রাকিবুল হাসান :
রমজানকে ঘিরে আমাদের — বাংলাদেশি মুসলিমদের যে কার্যক্রম, তার সিংহভাগ পালিত হয় উৎসব উৎসব আমেজে। রমজান যখন আসি আসি করে, বেড়ে যায় আমাদের ব্যস্ততা, তৎপরতা। অন্যান্য মাসের চেয়ে এই মাসে বদলে যায় খাবারের মেনু, ইবাদাতের আমেজ, জীবনাচারের ধরন। আমাদের জীবনজুড়ে মহা এক আলোড়ন নিয়ে উপস্থিত হয় রমজান। বাংলাদেশে রমজান সংস্কৃতির একটি সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধান থাকছে এই লেখায়।
রমজানের প্রস্তুতি, রমজানের চাঁদ
শবে বরাত পেরিয়ে রমজান যখন সন্নিকটে, রমজানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। এই প্রস্তুতি যার যার ঘর থেকেই শুরু হয়। ঘরের মহিলারা আসন্ন ইবাদাতের মওসুম উপলক্ষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ঘর-দোর। ধুয়ে মুছে তকতকে করে রাখে বিছানার চাদর, গায়ের জামা, নামাজ পড়ার মুসল্লা। লিস্ট করে করে আনা হয় রমজানের বাজার সদাই। ইফতার বানানোর বিভিন্ন জিনিসপত্র।
বাংলাদেশে রমজান উপলক্ষে সব জিনিসের মূল্যস্ফীতি একটি কমন ব্যাপার। তাই রমজানের আগে থেকেই সরকার মূল্যস্ফীতিকে কঠোর হস্তে দমন করার হুঁশিয়ারি দেন। এবং সরকারি উদ্যোগে পুরো রমজানব্যাপী কম দামে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা হয়। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে যা বিক্রি হয়, এত বিপুল জনসংখ্যার জন্য তা কখনোই যথেষ্ট নয়। ফলে সাধারণ ব্যবসায়ীদের থেকে চড়াদামেই জিনিসপত্র কিনতে হয়।
রমজানের আগেই দানবীর এবং দাতব্য সংস্থাগুলো অসহায়দের হাতে তুলে দেয় ইফতার সামগ্রী, রমজান ফুড প্যাকেজ। করোনায় বিপর্যস্ত এই বছর অন্যবারের তুলনায় অসহায়দের মাঝে ইফতার সামগ্রী বিতরণের হার বেশিই দেখা যাচ্ছে। একশটি অসহায় পরিবারের হাতে এবারই প্রথম ইফতার সামগ্রী তুলে দিয়েছেন বি-বাড়িয়ার সাঈদুল ইসলাম। ২২ এপ্রিল বিকেলে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘সমাজ সবার। তাই সবারই সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। সবাই সবার দায়িত্ব পালন করলে সমাজে আর বৈষম্য থাকবে না।’
কেউ করুণা করে নয়, সবাই নিজের দায়িত্ব মনে করেই এ মাসের প্রস্তুতিতে অসহায়দের হাতে তুলে দেয় খাবার। তারপর পশ্চিম আকাশে নূরের জোয়ার নিয়ে উদিত হয় লিকলিকে একটি চাঁদ, রমজান মাসের চিহ্ন। সাড়া পড়ে যায় সবখানে। রমজানের প্রথম কাজই পশ্চিম আকাশে চাঁদ দেখা। মাগরিব পড়ে সবাই দলে দলে বেরিয়ে যায় চাঁদ দেখতে। কেউ ঘাটে, কেউ উঠোনে, কেউ বাড়ির ছাদে। উঁকি দিয়ে দেখে চাঁদ দেখা গেলো কিনা। চাঁদ দেখতে পারলে অদ্ভুত এক প্রশান্তি বিরাজ করে মনে। মেঘের কারণে আকাশে চাঁদ দেখা না গেলে মানুষের এখন প্রধান ভরসা রেডিও এবং টিভি চ্যানেল। সবাই কান পেতে থাকে সংবাদে, চোখ ফেলে রাখে নিউজ পোর্টালের হেডলাইনে। জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির বরাত দিয়ে চাঁদ দেখার নিশ্চিত খবরটি জানায় তারা।
রেডিও টিভিতে খবরটি জানতে পারলেও কোনো কোনো এলাকায় মসজিদের মাইকেও ঘোষণা দেয়া হয়। ইমাম সাহেব দরাজ কণ্ঠে বলেন,’আলহামদুলিল্লাহ। রমজানের চাঁদ দেখা গেছে। আজ থেকে তারাবি।’
তারাবীতে গমন, তারাবীতে সমর্পণ
রমজানের প্রথম তারাবীতে সবচে বেশি মুসল্লি উপস্থিত হয়। তারপর দিন যত যেতে থাকে, তারাবীতে মুসল্লির সংখ্যা কমতে থাকে। কুমিল্লায় অবস্থিত জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম রামপুরের শাইখুল হাদিস মাওলানা তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এটা সবচে দুঃখের ঘটনা বাংলাদেশে। ইফতারিতে কখনো আইটেম কমে না। বরং ত্রিশ দিন জমজমাট থাকে ইফতারির প্লেট। কিন্তু তারাবীতে মুসল্লি কমতে থাকে। এর অন্যতম কারণ দ্বীনের প্রতি মানুষের একনিষ্ঠতার অভাব। তাই রোজা রাখে, কিন্তু তারাবি পড়ে না।’
একটা সময় সূরা তারাবী পড়ানো হতো সব জায়গায়। কিন্তু এখন খতমে তারাবীর চাহিদা এবং প্রচলন বাড়ছে। শহরে তো খতমে তারাবীর আয়োজন করা হয়-ই, এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও খতমে তারাবীর ব্যবস্থা করা হয়। খতমে তারাবীর জন্য হাফেজ নির্ধারণের কাজটি শেষ করা হয় রমজানের আগেই।
তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ মসজিদের খতমে তারাবীতে দ্রুতলয়ে কুরআন তেলাওয়াত করা হয়। খুব কম মসজিদেই ধীরলয়ে তেলাওয়াত করা হয়। এর অন্যতম একটা কারণ—মুসল্লিদের তাড়াহুড়া। অনেক মসজিদে মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে দ্রুতলয়ে পড়ার নির্দেশনা থাকে। মাওলানা তাজুল ইসলাম বলেন, ‘মুসল্লিদের দিকে তাকিয়েই দ্রুতলয়ে পড়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। অনেক বৃদ্ধ লোকজন তারাবী পড়ে। তারাও হাফেজদের পেছনে খতমে তারাবি পড়তে চায়। ধীরলয়ে পড়লে তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তবে শব্দ-উচ্চারণ অস্পষ্ট রেখে দ্রুতলয়ে পড়া কখনোই সমর্থন করি না আমরা।’
সেহরিতে জাগরণ
যেহেতু তারাবী পড়ে সবাই ঘুমিয়ে যায়, সেহরিতে উঠতে আলাদা একটু সতর্কতার প্রয়োজন হয়। সেহরিতে মানুষকে জাগানোর জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
আগে পবিত্র রমজান এলেই পুরান ঢাকায় সেহরির সময় মানুষকে জাগানোর জন্য মহল্লায় মহল্লায় কাসিদা গাওয়া হতো। কাসিদায় একজন লোকমাদার (মূল গায়ক) থাকেন। তার কথা শেষ হলে দলবদ্ধভাবে কোরাস গাওয়াই হলো কাসিদার রীতি। একটি কাসিদার বোল ‘রোজদারও জাগো ওঠো, এ রাত সোহানি হ্যায়’—(রোজাদাররা ঘুম থেকে ওঠো, এ রাত অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ)। বছর কুড়ি আগে ঢাকার মালিবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা এলাকায়ও কাসিদার প্রচলন ছিল। বর্তমানে কাসিদার প্রচলন উঠে গেলেও পুরান ঢাকার কোথাও কোথাও উর্দু কাসিদা গাওয়ার প্রচলন এখনো আছে। তবে তা খুবই স্বল্প পরিমাণ। মসজিদের মাইকে ডেকে ডেকে মানুষকে জাগানোর প্রচলন শুরু হবার পর কমে গেসে কাসিদা গাওয়ার রীতি।
এখন বাংলাদেশের প্রায় সবখানেই মসজিদের মাইকে মানুষকে ডাকা হয়। সেহরির সময় শেষ হবার আগে সতর্ক করা হয়। এসময় অনেক এলাকায় মাইকে বাজিয়ে দেয়া হয় গজল, হামদ, নাত। আবার অনেক এলাকায় সেহরির সময় গজল বাজিয়ে রাখা নিষিদ্ধ। এর কারণ হিসেবে বলা হয়—এই সময় আগে-পরে সেহরি খেয়ে অনেকে তাহাজ্জুদ পড়েন। অথবা বিভিন্ন ইবাদাতে মশগুল থাকেন। গজল বাজিয়ে রাখলে তাদের মনোযোগে বিঘ্নতা ঘটে।
তবে মাইকে ডাকাডাকির বদলে কোথাও কোথাও সাইরেন বাজানো হয়। চট্টগ্রাম মিরসরাইয়ের মাওলানা খাইরুল আমিন বলেন, ‘আমাদের এখানে মাইকে ডাকা হয় না। বরং সাইরেন বাজানো হয়। সেহরির সময় শেষ হলেও সাইরেন বাজানো হয়।’ সিলেট আয়শা ক্লিনিকের সিনিয়র নার্স হেলেনা আহমেদ বলেন, ‘আমাদের সিলেটে মাইকে ডাকে না। বরং সাইরেন বাজায়। সাইরেন বাজালেই বুঝতে পারি সেহরির সময় হয়েছে, সেহরির সময় শেষ হয়েছে।’
ইফতারির আয়োজন
বাংলাদেশের ইফতারির কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে পুরান ঢাকার ইফতারির কথা। ঢাকার বয়স ৪০০ বছরের বেশি হলে ঢাকার ইফতারির ইতিহাসটাও চার শতাব্দীর। সেই আদিকালে ইফতার করাকে বলা হতো ‘রোজা খোলাই’। এখনো পুরান ঢাকার অনেক এলাকায় রোজা খোলাই শব্দটির প্রচলন রয়েছে।
৪০০ বছরের পুরাতন বাজার চকবাজারই ঢাকার প্রধান বাজার।চকবাজারের ইফতারিপাড়ায় রমজানের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় মুখরোচক খাবারের হাঁকডাক আর ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। এর মধ্যে চারদিকে ‘বড় বাপের পোলারা খায়, ধনি-গরিব সবাই খায়, মজা পাইয়া লইয়া যায়’-এর হাঁকডাকে চিরচেনা চকবাজারের চেহারা দুপুরের পর থেকেই পাল্টাতে থাকে।
এখানকার ইফতারির মধ্যে উল্লেখযোগ্য আস্ত মুরগির কাবাব, মোরগ মুসাল্লম, বটিকাবাব, টিকাকাবাব, কোফ্তা, চিকেন কাঠি, শামিকাবাব, শিকের ভারী কাবাব, সুতিকাবাব, কোয়েল পাখির রোস্ট, কবুতরের রোস্ট, জিলাপি, শাহি জিলাপি, নিমকপারা, সমুচা, আলাউদ্দিনের হালুয়া, হালিম, দইবড়া, সৌদি পানীয় লাবাং, কাশ্মীরি সরবত, ইসবগুলের ভুসি, পুরি এবং ৩৬ উপকরণের মজাদার ‘খাবার বড়বাপের পোলারা খায়’সহ আরও হরেক রকম পদ।
বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার আবদুস শাহিদ বলেন, ‘ইফতারির সময় বগুড়ার চর এলাকায় তৈরি হয় আটা এবং গরুর মাংস সহযোগে সুস্বাদু একটি খাবার।’ বরিশাল মুলাদি থানার মাওলানা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ইফতারিতে বরিশালে তৈরী হয় মুড়ি ভিজিয়ে দুধ, গুড় এবং নারকেল দিয়ে অমৃত স্বাদের আরেকটি পদ। প্রায় প্রত্যেকটি ঘরেই এই খাবারটি তৈরী করা হয়।’
ঘরে ঘরে ইফতারির আয়োজন করা হয়। তার সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগে মসজিদেও ব্যবস্থা করা হয় ইফতারির। কোনো কোনো মসজিদে ইফতারির জন্য আলাদা ফান্ড রাখা হয়। কোনো কোনো মসজিদে ইফতারির জন্য আলাদা ফান্ড থাকে না। বরং মানুষ মসজিদে ইফতারি নিয়ে আসে কিংবা ইফতারি পাঠিয়ে দেয়। খুলনার বিহারী এলাকার কথা বলছিলেন মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি বললেন, ‘এখানে মসজিদে ইফতারির আলাদা ফান্ড নেই। বরং বিহারিদের অধিকাংশ পুরুষ-ই নিজের প্রয়োজন থেকে একটু বেশি ইফতারি নিয়ে মসজিদে উপস্থিত হয়। তারপর সবাই মিলে ইফতার করে।’ ইফতারি ভাগাভাগি করে খাবার দৃশ্যটা পুরো বাংলাদেশেই দেখা যায়।
সামাজিক জীবনাচার
ইবাদাত-বন্দেগীর পাশাপাশি সামাজিক জীবনাচারেও রমজানকে ঘিরে তৈরী হয়েছে কিছু প্রচলন। যেমন—মেয়ের শ্বশুর বাড়ি কিংবা ছেলের শ্বশুর বাড়িতে ইফতার পাঠানো। কোথাও কোথাও বিয়ের প্রথম বছর ইফতার পাঠানো আবশ্যক। আবার কোথাও কোথাও সবসময়ই পাঠাতে হয়। হবিগঞ্জের মাওলানা মুঈনুদ্দিন তানসিন বলেন, ‘আমাদের এখানে এই ইফতার পাঠানো আবশ্যক। আমার মা বুড়ো হয়ে গেছেন। এখনো আমার নানার বাড়ি থেকে প্রতি বছর ইফতার পাঠানো হয়।’
ইফতারির সঙ্গে কোথাও কোথাও আত্মীয় স্বজনের জন্য কাপড়ও পাঠাতে হয়। বি-বাড়িয়া নবিনগরের বাসিন্দা মোসা. জেসমিন আক্তার বলেন, ‘ইফতারির সঙ্গে আমাদের এখানে কাপড় দেয়ার প্রচলনটা বিগত কয়েক বছর হলো শুরু হয়েছে। এর আগে এই প্রচলন ছিলো না। কারণ মানুষের সামর্থও কম ছিলো তখন। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা যত বাড়ছে, বাড়ছে বিভিন্ন প্রচলনও।’
যাকাত যদিও রমজানের সঙ্গে জড়িত নয়, তবুও আমরা যাকাতকে রমজান কেন্দ্রিক বানিয়ে ফেলেছি। রমজান এলেই কেবল যাকাত দেয়ার তোড়জোড় করে সবাই। যে সমস্ত মাদরাসা যাকাতের টাকা কালেকশন করে, তারাও রমজান এলেই টাকা কালেকশনে নামে। এর আগে পরে তারাও কখনও যাকাতের টাকা আনতে যায় না। এর ফলে অনেকেই মনে করে—যাকাত দেয়ার সময় কেবল রমজান। রমজানেই যাকাত দিতে হয়।
বদলে যাবার মাস রমজান
রমজান মূলত আমাদেরকে আমূল বদলে দিতে চায়। কাজে-কর্মে, চিন্তায়-মননে। ভেতরে-বাইরে আমাদেরকে শুদ্ধ করে তুলতে চায় পবিত্রতার ছোঁয়ায়। দিনে উপবাস, রাতে তারাবি, কিয়ামুল লাইল। এখানে নিজের কিছু থাকে না। প্রভুর ইশারায়, প্রভুর সামনেই সমর্পিত হয়।
খুব কঠিন এক সময়ে এবার রমজান এসেছে। দলবেঁধে তারাবি পড়তে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঘরে বসেই পড়ে নিতে হবে তারাবি। মসজিদে যাবার অনুমতি দেয়া হয়েছে, তবে তা খুবই সীমিত মানুষের জন্য। এই সময়ে নামাজ, দোয়া, মুনাজাত এবং কুরআন তোলাওয়াত হোক আমাদের সারাদিনের ব্যস্ততা। রমজান হয়ে উঠুক ইবাদাতে আরও পরিপূর্ণ। ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ।
The post বাংলাদেশে রমজান সংস্কৃতির অনুসন্ধান appeared first on Fateh24.
from Fateh24 https://ift.tt/2VWmpRM
No comments:
Post a Comment