Friday, July 10, 2020

‘এবার অনেক মিস করবো’ : মাদরাসার ছাত্রদের কুরবানির ঈদ

কওমি মাদরাসার বার্ষিক আয়ের বড় অংশ উঠে আসতো ঈদুল আজহায় কুরবানির চামড়া সংগ্রহ করে। কিন্তু গত দু’ বছর ধরে আয়ের এই খাতটি ক্রমবনতশীল। করোনার কারণে এই খাত এবার খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। কুরবানির চামড়া সংগ্রহ বা কিনবে না বলে ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনেক মাদরাসা। অন্যবারের মতো এবার চামড়া তোলার সেই উৎসব উৎসব আমেজটা থাকবে না। বাড়ি বসে মাদরাসার ছাত্ররা মিস করবে ঈদের দিনের এই ব্যস্ততাটুকু। প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ফাতেহের সঙ্গে স্মৃতিচারণ এবং বিশ্লেষণ করেছেন আশরাফুল হক, আবু সাঈদ, শহিদুল ইসলাম। ছাত্রদের স্মৃতিচারণের পাশাপাশি আমরা একজন শিক্ষকের স্মৃতিচারণও শুনতে চেয়েছি।

আশরাফুল হক
শিক্ষক, বাঞ্চারামপুর

আদব এবং ইফতা—এই দুই বছর ঢাকার দারুল উলুম মাদানীনগর মাদরাসায় পড়ার সময় চামড়া তোলার কাজে তদারকির দায়িত্বে ছিলাম। না করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সোৎসাহে করেছিলাম। নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ এলাকা ছিল আমার ওয়ার্ক জোন। তারপর শিক্ষকতায় যখন এলাম, তখনও চামড়া তোলার কাজে তদারকিই করতে হয়েছে। চামড়া বাজারজাত করেই মাদরাসার আয়ের বড় একটা অংশ উঠে আসতো। কাজটা করার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল লিল্লাহিয়্যাত, আল্লাহ তায়ালার খুশী। আমি ভাবতাম—অনেকেই মাদরাসার গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি করতে পারছে না। আলহামদুলিল্লাহ, আমি পারছি।

লিল্লাহিয়্যাত থাকলে সব কাজেই তৃপ্তি পাওয়া যায়। অনেকে অনেক কিছু বলে, কিন্তু ওগুলো গায়ে লাগে না। অনেকেই বলে, ছাত্ররা ঈদের দিন বাড়ি না গিয়ে, আনন্দ না করে কাজ করছে। বাড়ি যাওয়াটাই কিন্তু একমাত্র আনন্দ না। একজন দ্বীনদার মুমিনের জীবনে আরও অনেক কিছুতেই আনন্দ আছে। আল্লাহর জন্য কাজ করতে পারা- এরচে আনন্দ আর কী আছে! মাদরাসার জন্য আমি শ্রম দিচ্ছি, এতিমদের খাদ্যব্যবস্থাপনায় সহায়তা করছি—এটা কম আনন্দের নয়।

ওইযে বললাম লিল্লাহিয়্যাত, এটা থাকলে নেতিবাচক কথা, অপমান গায়ে লাগে না। এইদিনে আরও অনেকেই তো চামড়া ব্যবসার কাজে জড়িত। ব্যবসায়ীরা খাবার খাওয়ারও সময় পায় না। আরো অনেকে স্বজন রেখে দূর-দূরান্তে বিভিন্ন আয়-উপার্জন করে, শিশুশ্রমও চলে ঈদের দিনে। আসল হলো দৃষ্টিভঙ্গি। মাদরাসার প্রতি যাদের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক, তারাই নানা কথা বলার অপপ্রয়াস পায়। আল্লাহর জন্য মাদরাসার ছাত্ররা যদি কাজটা করে, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এতে দোষের কিচ্ছু দেখি না আমি।

আরেকটি বিষয় হলো, ঈদের দিনে এই শ্রম নিয়ে যারা কতকথা বলে, দেখবেন তারা ইসলামের প্রতিটি সুন্নাহ ও বিধান নিয়েই সুযোগ পেলেই বাঁকা কথা বলে। তো, তাদের কথায় বিব্রতের বোধ হলে ধীরে ধীরে প্রতিটি সুন্নাহ পালনেই আমার বিব্রত বোধ হতে শুরু করবে। এরই সূত্র ধরে অনেককে দেখাও যায় বিভিন্ন সুন্নাহ-মুস্তাহাব পালনে সঙ্কোচবোধ করে থাকে।

তবে আমার মতামত হলো—মাদরাসাগুলো অস্থায়ী এই আয়ের খাতে নির্ভর না করে স্থায়ী কোনো বন্দোবস্ত করুক। তাহলে চামড়ার খাতটি বাদ দিলেও হবে। গত দু’ বছর ধরে এমনিতেই চামড়ার খাতটি ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। এর অন্যতম একটি কারণ—মাদরাসাগুলো চামড়ার বিশাল এই কর্মযজ্ঞটিকে শিল্পে রূপান্তর করতে পারেনি। এতবছর ধরে চামড়া নিয়ে ব্যবসা করছে, কিন্তু নিজেরা কোনো ট্যানারি শিল্প গড়ে তুলতে পারেনি। তাই অনেক মাদরাসা এখন ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে।

তাছাড়া এই কর্মযজ্ঞকে আমরা শিল্পে পরিণত করতে পারলে বিভিন্ন মানুষের ট্যারা কথাও আমাদের শুনতে হতো না। তখন আমরা প্রভাবশালী থাকতাম, মানুষের ট্যারা কথায় প্রভাবিত হতাম না।

বাঞ্চারামপুর যে মাদরাসায় আমি শিক্ষকতা করি, সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে—এ বছর চামড়া কিনবে না মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। গত বছর অনেক টাকা লোকসান হয়েছিল। এ বছর যারা নিশ্চিত দিবে, তাদেরটা গিয়ে নিয়ে আসা হবে। আগের মতো জাঁকজমক, হৈ-হুল্লুড় থাকবে না। একটা নিবিড় পর্দায় ঢাকা থাকবে সবকিছু।

শহিদুল ইসলাম
দাওরা,  কুমিল্লা

আবদুল ওহহাব পিরজী হুজুর রহ. প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম রামপুর। এ মাদরাসায় মেশকাত পড়ে দাওরা পড়ার অপেক্ষায় আছি আমি। কিন্তু কুরবানি ঈদ চলে এলেও খোলেনি মাদরাসা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে খুলবেও না। তবে মাদরাসা না খুললেও চামড়ার কাজ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন শিক্ষকগণ। হয়তো আগের মতো বিরাট পরিসরে হবে না। খুব অল্প পরিসরে, মাদরাসার গ্রামে এই চামড়া কালেকশন হবে।

প্রতিটি ঈদুল আজহায় আমাদের আলাদা একটা ব্যস্ততা থাকতো। ঈদের আগেই দলে দলে এলাকা ভাগ করে নেয়া, কোন এলাকায় কে কে যাবে, কে জবাই করবে, কে চামড়া টানবে। ঈদের দিন মাদরাসায় জম্পেস একটা খাবার হতো। তারপর শুরু হতো কাজ। কাজ শেষ হবার পর জমিয়ে দেয়া হতো আরেকটা খাবার। কাজ করতে গিয়ে নিজেকে কখনো ছোট মনে করিনি। দলবেঁধে যেতাম, চামড়া নিয়ে চলে আসতাম। পিরজী হুজুর রহ.কে সবাই শ্রদ্ধা করে। তাই আমাদেরকে কেউ অসম্মান করতো না। পিরজী হুজুরের বরকত—এই অঞ্চলে মাওলানা-মৌলভিদের অন্যরকম মর্যাদা দেয়া হয়।

তবে এবার হয়তো কিছুই হবে না। চামড়ার বাজার অবনতির কারণে বেশি চামড়া কিনতেও নারাজ মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। কেউ লোকসান নিতে চান না। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে—চামড়া থেকে মাদরাসাগুলোর বিশেষ আয়ের চিন্তাও করা যাচ্ছে না। করোনার কারণে তা আরও জটিল হয়ে পড়েছে। গ্রামের মাদরাসাগুলোতে বড় বড় ডোনেশন কমই আসে। এমনিতেই শিক্ষকদের বেতন বাকি থাকে। তারমধ্যে আয়ের খাতগুলো ধীরে ধীরে সংকীর্ণ হয়ে আসছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার কারণে হয়তো কাজ করতে হবে। কিন্তু সেই আনন্দের আবেশ, দলবেঁধে চামড়া তুলতে যাওয়ার দৃশ্য, কবজি ডুবিয়ে গরুর গোশত খাবার আয়োজন আগের মতো পাব না। বড্ড মিস করবো।

আবু সাঈদ
ইফতা, মালিবাগ

ঢাকার দারুল উলুম মাদরাসায় দাওরা-আদব শেষ করে এবার জামিয়া শরইয়্যাহ মালিবাগে ইফতায় ভর্তি হয়েছি। গত বছর ঢাকার দারুল উলুম মাদানীগর মাদরাসায় আদব পড়েছি। সেখানেই উর্দু থেকে দাওরা শেষ করেছি তার আগে। দীর্ঘ এই সময়ে কয়েকটি ঈদুল আজহায় চামড়ার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সবার সঙ্গে ঈদের দিন সকালে কাজে যেতাম, বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলতাম, আমার ভালো লাগতো। কাজ করতে গিয়ে ভালো যেমন লাগতো, কখনো বিব্রতকর পরিস্থিতেও পড়তাম।

একবার নারায়ণগঞ্জের পূর্ব ইসদাইর গেলাম চামড়া কালেকশন করতে। আমরা চামড়ার দরদাম ঠিক করে ফেলেছি। নিয়ে আসবো। তখন এক নেতা এসে  বিপত্তি বাঁধালো। সে চাইছে চামড়াটা সে নিবে, আমাদেরকে দিবে না। নেতাগোছের লোকটি গরুর মালিকের ওপর একপ্রকার হাত তুলেই ফেললো। আমরা তখন পরিস্থিতি সামাল দিয়ে চলে আসি।

ঢাকা শহরে মাদরাসা যেহেতু অনেক, মাঝেমধ্যে এলাকাভিত্তিক ছাত্রদের সঙ্গে বিপত্তি বাঁধতো। একবার নারায়নগঞ্জ দেওভোগ মাদরাসার এলাকায় গেছি চামড়া আনতে। আনাদেরকে খবর দিয়েই নেয়া হয়েছে। কিন্তু দেওভোগ মাদরাসার ছাত্ররা এসে বললো, এটা আমাদের এলাকা। অন্য এলাকা থেকে এসে চামড়া নিতে পারবে না। মালিক বললো, আমার ছেলে মাদানীনগর মাদরাসায় পড়ালেখা করে, আমিই তাদের খবর দিয়ে এনেছি। তখন সেখানে একটা মনেমালিন্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পরে আমরা চামড়া নিয়ে চলে আসি।

যত যাই হোক, কাজটি উপভোগ করতাম। এবার সম্ভব হবে না। বাড়িতে এসে বসে আছি। কবে মাদরাসা খুলবে, তারও ঠিক নেই। করোনা পাল্টে দিচ্ছে সমীকরণ। তৈরী হচ্ছে নতুন পরিস্থিতি । হয়তো নতুন এ পরিস্থিতিতেই আমাদেরকে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে।

The post ‘এবার অনেক মিস করবো’ : মাদরাসার ছাত্রদের কুরবানির ঈদ appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/2O9MzNB

No comments:

Post a Comment