রাকিবুল হাসান :
মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি পবিত্র ঈদুল আজহা। এই ঈদে পশু কুরবানি দেওয়া ধর্মীয় বিধান, কারও কারও জন্য ওয়াজিব। কিন্তু অনেকেই বলছেন, পশুর হাটের মাধ্যমে করোনা ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হতে পারে, তাই হাট বন্ধ করে দেওয়া হোক। এবার কুরবানি না করে কুরবানির পশুগুলোর সমমূল্যের টাকা সদকা করে দেয়া হোক। কিন্তু আলেম এবং ইসলামি স্কলারগণ বলছেন, ইসলামের যে বিধান সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট এবং সুনির্ধারিত, সে বিধানে বিকল্প চিন্তার কোনো সুযোগ নেই। আর কুরবানির সঙ্গে শুধু ধর্মীয় বিধানই জড়িত নয়, এর সঙ্গে বহু মানুষের জীবন-জীবিকা ও দেশের অর্থনীতিও জড়িত।
কুরবানি ইসলামের সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট এবং সুনির্ধারিত একটি বিধান। সামর্থবানদের এটা পালন করতেই হবে। তবে হাটে গিয়ে পশুক্রয়, ঈদের দিন পশু জবাই ইত্যাদি বিষয়ে স্বাস্থ্যসম্মত বিভিন্ন প্রস্তাবনা পেশ করছেন দেশের আলেমগণ। ব্যাপকভাবে করোনা সংক্রমণ রোধে প্রতিনিয়তই তার এসব প্রস্তাবনা পেশ করে যাচ্ছেন। কোথাও কোথাও প্রশাসনের সঙ্গে তারা এ বিষয়ে মতবিনিময়ও করছেন।
পশুর হাট, প্রস্তাবনা
অন্যান্য বারের মতো ভিড়ভাট্টা না করে এবার একটু সাবধান হয়ে পশু কেনার পরামর্শ দিয়েছেন বসুন্ধরার শায়খ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ। তিনি বলেছেন, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে বড় ও খোলা জায়গায় হাট বসাতে হবে এবং বিক্রেতাদের দূরত্ব বজায় রেখে পশু নিয়ে বসতে হবে। যাতে ক্রেতাদের পক্ষে শারীরিক দূরত্ব মানা সম্ভব হয়। অনেক সময় বিক্রেতারা তিন-চারজনকে সঙ্গে নিয়ে কুরবানির হাটে আসেন। এই প্রবণতা বাদ দিয়ে যত কম সম্ভব মানুষ নিয়ে হাটে আসতে হবে। ক্রেতার ক্ষেত্রেও তা–ই, একা হাটে গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব পশু কিনে বাড়ি ফিরতে হবে।
ঈদের আগের রাতে হাটে গিয়ে ভিড় করে পশু না কিনে আরও আগেই পশু কেনার পরামর্শ তার। তিনি বলেন, বিগত বছগুলোতে ঈদের আগের রাতে হাটগুলোতে পশু কেনার হিড়িক পড়তো। এবার তা না করে আগেই পশু কেনার কাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে। তাহলে ভিড়ও কম হবে, স্বাস্থ্যসচেতনতাও রক্ষা করা যাবে।’
কুরবানি পশুর হাট ব্যবস্থাপনায় ধর্মের চেয়ে প্রশাসনের দায়িত্বটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন লেখক ও অধ্যাপক আ ফ ম খালিদ হোসেন। তার মতে, কুরবানির পশু যেখান থেকে ইচ্ছে, সেখান থেকেই কেনা যায়। যার ইচ্ছে অনলাইন থেকে কিনতে পারে, ইচ্ছে হলে হাটে গিয়েও কিনতে পারে। তবে এই হাটগুলোতে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনার বন্দোবস্ত করতে হবে প্রশাসনের। সরকার এবং প্রশাসন বিভিন্ন কাঁচাবাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। সংকীর্ণ জায়গা থেকে খোলা জায়গায় নিয়ে আসছেন। তেমনি করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে বড় ও খোলা জায়গায় হাট বসাতে হবে এবং বিক্রেতাদের দূরত্ব বজায় রেখে পশু নিয়ে বসতে হবে। যাতে ক্রেতাদের পক্ষে শারীরিক দূরত্ব মানা সম্ভব হয়।
ঝুঁকি কমাতে প্রয়োজনে প্রশাসনকে শক্ত হবার কথাও বলছেন গুণি এই আলেম অধ্যাপক। তার মতে, ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই আবশ্যিকভাবে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, মাথার ক্যাপ ও সম্ভব হলে গাউন পরতে হবে। অনেক ক্রেতা আছেন যাঁরা কয়েকটি হাট ঘুরে যাচাই-বাছাই করে পশু কেনেন, পশু নিয়ে প্রতিযোগিতা করেন—এবারের ঈদে এই প্রবণতা পরিহার করতে হবে। পশুর হাটে যেন অসুস্থ পশু না আনা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে, কোনো পশু অসুস্থ মনে হলে ক্রেতারা তার কাছে যেন না যান। আর গ্লাভস পরা ছাড়া পশুর গায়ে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ক্রেতা-বিক্রেতা, হাটের ইজারাদার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় সরকারকে যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে সচেতনভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, প্রয়োজনে মানতে বাধ্য করতে হবে।
কুরবনির পশু জবাই, গোশত বন্টন
কুরবনির পশু জবাই, গোশত বন্টন নিয়ে কিছু প্রস্তাব করেছেন জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া মুহাম্মদপুরের শিক্ষক মাওলানা তাহমিদুল মাওলা। করোনার কথা মাথায় রেখেই প্রস্তাবগুলো করেছেন তিনি।
তিনি বলেছেন, অনেকে মনে করেন, কুরবানির পশু নিজের বাড়িতে এনে নিজে জবাই করতে হবে। আসলে বিষয়টা তেমন না। কুরবানির মতো আর্থিক ইবাদাতগুলো নিজেও করা যায়, অন্যকে দিয়েও করানো যায়। খুব সহজ। এই ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে কেউ যদি বাইরে বেরুতে না চায়, তাহলে সে তার আস্থাভাজন কাউকে কুরবানির টাকা দিয়ে দিতে পারে, সে কুরবনি করে দিবে। সম্ভব হলে গোশতও পাঠিয়ে দিবে। সম্ভব না হলে পাঠাবে না। কুরবানির গোশত খেতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই।
তাহমিদুল মাওলা বলেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য আরও বড় একটি সুবিধা আছে। এদেশে প্রায় প্রত্যেক এলাকায় কওমি মাদরাসা আছে। কেউ চাইলে মাদরাসায় কুরবানি করিয়ে নিতে পারেন। মাদরাসায় পশু জবাই হলো, সেখান থেকেই গোশত বিতরণ হলো। সম্ভব হলে কুরবানিদাতার বাড়িতেও গোশত পৌঁছে দেয়া হবে। এ খেদমত আঞ্জাম দিতে সকল কওমি মাদরাসা প্রস্তুত আছে।
বন্যাকবলিত এবং দুযোর্গগ্রস্ত এলাকায় কুরবানির কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তাহমিদুল মাওলা। তিনি বলেছেন, এই সময়ে যারা বন্যাকবলিত এবং দুযোর্গগ্রস্ত, তাদের এলাকায় বিশ্বস্ত কাউকে দিয়ে কুরবানি করিয়ে দিতে পারি। এতে আপনরও কুরবানি হলো, অসুবিধগ্রস্ত এসব মানুষেরাও খাবার পেলো। এভাবেই কুরবানির বিধান ও জীবন, দুটোই রক্ষা করা যাবে। অধিকতর পরিশুদ্ধ নিয়তের কারণেকুরবানি কবুলও হবে, ইনশাআল্লাহ্!
জীবন-জীবিকা ও দেশের অর্থনীতি
কুরবানি পশুর হাট ব্যবস্থাপনা, পশু জবাই ও গোশত বন্টন নিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত প্রস্তাবনা দেয়ার পাশাপাশি আলেমগণ গুরুত্ব দিচ্ছেন লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা ও দেশের অর্থনীতির বিষয়টিও। কুরবানির আয়োজন বাধাগ্রস্ত হলে দেশের বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠির জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে বলেও আশঙ্কা তাদের।
অধ্যাপক আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, কুরবানিতে কেবল যিনি কুরবানি করছেন, তিনিই জড়িত না। বরং পশুর হাটের আয়োজন, পশু বাড়িতে আনা, কোরবানি দেওয়া, কাটাকাটির করার সঙ্গেও বহু মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। অনেক খামারি আছেন, যারা এই ঈদ উপলক্ষে বছরব্যাপী পশু লালন-পালন করেছেন, গ্রামের অনেক দরিদ্র মানুষ আছেন, যারা একটা-দুটো গরু-ছাগল পালন করেন এই ঈদে বিক্রির জন্য। এতে যা আয় হয়, তাতে তাদের জীবন চলে বা অভাব কমে। আবার কোরবানির পশুর চামড়া দেশের চামড়াশিল্পের কাঁচামালের জোগানের সিংহভাগ পূরণ করে, এই শিল্পের বিভিন্ন পর্যায়েও বহু শ্রমিক ও ব্যবসায়ী জড়িত।
গরিব-দুখিদের দিকটি তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশে এমন কিছু প্রান্তিক মানুষ আছেন, যারা সারা বছর মাংস খেতে পান না, এই কুরবানির ঈদের জন্য তাঁরা অপেক্ষা করেন, তাদের কথাও ভাবতে হবে। কুরবানির মাধ্যমে এসব মানুষরা ভালো একটা খাবার পাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় পক্ষকেই মনে রাখতে হবে সুরক্ষা নিজের কাছে, নিজেও বাঁচতে হবে, অন্যকেও বাঁচাতে হবে। সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মানলে ধর্মীয় বিধান ও জীবন দুটোই রক্ষা পাবে, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে আসবে।
The post করোনায় কুরবানি : আলেমদের প্রস্তাবনা appeared first on Fateh24.
from Fateh24 https://ift.tt/2ObD5RT
No comments:
Post a Comment