবী করীম সা. প্রবল বৃষ্টিপাতের সময় মুয়াজ্জিনকে আদেশ করেছেন, যেন তিনি আযানের মধ্যে ঘরে নামায পড়ার ঘোষণা করেন। এই হাদীস নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে ইসলামের সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টির পরিচয় বহন করে।

শীর্ষ আলেমদের যারা মসজিদে মুসল্লি উপস্থিতির ব্যাপারে সংখ্যাগত বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন, তারা মূলত অগ্রাধিকার বিষয়ক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এখনো পর্যন্ত ঘোষিতভাবে সারাদেশকে লকডাউন করা হয় নি। হাট-বাজার খোলা আছে। অর্থাৎ সংক্রমণের আরো একাধিক পথ খোলা রেখে মসজিদে মুসল্লি উপস্থিতি সীমিতকরণের যৌক্তিকতা তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাদের এই দাবি কতটুকু যৌক্তিক, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। তবে তাদের কথা দ্বারা বোঝা যায়, তারা মৌলিকভাবে মসজিদ পুরোপুরি খুলে দেয়ার কথা বলছেন না।

The post মহামারীর ইসলামী ব্যাখ্যা : ধর্মীয় সমাজে দ্বিধা ও সংশয় appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/3bh4vjj

No comments:

Post a Comment