আবদুল্লাহিল বাকি
সংক্রমণ প্রশ্নের মৌলিক উৎস : কার্যকারণ তত্ত্ব
ইসলামে— শাখাগত যেসব প্রশ্ন ওঠে এবং উত্তর দেয়া হয়, তার একটা মৌলিক তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকে। প্রশ্নটা যদি মানুষের বাহ্যিক কার্য-আচরণ-উচ্চারণের সাথে সম্পৃক্ত হয়, তাহলে এর তাত্ত্বিক ভিত্তি পাওয়া যাবে কাওয়ায়েদুল ফিকহ ও উসুলুল ফিকহে। আর যদি মানুষের মাঝে জন্ম নেয়া ধ্যানধারণা, বিশ্বাস-সংশ্লিষ্ট হয়, তাহলে তার মূল খুঁজতে হবে ইলমুল কালামে।
তেমনিভাবে ইসলামে— রোগ সংক্রমণের প্রশ্ন একটা শাখাগত প্রশ্ন, যদিও এ সম্পর্কে মৌলিক আলোচনা ইসলামের মৌলিক উৎসের মাঝেই বিদ্যমান। তবুও কাঠামোগত দিক থেকে এটি শাখাগত প্রশ্নই।
রোগ সংক্রমণের প্রশ্ন— যেহেতু মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, এজন্য এই প্রশ্নটির তাত্ত্বিক ভিত্তি আমাদেরকে খুঁজতে হবে ইলমুল কালামে। এই শাস্ত্রে বহুল আলোচিত ‘নাজরিয়্যাতুস সাবাবিয়্যাহ’ বা কার্যকারণ তত্ত্বের অধীনে রোগ সংক্রমণের প্রশ্নটি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়।
কোরআনের দর্পণে কার্যকরণ তত্ত্ব
পবিত্র কোরআনুল কারীমে যেসব আয়াতে কারণ ও কার্যকারণ সংক্রান্ত ইঙ্গিত বিদ্যমান, সেটাকে সামনে রেখে মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকগণ কার্যকারণের আলোচনাকে দুইটি প্রশ্নে বিভক্ত করেছেন। ১. সকল কার্য ও বস্তুর মৌলিক কোনো কারণ আছে কি নেই? ২. মৌলিক ও প্রধান একটি কারণ যদি বিদ্যমান থাকে— তাহলে কার্য সংগঠিত হওয়ার মাধ্যম হিসেবে অন্যান্য একাধিক কারণের অস্তিত্ব আছে কি নেই?
প্রথম প্রশ্নের ক্ষেত্রে মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের কোন নেতিবাচক অবস্থান লক্ষ্য করা যায় না। সকল মুসলিম মনীষী এক্ষেত্রে একমত যে, পৃথিবীর সকল কার্য ও বস্তুর একজন মৌলিক কারক বিদ্যমান। আর তিনি হচ্ছেন— সর্বশক্তিমান, পবিত্র সত্তা মহান আল্লাহ। প্রাচীন কিছু দার্শনিক এ ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থান অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে এটাকে হাস্যকর জ্ঞান করা হয়। অনেকে মনে করেন— স্কটিশ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক ডেভিড হিউম (১৭১১ – ১৭৭৬) এ ধরনের মত পোষণ করেন।
এ ব্যাপারে কোরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন আয়াত। সূরা তুরের ৩৫ নং আয়াতে আছে, ‘তাদেরকে কি কোন বস্তু ছাড়াই সৃষ্টি করা হয়েছে নাকি তারা নিজেরাই সৃষ্টিকর্তা’। সূরা কামারের ৪৯ নং আয়াতে আছে, ‘নিঃসন্দেহে আমি প্রতিটি জিনিস সৃষ্টি করেছি পরিমিতির সাথে’।
আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি তার বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘আত তাফসিরুল কাবির’এ দ্বিতীয় প্রশ্ন সম্পর্কে কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘বাহ্যিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে বস্তুগত ও বাহ্যিক কারণ বিদ্যমান থাকা— কোরআনের ভাবধারার বিপরীতে নয়, বরং কোরআনে এটার সমর্থন বিদ্যমান থাকা স্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ, কোরআনে দেখা যায়, বিশ্বজগতের বাহ্যিক পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে কতক প্রাকৃতিক সৃষ্টিকে। এ মর্মে আল্লাহ তা’আলা সূরা নাযিয়াতের চতুর্থ আয়াতে বলেছেন, ‘শপথ তাদের, যারা সকল কর্মনির্বাহ করে’। কুরআনের ব্যাখ্যাকারগণ ‘কর্মনির্বাহকারী’ শব্দের ব্যাখ্যায় বেশকিছু শ্রেণীকে সম্ভাবনামূলকভাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন, ফেরেশতা, তারকারাজি, আত্মা ইত্যাদি। কিন্তু গবেষক মুফাসসিরগন এর ব্যাখ্যায় ফেরেশতাকে অগ্রগণ্য রেখেছেন। এর ব্যাখ্যা যাই হোক— এ থেকে এতোটুকু অবশ্যই সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে যে, পৃথিবীতে সকল ঘটনা, কার্য ও বস্তু সংঘটিত হবার ক্ষেত্রে মৌলিক কারণ ছাড়াও অন্যান্য কারণের মুখাপেক্ষী হয়। এটাই পৃথিবীতে আল্লাহর চিরন্তন নিয়ম, যা কদাচিৎ ভঙ্গ হয়।’
এছাড়াও কোরআন আরো অনেক প্রাকৃতিক কারণের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছে, বৃষ্টি পড়া, বিজলী চমকানো, শস্য ফলে ওঠাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক কর্মের ক্ষেত্রে। এবং সেই নিদর্শনগুলো দেখেই বান্দাকে মহান আল্লাহর একত্বের উপর ঈমান আনার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, কোন কার্য ও বস্তুর ক্ষেত্রে কারণ ও মাধ্যমের বহুত্ব ইসলামের একত্ববাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না।
আল্লাহ তাআলা সুরা বাকারার ২২ নং আয়াতে বলেছেন, ‘যে পবিত্রসত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদ স্বরূপ স্থাপন করে দিয়েছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসাবে। অতএব, আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাকেও সমকক্ষ করো না। বস্তুতঃ এসব তোমরা জান।’
সূরা সাজদার ২৭ নং আয়াতে আছে, ‘তারা কি লক্ষ্য করে না যে, আমি উষর ভূমিতে পানি প্রবাহিত করে শস্য উদগত করি, যা থেকে ভক্ষণ করে তাদের জন্তুরা এবং তারা কি দেখে না?’ এই আয়াতদ্বয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ফসল উৎপাদনের জন্য আল্লাহ তাআলা মাধ্যম হিসেবে পানি বর্ষণকে ব্যবহার করেছেন।
সূরা নূরের ৪৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন, অতঃপর তাকে পুঞ্জীভূত করেন, অতঃপর তাকে স্তরে স্তরে রাখেন; অতঃপর তুমি দেখ যে, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি আকাশস্থিত শিলাস্তুপ থেকে শিলাবর্ষণ করেন এবং তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা, তা অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন। তার বিদ্যুৎঝলক দৃষ্টিশক্তি যেন বিলীন করে দিতে চায়।’ এখানেও আমরা দেখতে পাই যে, বৃষ্টি বর্ষণকে আল্লাহ একটা স্বাভাবিক ও যৌক্তিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংঘটিত করছেন।
কুরআনুল কারীম কার্যকারণ তত্ত্ব সম্পর্কে আমাদেরকে যে ধারণা দেয়, তার সারকথা দাঁড়াচ্ছে— সবকিছুর প্রধান কর্তা ও মৌলিক কারণ মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন। কিন্তু তিনি প্রকৃতি ও বিশ্বকে স্বাভাবিক শৃংখলার মধ্যে বেঁধে দেয়ার জন্য বেশ কিছু নিয়ম কানুন সৃষ্টি করেছেন, যার বাইরে তার কোন সৃষ্টিই যেতে পারে না। কার্য সংঘটিত হওয়ার জন্য কিছু কারণ তৈরি করেছেন, এটা এই প্রকৃতিতে আল্লাহর সহজাত প্রক্রিয়া। কিন্তু মহান আল্লাহ যেহেতু সকল কাজের স্রষ্টা, তাই তিনি কখনো ইচ্ছা করলে কারণের মধ্য থেকে কার্যের মধ্যে ক্ষমতা প্রয়োগ করার শক্তি উঠিয়ে নিতে পারেন। যেমনিভাবে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের অগ্নিকুণ্ড থেকে তিনি প্রজ্জ্বলনের ক্ষমতা উঠিয়ে নিয়েছিলেন।
কার্যকারণ সম্পর্কে মুতাকাল্লিমদের বক্তব্য
প্রায় প্রত্যেক মুতাকাল্লিম ও ধর্মতাত্ত্বিক এক্ষেত্রে একমত যে, প্রত্যেক বিষয়ের ও বস্তুর নির্দিষ্ট কিছু বাহ্যিক কারণ বিদ্যমান রয়েছে, হয়ত সামগ্রিকভাবে অথবা আংশিকভাবে যার মাধ্যমে— কোন কার্য সংগঠিত হয়ে থাকে। যারা মুসলিম দার্শনিক, তাদের ক্ষেত্রে তো কার্যকারণ তত্ত্ব সাব্যস্ত করার কোন অপেক্ষায়ই রাখে না। কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে, বিশ্বকে পরিচালনা করে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে— বেশকিছু আকল। মুতাজিলাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কার্যকারণ তত্ত্বের অবস্থান কি সেটাও সাব্যস্ত করার বোধহয় কোন প্রয়োজন নেই। কারণ, বান্দার নিজের কাজের জন্য যে সে নিজে দায়ী— এটার প্রমাণ দিতে গিয়ে তারা অনেক আগেই বলে রেখেছে, বান্দাই তার পুণ্য ও পাপের স্রষ্টা। আর কালাম শাস্ত্রের অন্যান্য সুন্নি দলও কার্যকারণ তত্ত্ব সম্পর্কে কোন নেতিবাচক চিন্তা লালন করে না। কিন্তু আশআরীদের সম্পর্কে প্রচলিত আছে যে, তারা ‘নাফিউল ইল্লিয়্যাহ’ বা কার্যকারণ তত্ত্ব নাকচের প্রবক্তা। এজন্য তাদের সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
আশআরীদের অবস্থান সম্পর্কে প্রথম কথা হল, কার্যকারণ তত্ত্ব সম্পর্কে তাদের পক্ষ থেকে যতই নেতিবাচক মন্তব্য প্রচলিত হোক না কেন— তাদের কেউই কিন্তু অস্বীকার করবে না যে, বিভিন্ন বস্তুর মাধ্যমে বিভিন্ন কার্য সংগঠিত হয়, যা সবাই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। এটা অস্বীকার করার কোন পথ নেই।
তাছাড়া দ্বিতীয় কথা হল, আশআরী আলিমগণ কার্যকারণ তত্ত্ব সম্পর্কে যেসব মতামত দিয়েছেন— তা গভীরভাবে পাঠ করলে বোঝা যায়, তারা কার্যকারণ তত্ত্বের বিরোধী নয়। বরং এক্ষেত্রে তাদের সাথে অন্যদের বিরোধ হল নিছক শাব্দিক ও ব্যাখ্যাগত।
‘শারহুল মাওয়াকিফ’এর টীকাকার আব্দুল হাকিম কার্যকারণ তত্ত্ব সম্পর্কে আশআরীদের অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আশআরীদের মতামত হলো, কার্যের কারক একমাত্র আল্লাহ। কিন্তু কারণ বিভিন্ন হতে পারে। একজন বুদ্ধিমান মানুষ কিভাবে এটা স্বীকার করতে পারে যে, সমগ্র মুখাপেক্ষী হবে না অংশের অথবা আঙ্গিকের কোন প্রয়োজন নেই মৌলের?’ এই উদ্ধৃতিটি আমাদের সামনে আশয়ারী মতবাদকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
ইমাম গাজ্জালী থেকে অবশ্য বিভিন্ন রকম বক্তব্য পাওয়া যায় কার্যকারণ সম্পর্কে। প্রাচীনকাল থেকে দার্শনিকরা বলে আসছেন— আল্লাহর হুকুম ছাড়াই কারণ ও কার্যের মাঝে সম্পর্কটা অবধারিত। এর কোন অন্যথা নেই। দার্শনিকদের এই কথার বিরোধিতা মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকগণ করেছিলেন। কিন্তু ইমাম গাজ্জালী একটু ভিন্নভাবে বিষয়টা ব্যক্ত করেছেন। কার্যকারণ তত্ত্ব সম্পর্কে ইমাম গাজ্জালীর যেসব বক্তব্য পাওয়া যায় তার খোলাসা হলো, তিনি কারণ ও কার্যের মাঝে সম্পর্কের আবশ্যকীয়তাকে আমলে নেন না। উভয়ের মাঝে সম্পর্ক অত্যন্ত গৌণ। মানুষের আদত অভ্যাস এটাকে আবশ্যকীয়তার রূপ দিয়েছে। তার অনেক পরে স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউমও অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কার্য ও কারণের মাঝে যে ওতপ্রোত সম্পর্কের ধারণা মানুষের মাঝে প্রচলিত— তা গলদ। মূলত মানুষের মানসিকতা এই সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে। আমি বলছি না, দুইয়ের মাঝে একেবারেই সম্পর্ক নেই। বরং সম্পর্ক থাকলেও এর মাঝে আবশ্যকীয়তা নেই।’
ইমাম গাজ্জালী থেকে এরকম মত প্রচলিত থাকলেও ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’য় তিনি আগুনের প্রজ্বলন ক্ষমতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রজ্জ্বলনকারী মহান আল্লাহ তায়ালাই। হয়তো ফেরেশতার মাধ্যমে অথবা তার মাধ্যম ছাড়াই। আর আগুন হলো একটা নিথর বস্তু— এর কোনো ক্ষমতা নেই কাজ সংগঠিত করার।’ এখানে তিনি ফেরেশতাকে মাধ্যম হিসেবে স্বীকার করে নিলেন। তো এখানে অন্যান্য বস্তুকে মাধ্যম হিসেবে স্বীকার করে নিতে অসুবিধা কি?
কার্যকারণ তত্ত্বকে স্বীকার করে নেয়ার ক্ষেত্রে আরো সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে ‘ইহয়াউ উলুমিদ্দীন’ গ্রন্থে। আর ‘মাআরিজুল কুদস’ গ্রন্থে তো আগ বেড়ে ফারাবী ও ইবনে সিনার মতামত হুবহু বর্ণনা করেছেন। ইমাম গাজ্জালীও তাদের মতো বলেছেন, ‘পৃথিবীর মধ্যে অস্তিত্বসম্পন্ন কাঠামো তিন স্তরে গঠিত। ১. বিশ্বকে পরিচালনাকারী কিছু আকল। ২. এমন কিছু সত্তা, যারা আকাশে স্পন্দিত হচ্ছে। ৩. স্বাভাবিক দেহ।’ এখানে সুষ্পষ্টই তার পক্ষ থেকে স্বীকৃতি পাওয়া যাচ্ছে কার্যকারণ তত্ত্বের।
ওলফসন. এইচ. এ. ‘The philosophy of the KALAM’ গ্রন্থে ইমাম গাজ্জালী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তিনি যদিও ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’গ্রন্থে কার্য ও কারণের মাঝে সম্পর্কের আবশ্যকীয়তা খন্ডন করেছেন, কিন্তু সাথে সাথে আল্লাহর কাজের মাঝে মাধ্যম থাকার ধারণা— নিজের মাঝে গভীরভাবে ধারণ করেছেন।’
সংক্রমণ সংক্রান্ত হাদিসের ক্ষেত্রে যুগে যুগে আলেমগনের ব্যাখ্যা
সংক্রমণ প্রশ্নের মৌলিক ভিত্তি যেহেতু কার্যকারণ তত্ত্বে নিহিত, তাই উপরে এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হয়েছে। আর ইলমুল কালামে আমরা কার্যকারণ তত্ত্ব সম্পর্কে যে ইতিবাচক ধারণা দেখতে পাই, তা হুবহু ইসলামে সংক্রমণের অবস্থান সম্পর্কে প্রযোজ্য হবে।
এছাড়াও সংক্রমণ সম্পর্কে আলোচনা যেহেতু ইসলামের মৌলিক উৎস তথা হাদিসে বিদ্যমান, তাই সেসব হাদিস সম্পর্কে বিভিন্ন সময় ওলামায়ে কেরামের কি ব্যাখ্যা ছিল— তা জানতে পারলেই সংক্রমণ সংক্রান্ত মুসলিম চিন্তার ঐতিহাসিক ধারাটা আমরা অনুধাবন করতে পারব।
তাছাড়া ইলমুল কালামের বাইরে সংক্রমণ সংক্রান্ত আলোচনা নিয়ে যে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়েছে অথবা বলা যায় বিভিন্ন ব্যাখ্যা তৈরি হয়েছে— এর কারণ হলো, সংক্রমণ সংক্রান্ত হাদিসগুলো বাহ্যিকভাবে পরস্পরবিরোধী। এজন্য উভয় ধারার বর্ণনার মাঝে সামঞ্জস্য তৈরি করতে গিয়ে ওলামায়ে কেরামের বিভিন্ন রকম বক্তব্য সামনে এসেছে। সংক্রমণ সংক্রান্ত হাদিসের ক্ষেত্রে পক্ষে-বিপক্ষে মৌলিকভাবে কয়েকটি হাদিসকে সামনে রাখা হয়।
১. সহীহ মুসলিম শরীফের ২২২০ হাদিস : আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নেই। সফর মাসে অকল্যাণ নেই। কুলক্ষ্মী পেঁচা বলে কোন কিছু নেই। তখন এক বেদুইন বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! তাহলে উট সম্পর্কে কি বলবেন। অনেকগুলো উট একসাথে বালুর মধ্যে বসে থাকে— যেন সেগুলো মসৃণতায় হরিণের ঝাঁক। কিন্তু সেই দলের মাঝে বাইরে থেকে একটা মাত্র চর্মরোগে আক্রান্ত উট প্রবেশ করে। এরপর থেকে পালের সকল উট সেই চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে যায়।’ আল্লার নবী সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম তখন বললেন, ‘সর্বপ্রথম উট তাহলে কার সংক্রমণে চর্মরোগে আক্রান্ত হলো?’
২. সহীহ মুসলিম শরীফের ২২৩১ নং হাদিস : ‘ছাকিফ গোত্রের প্রতিনিধি দলের মাঝে একজন লোক ছিল কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। পথেই তার কাছে দূত পাঠিয়ে দিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে দিলেন, আমি তোমাকে বায়াত করে নিলাম। তুমি ফিরে যাও।’
৩. সহীহ বুখারী শরীফের ৫৭০৭ নং হাদিস : আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কুষ্ঠ রোগী থেকে তুমি এমনভাবে পালাও, যেভাবে বাঘের ভয়ে পালাও।’
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানীর ব্যাখ্যা ও সমন্বয়
বিখ্যাত হাদীসশাস্ত্রবিদ আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী ‘ফাতহুল বারি’ গ্রন্থের দশম খন্ডে সংক্রমণ সংক্রান্ত প্রশ্ন নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। বিভিন্ন হাদিস ব্যাখ্যাকারগণ সংক্রমণের হাদিস সম্পর্কে কী কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন? এর কয় ধরনের ব্যাখ্যা হতে পারে? প্রত্যেকটি হাদীসের শাস্ত্রীয় গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?— এসব বিষয়-আশয় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। এবং পরবর্তী ওলামায়ে কেরাম ব্যাখ্যার এই কয়েকটি ধারার বাইরে সাধারণত বের হননি। এখানে সংক্ষিপ্তভাবে সেখান থেকে কিছু তুলে ধরছি।
‘কাজি ইয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘কুষ্ঠ রোগী সম্পর্কে যেসব হাদিস বর্ণিত হয়েছে— তা পরস্পরবিরোধী। এক বর্ণনায় পাওয়া যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুষ্ঠ রোগীর সাথে বসে খেয়েছেন। এজন্য ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-সহ কিছু সাহাবী মনে করলেন, কুষ্ঠ রোগীর সাথে বসে একসাথে খেতে কোন অসুবিধা নেই। অন্যান্য হাদীসে যে তার থেকে দূরে থাকার কথা বলা হয়েছে— তা রহিত হয়ে গিয়েছে। মালেকী মাযহাবের পক্ষ থেকে এই মত অবলম্বন করেছেন— ঈসা বিন দিনার। কিন্তু সঠিক কথা, যে মতের উপর অধিকাংশ আলেম রয়েছেন, এবং সেটা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক— কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকার হাদিস রহিত হয়ে যায়নি। এক্ষেত্রে সমন্বয়ের পথ অবলম্বন করতে হবে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, যে হাদিসে কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে— তার অর্থ দূরত্ব অবলম্বন করা মুস্তাহাব ও সচেতনতার দাবি। আর কুষ্ঠ রোগীকে নিজের সাথে যে খেতে বসিয়েছেন, তা দ্বারা উদ্দেশ্য— এর বৈধতা বর্ণনা করা।’
কাজী ইয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি ব্যাখ্যার যে দুইটি পন্থার কথা বললেন, এর বাইরে আরেকটি ব্যাখ্যা আছে। সেটি হল, পরস্পরবিরোধী হাদীসের ক্ষেত্রে যে কোন একটার দিক অগ্রাধিকার দেয়া এবং বিপরীত দিককে ব্যাখ্যা সাপেক্ষ বলে গণ্য করা। কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে ইবনে হাজার আসকালানী প্রমাদ গণ্য করেছেন। তিনি বলেছেন, উসুলুল হাদিস মতে— পরস্পর বিরোধী হাদীসের ক্ষেত্রে যদি সমন্বয় সাধন করা যায়, তাহলে আর যেকোন একদিককে অগ্রাধিকার দেয়া যাবে না।
সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে আরো বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে
১. সংক্রমণকে পুরোপুরিভাবেই নাকচ করে দেয়া হবে। এবং কুষ্ঠরোগী থেকে পলায়নের আদেশের অর্থ তখন দাঁড়াবে— সে যেন সুস্থ সবল কোন লোককে দেখে মনোকষ্টে না ভুগে। এজন্যই নবীজি এক হাদিসে বলেছেন, তোমরা কুষ্ঠরোগীদের দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থেকো না।
২. এক হাদিসে সাব্যস্তকরণ এবং আরেক হাদিসে নাকচকরণ— এর হুকুম সাধারণভাবে প্রযোজ্য হবে না। বরং দুটি বিশেষ ক্ষেত্র রয়েছে। যাদের বিশ্বাস দৃঢ়, তাদেরকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে ‘সংক্রমণ বলতে কিছু নেই’। এক্ষেত্রে সে স্বাভাবিকভাবেই আপন বিশ্বাস থেকে সংক্রমণের ধারণাকে দূরীভূত করে দিতে পারবে। আর যাদের বিশ্বাসের মধ্যে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে তাদেরকে বলা হয়েছে ‘তোমরা কুষ্ঠরোগী থেকে দূরে থাকো’। যেন তাদের মাঝে সংক্রমণের কোন বিশ্বাস জন্ম না নেয়।
৩. কাজী আবু বকর বাকিল্লানী বলেছেন, ‘হাদিসে বলা উদ্দেশ্য— সকল রোগের মধ্যে সংক্রমণ নেই। কিন্তু বিশেষভাবে কিছু রোগের মধ্যে সংক্রমণ রয়েছে। যেমন কুষ্ঠ রোগ, শ্বেত রোগ ও বিশেষ চর্মরোগ ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে, ব্যাপকভাবে রোগের মধ্যে সংক্রমণ নেই। বরং কিছু রোগের মাঝে নির্দিষ্টভাবে রয়েছে। তাই যেন ‘সংক্রমণ বলতে কিছু নেই’— হাদিসের মধ্যে এই ব্যাপকতাটা নাকচ করা উদ্দেশ্য ; সব রোগেই সংক্রমণ আছে, এই ধারণা নাকচ করা হয়েছে। আর কুষ্ঠরোগী থেকে দূরে থাকার আদেশ বিশেষভাবে কিছু রোগের মাঝে সংক্রমনের অস্তিত্ব স্বীকার করছে।’
৪. কুষ্ঠরোগী থেকে যে দূরে থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে, তা সংক্রমণের আশঙ্কায় নয়। বড় একটি প্রাকৃতিক নিয়মের কারণে। আর প্রাকৃতিক নিয়মটা হল, সাধারণত স্পর্শ, মেলামেশা অথবা শ্বাস-প্রশ্বাসের আদান প্রদানের কারণে রোগ এক দেহ থেকে আরেকজনের দেহে স্থানান্তরিত হয়। এটা একটা প্রাকৃতিক উপসর্গ রোগ জন্মের। এই মতের পক্ষে আছেন তরিকাহ বিন কুতায়বা।
৫. আল্লার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসের অর্থ— জাহিলিয়াতের যুগে যে অর্থে কোন রোগকে আল্লার ইচ্ছা ছাড়া স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে সংক্রামক মনে করা হতো, তা ভুল। রোগ কখনো নিজে নিজে সংক্রমণ করতে পারেনা। বরং আল্লাহর আদেশে সংক্রমণ করে। এটা বোঝানোর জন্যই আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুষ্ঠ রোগীর সাথে বসে খাবার খেয়েছেন। যেন মানুষ বুঝতে পারে যে, রোগ এবং সুস্থতা প্রদান করেন আল্লাহ। আর তাদের থেকে দূরে থাকতে বলেছেন, এটা বোঝানোর জন্য, আল্লাহতালার চিরন্তন কানুন এই যে, কারণ— কার্যের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে। তাই মেলামেশা সংক্রমণের কারণ হতে পারে। অর্থাৎ সংক্রমণ করার ক্ষেত্রে রোগের একক ক্ষমতা যথেষ্ট নয়। যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন তাহলে সেই রোগ থেকে সংক্রমনের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারবেন। আর যদি তিনি ইচ্ছা করেন স্বাভাবিক নিয়মে অব্যাহত রাখতে পারবেন।
শাফেয়ী মাযহাবের অধিকাংশ আলেম এই মত গ্রহণ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘চিকিৎসা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, শ্বেত রোগ ও কুষ্ঠ রোগ সংক্রামক ব্যাধি। এটা এমন একটি ব্যাধি, যার কারণে স্বামী-স্ত্রী পর্যন্ত সহঅবস্থান করতে পারে না।’ ইমাম বাইহাকী রহ. বলেছেন, সংক্রমণ নেই অর্থ হলো— জাহিলিয়াতের যুগে মানুষটা যে অর্থে সংক্রমনের ধারণা রাখত তার কোন ভিত্তি নেই। তাছাড়া প্রাকৃতিক নিয়মের কারণে এক রোগীর রোগ অন্যের মাঝে স্থানান্তরিত হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছা কার্যকর।
এই উভয় ধরনের হাদিসের সামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে হাফেজ ইবনে সালাহ, তারপরে যারা এসেছেন সকলে এবং তার পূর্বে যারা বিগত হয়েছেন, তাদের একটি দল এই মতের ধারক ছিলেন।’ এই মতের পক্ষেই অধিকাংশ আলেমদের মত পাওয়া যায়। মাওলানা তাহমীদুল মাওলা দা.বা. সম্প্রতি ‘ইসলামে কি ছোঁয়াচে রোগের ধারণা নেই’ শীর্ষক একটি আলোচনায় এই মতকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। (https://youtu.be/_Bl6eGkGQjI)
সংক্রমণ প্রশ্ন ও বাংলাদেশের আলেম সমাজ
স্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আলেম সমাজ উল্লিখিত ইবনে হাজার আসকালানীর ব্যাখ্যাগুলোর মাঝে কোন না কোনটি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু ব্যাখ্যার যে বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ— এক্ষেত্রে একেকজনকে একেক অবস্থানে দেখা যায়। একটা স্বাভাবিক ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় একেক জনকে। কিন্তু সেটা কখনো কখনো আংশিক সঠিক হয়। বিভাজন ও বিভক্তির ক্ষেত্রে পুরোপুরি হয়তো সঠিক হয় না। কিন্তু এর মাধ্যমে আলেমদের বিভিন্ন শ্রেণীর প্রবণতা ও ঝোঁক কোন দিকে— তা ফুটে উঠে।
ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি ‘কানুনুত তা’বিল’ গ্রন্থে কোরআন-হাদিসের টেক্সের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরামকে পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন চিন্তার আলেমদের ঝোঁক ও প্রবণতা বুঝতে— এই বিভক্তিকরণ আমাদেরকে সাহায্য করবে।
১. এমন আলেমদল, যারা কোরআন-হাদিসের বাহ্যিক উদ্ধৃতিকেই যথেষ্ট মনে করেন। এক্ষেত্রে আকল প্রয়োগের কোন প্রয়োজন তাদের কাছে নেই। তারাই বিভিন্ন সময়ে সুন্নাতুল্লাহ বা আল্লাহ তায়ালার চিরন্তন নিয়ম-কানুনকে আমলে নেন না। তাদের মধ্য থেকেই বর্ণিত আছে, ‘আল্লাহ একক ব্যক্তিকে একই সময়ে ভিন্ন দুটি স্থানে অবস্থান করাতে পারেন’।
২. আরেকটি দল আছে, যারা কোরআন হাদিসের উদ্ধৃতির কোন তোয়াক্কা করেন না। তাদের নিকট সর্বোচ্চ মর্যাদার স্থান পায় আকল। এমনতর লোকদের থেকেই বর্ণিত আছে, ‘নবী-রাসূলগণ যেহেতু মানুষ। আর মানুষ গুনাহ করতেই পারে। সুতরাং নবী-রাসূলগণও গুনাহ করতে পারেন’।
৩. যে আলেমগণ কুরআন হাদিসের উদ্ধৃতিকে গ্রহণ করেন ঠিক, কিন্তু ফায়সালাকারী মানেন আকলকে। তারা কোরান ও প্রশিদ্ধ, ব্যাখ্যানিরপেক্ষ হাদিস গ্রহণ করে নেন। কিন্তু যেসব হাদীসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কষ্টসাপেক্ষ ব্যাখ্যা করা হয়, তা তারা গ্রহণ করতে চান না।
৪. আর একদল আলেম আছেন, যারা আকলের অবস্থানকে স্বীকার করেন, কিন্তু কোরান হাদিস বুঝতে বাহ্যিক মতনকে অধিক গুরুত্ব দেন। তারা যেহেতু আকল সংক্রান্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে ভাসাভাসা ধারণা রাখেন, তাই তাদের কাছে প্রায়ই মনে হয়— আকল বুঝি কোরআন হাদিসের বিভিন্ন বিষয়ের বিরোধী। কোরআন ও হাদীসের ক্ষেত্রে, তাদের মতে, কোন তাবিল ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।
৫. মধ্যমপন্থী দল এ সম্পর্কে বলে, নকল যেমন আমাদের মূল উৎস তেমনিভাবে আকলও একটি মূল উৎস। তারা যুক্তি ও উক্তির মাঝে সমন্বয় সাধন করতে পেরেছেন। তারাই ওই দল যারা নকল ও আকলের মাঝে কোন বিরোধ বিসংবাদকে স্বীকার করেন না।
ইমাম গাজ্জালী এই মতের পক্ষাবলম্বন করে বলেছেন, ‘শরীয়তের ক্ষেত্রে যে বিবেকের অবস্থান অস্বীকার করবে, সে তো খোদ শরীয়তকে অস্বীকার করছে। যদি যুক্তি ও বিবেকের ব্যবহার না করা হতো, তাহলে শরীয়তের সত্যতা অনুধাবন করা যেত না। যদি মানুষ আকলের ব্যবহার না করত, তাহলে কখনোই বুঝতে পারত না— কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা? কে সত্য নবী আর কে নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার।’
বাংলাদেশ হক্কানী আলেমদের মধ্যে সকলেই ব্যাখ্যাগত দিক থেকে পঞ্চম মধ্যমপন্থী ধারার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেকের মাঝে ভিন্ন কেন্দ্রিকতা লক্ষ্য করা যায় মাঝে মাঝে। এবং ঝোঁক ও প্রবণতা কখনোবা মধ্যমপন্থী ধারায় না থেকে বিভিন্ন দিকে মোড় নেয়।
করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে বর্তমানের ধর্মীয় পরিস্থিতিতে— সংক্রমণ প্রশ্নে ভাষার বিভিন্নতা থাকলেও সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, ‘রোগ নিজে নিজে সংক্রমণ করতে পারে না। আল্লাহ তার মাঝে সংক্রমণের ক্ষমতা দিলে তবেই তা পারে।’
তারা করোনাভাইরাসকে সংক্রামক হিসাবে স্বীকার করে নিচ্ছেন। এবং সাথে সাথে এটাও বলছেন যে, এটার পেছনে মূল কারক মহান আল্লাহ তাআলা। কিন্তু এই ব্যাখ্যার পরিপেক্ষিতে প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা একমত হতে পারেননি। সামাজিক দূরত্ব (social distance)–এর স্বরূপ কি হবে ধর্মীয় মহলে, তা নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য সামনে আসছে। এখানে একেকজনের একেক রকম বক্তব্য তাদের ঝোঁক ও প্রবণতাকে চিনিয়ে দিতে সাহায্য করছে আমাদের। এক্ষেত্রে ইমাম গাজ্জালীর মানদণ্ডে তাদের অবস্থানকে অবলোকন করা যেতে পারে।
ফিকহে ইসলামীতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। সে হিসেবে আলেমদের বিভিন্ন বক্তব্য যে সামনে আসছে— সেটা যৌক্তিকও। কিন্তু প্রত্যেকের বিভিন্ন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত ধর্মীয় পরিস্থিতির দায়ভারও তারা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত— এমন সৎসাহসী বক্তব্য আজ তাদের পক্ষ থেকে আসা দরকার। সাধারণ তৌহিদী জনতা আজ তাদের মুখের পানে চেয়ে আছে।
তথ্যসূত্র :
১. সহিহ বুখারী ও মুসলিম শরীফ
২. আহমাদ বিন আলী বিন হাজার আল আসকালানী, ফাতহুল বারী শারহু সহীহিল বুখারী, প্রকাশ : দারুল মা’রিফা, বৈরুত ১৩৭৯ হি.
৩. ড. আহমেদ তাইয়িব, মাবদাউল ইল্লিয়্যাহ বাইনান নাফী ওয়াল ইছবাত, প্রকাশ : দারুত তিবায়াহ আল-মুহাম্মাদিয়্যাহ, আল আজহার ১৯৮৭ ঈ.
৪. কাজি আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে আরাবী, কানুনুত তা’বিল, প্রকাশ : দারুল কিবলাহ লিছ-ছাকাফাতিল ইসলামিয়্যাহ, জেদ্দা ১৯৮৬ ঈ.
৫. আবু হামেদ আল গাজ্জালী, কানুনুত তা’বিল, প্রকাশ : ১৯৯৩ ঈ.
The post ইসলাম ও সংক্রমণ : মুসলিম চিন্তার ঐতিহাসিক পাঠ appeared first on Fateh24.
from Fateh24 https://ift.tt/3akF9Q6
No comments:
Post a Comment