রাকিবুল হাসান
করোনা ভাইরাস ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠছে এই দেশে। প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা। প্রেডিকশন বলছে—বাংলাদেশে আরও ভয়ংকর হতে যাচ্ছে ভাইরাসের নির্মম রূপ। যদি তাই হয়, তাহলে বড়সড় একটি বিপর্যয়ে পড়তে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু ইতোমধ্যেই প্রায় একমাস হতে চললো লকডাউনের সময়। দীর্ঘদিন ধরে আয়-রুজির পথ বন্ধ থাকায় হাহাকার বাড়ছে। পেটে টান পড়ছে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের। মানুষের এই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াচ্ছে মানুষ। সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলছে ত্রাণ বিতরণ। ইভেন্ট খুলে, কমিউনিটি তৈরী করে সেই ত্রাণ কার্যক্রমে যোগ দিয়েছেন আলেমগণও।
মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই কার্যক্রমে অন্যদের চেয়ে আলাদা মর্যাদা পাবে আলেমদের অবদান। মানুষকে ত্রাণ দেবার পাশাপাশি তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অংশ নিচ্ছেন করোনা ভাইরাসে মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনে। এই সংকটে জনসেবায় আলেমগণ কিভাবে অংশগ্রহণ করছেন, তার একটি দৃশ্যায়ন তুলে ধরছি এই লেখায়।
করোনায় মৃতদের দাফন-কাফন
যখন করোনায় মৃতদের মরদেহ ছুঁতে যাচ্ছে না স্বজনরাও, সংক্রমণের ভয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে দাফন-কাফন কার্যক্রম, তখনই এগিয়ে এসেছেন আলেমগণ। নিজেদের উদ্যোগে হাতে তুলে নিয়েছেন শরিয়তসম্মভাবে দাফন-কাফনের দায়িত্ব। পুরো বাংলাদেশে তৈরি করেছেন জেলা এবং থানা-ভিত্তিক দাফন-কাফন টিম।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নির্দেশনায় আল মারকাজুল ইসলামির নেতৃত্বে একদল আলেম কাজ করছেন দাফন কার্যক্রমে। সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হামজা শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের যেহেতু এখন ফান্ডিং নেই, তাই আমরা ত্রাণ দিতে পারছি না। কিন্তু, এই দুঃসময়ে দাফন-কাফনে আমরা এগিয়ে এসেছি, যেখানে কেউ এগুচ্ছে না।’
আল মারকাজুল ইসলামীর কাফন-দাফন দলের সদস্য মো. ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘আমরা নিজের স্বার্থে না, জনগণের স্বার্থে আল্লাহ-তায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য এ কাজ করতে শুরু করেছি। আমাদের এই টিমকে গঠন করা হয়েছে যেন সুন্দরভাবে জানাযা হয়, সুন্দরভাবে কাফন-দাফন হয়। এ জন্য ওলামায়েকেরামকে নিয়ে একটা টিম গঠন করা হয়েছে এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নির্দেশনায় আমরা কাজ করছি।’
তবে আরও বিস্তারিত পরিকল্পনা নিয়ে দাফন-কাফন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে আলেমদের দাতব্য সংস্থা ‘ইকরামুল মুসলিমিন ফাউন্ডেশন’। সংস্থাটির প্রচার সম্পাদক মাওলানা এহসান সিরাজ ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, ‘দাফন-কাফনের জন্য আমরা দেশব্যাপী টিম গঠন করেছি। চার-পাঁচটি জেলা বাদে প্রায় প্রতিটি জেলায় টিম গঠিত হয়েছে। এখন থানাভিত্তিক টিম গঠনের কাজ চলছে। মৃতব্যক্তির করোনা নিশ্চিত হলেই কেবল আমরা দাফন করতে যাই। প্রতিটি জেলার প্রশাসনে কাছে জেলাভিত্তিক টিমের যাবতীয় তথ্য দেয়া আছে। নিশ্চিত করোনা হলে প্রশাসন আমাদের ফোন করেন।’
বিশিষ্ট দাঈ মাওলানা গাজি ইয়াকুবের তত্ত্বাবধানেও চলছে দাফন-কাফন কার্যক্রম। তবে এই টিম মৃতব্যক্তির করোনা সন্দেহ হলেও দাফন-কাফন করতে যান। ঠিক একই পন্থায় কাজ করছেন আল মারকাজুল ইসলামির আলেমগণ। তারাও নিশ্চিত করোনা কিংবা করোনা সন্দেহ হলে দাফন কাফন করতে যাচ্ছেন।
ত্রাণ কার্যক্রমে আলেমগণ
ত্রাণ কার্যক্রমে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে নেই আলেমগণও। তবে আলেমগণ তাদের অধিকাংশ ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছেন আড়ালে-আবডালেই। সব ধর্মের মানুষের হাতেই তুলে দিচ্ছেন ত্রাণ-সহায়তা। ত্রাণ কার্যক্রমে নিজেদের সুন্দর একটি ব্যবস্থাপনার কথা জানালেন ইকরামুল মুসলিমিনের প্রচার সম্পাদক মাওলানা এহসান সিরাজ। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথম চাল-ডাল ইত্যাদি দিয়ে ত্রাণ দেয়া শুরু করেছিলাম। এখন সবাইকে টাকা দিয়ে দিচ্ছি। আমরা আমাদের জেলাভিত্তিক টিম থেকে ডাটা গ্রহণ করছি। যারা ত্রাণ পাবার যোগ্য, তাদের একটি বিকাশ একাউন্ট নম্বর নিচ্ছি। যাদের বিকাশ নেই, বিকাশ করিয়ে নিচ্ছি। এতে সুবিধা হলো—যারা ত্রাণ-মুখাপেক্ষী, তাদের ডাটাগুলো আমাদের কাছে থাকছে। কেউ যদি ত্রাণ দিতে চায়, তাদের কাছে আবার আমরা পৌঁছে দিতে পারব। কুয়াকাটা থেকে ত্রাণ দেয়া শুরু করেছি। তারপর সাভার, মুগদা, সাইনবোর্ড, হবিগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর নোয়াখালি লক্ষীপুর, হাতিয়া ইত্যাদি এলাকায় প্রায় দেড় হাজার মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছিয়েছি।’
মাওলানা এহসান সিরাজ আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার মানুষের ডাটা জমা হয়েছে। কিন্তু এত মানুষকে সহায়তা করার মতো ফান্ড আমাদের নেই। এদিকে রকমারি ডটকমের মূল প্রতিষ্ঠান অন্যরকম গ্রুপ ১০ হাজার মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর কার্যক্রম শুরু করেছে। তাই আমরা এখন আমাদের সংগৃহীত ডাটাগুলো তাদেরকে দিয়েছি। তারা ভেরিফিকেশন করে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে বিকাশ নম্বরে।’
ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ দিচ্ছেন পাক্ষিক সবার খবরের সম্পাদক মাওলানা আবদুল গাফফার। মুঠোফোনে তিনি জানালেন, ‘আমি আমার জেলা শরিয়তপুরে ত্রাণ দিচ্ছি। ত্রাণ-ফান্ডে সহায়তা করেছে সবার খবরের একটা বিশ্বস্ত পাঠক সার্কেল। প্রথমে সবাইকে ত্রাণ দিয়েছি। কিন্তু খবর পেলাম—অনেক আলেম, মদরাসা-শিক্ষকও সংকটে ভুগছেন। তারা মুখফুটে বলতেও পারছেন না। তাদেরকে অল্প ত্রাণ দেয়াটা তাদের মর্যাদার খেলাফ দেখায়। তাই আলেম পরিবারকে এক বস্তা করে চাউল দিচ্ছি। পরিবারে সদস্য অনুযায়ী কারও ঘরে পঞ্চাশ কেজি কারও ঘরে পঁচিশ কেজির বস্তা আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসছি।’
ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর ত্রাণ বিতরণ
ত্রাণ বিতরণের মাঠে তৎপর ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোও। খুব বড় পরিসরে না হলেও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তারা গোপনে-প্রকাশ্যে দাঁড়াচ্ছেন অসহায় মানুষের পাশে। মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহনগরী দক্ষিণের সভাপতি মাওলানা ইমতিয়াজ আলমের সাথে। তিনি বললেন, ‘আমরা কেন্দ্রীয় উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করেছি এবং জেলাভিত্তিক শাখার উদ্যোগেও ত্রাণ বিতরণ করেছি। ত্রাণের একটি অংশ গোপনে আলেমদের হাতেও তুলে দিয়েছি, দিচ্ছি। আমরা আমাদের ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে যাব।’
ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফয়জুল্লাহ দলের না হয়ে, বরং মানুষের হয়ে কাজ করার প্রতি জোর দিয়েছেন। একান্ত আলাপে তিনি জানিয়েছেন, ‘ইসলামি ঐক্যজোটের প্রত্যেক নেতাকে আমরা কমপক্ষে দশজন মানুষের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশনা দিয়েছি। তবে দলীয় ব্যানার ব্যবহার না করে গোপনে ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছি আমরা। ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি দলের কর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের এলাকার জানাযা এবং দাফন-কাফনে অংশ নিতে।’
ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হুজাইফা ইবনে ওমর বললেন, ‘জমিয়তের কেন্দ্রীয় উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি। তবে দলের পক্ষ থেকে সব শাখাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে—তারা তাদের এলাকায় যেন ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে যায়। নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় আমরা খন্ড খন্ডভাবে ত্রাণ বিতরণ করেছি।’
মানুষের দুঃসময়ে মানুষের পাশে
আলেমগণ যেমন যে যার জায়গা থেকে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়াচ্ছেন মানুষের পাশে, সবাইকেই সবার পাশে দাঁড়াতে হবে। সাহস দিতে হবে, ভরসা দিতে হবে। জাগ্রত কবি মুহিব খানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমাদেরও বলা উচিত—’ধর্ম-জাতি, বর্ণ-জ্ঞাতি আজ তো বড় নয়/আজ মানুষ নামের মানুষ সবাই এইতো পরিচয়/আজ উপার্জনের বন্ধ চাকা, ধনীর মাথায় হাত/আজ গরিব মরে বন্দী ঘরে নাইরে পেটে ভাত/আজ অসহায় লক্ষ মানুষ করছে হাহাকার/আজ সব মানুষের জন্য মানুষ দাড়াও আরেকবার!
The post মহামারী বিপর্যয় : জনসেবায় আলেমদের অংশগ্রহণ appeared first on Fateh24.
from Fateh24 https://ift.tt/2wRAxn2
No comments:
Post a Comment