Friday, November 20, 2020

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইসলামি রাজনীতির হাল হাকিকত

রাকিবুল হাসান:

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় সবচে শানদারভাবে ইসলামি রাজনীতি করছে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ। অন্যান্য ইসলামি দলগুলোও চেষ্টা করছে তাদের সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চটুকু করার। জেলায় ইসলামি রাজনীতির হাল হাকিকত কেমন, জানতে চেয়েছিলাম সংশ্লিষ্টদের কাছে। আশা এবং হতাশা দুটোই ফুটে উঠেছে তাদের কণ্ঠে। আজকের পর্বে রইলো তার বয়ান।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ

কথা হয় দলটির ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক শামস আল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানালেন, অন্যান্য জেলার মতো এ জেলাতেও চলছে সক্রিয় কর্মসূচী। জেলার নয়টি উপজেলাতেই তাদের কমিটি আছে। নয়টি জেলায় মোট ইউনিয়ন ১০০টি। এমধ্যে ৭০ এর অধিক ইউনিয়নে রয়েছে তাদের কমিটি। মূল জেলা অফিস সদরের পৌর শহরে। অফিসের সঙ্গে রয়েছে ২০০ মানুষ ধারণ ক্ষমতার একটি হলরুম। তাদের অধিকাংশ সভা এ হলরুমেই হয়। তবে ইউনিয়নভিত্তিক যে অফিস রয়েছে, সেগুলো এমন বড় নয়।

নামেই কমিটি, নাকি কাজে–জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, আমরা কাজ করার চেষ্টা করি। প্রতি মাসে আমাদের মাসিক সভা হয়। কর্মসূচী থাকলে মাসে জরূরী সভা হয় দুটি। কদিন আগে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তাতে দেখা গেছে , আমাদের কমিটির মেয়াদকালে মাসিক সভা হওয়ার কথা ১৮টি, কিন্তু আমরা করতে পেরেছি ১৫টি। করোনার কারণে দু’তিন মাস বন্ধ ছিল। জরুরী সভা করেছি ৩২টি।

জেলায় ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে কাজ করছে তাদের সহযোগী আরও তিনটি সংগঠন। ইশা ছাত্র আন্দোলন, যুব আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন। শ্রমিক আন্দোলনের ইউনিটভিত্তিক কমিটি রয়েছে ৮১টি। যেমন অটো চালক কমিটি, বাস চালক কমিটি ইত্যাদি। বার্ষিক সভা, আলোচনা সভা, দিবস উদযাপন ইত্যাদি আয়োজন করে মূলত সহযোগী সংগঠনগুলো।

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ জেলায় ৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে দলটি। গত পৌর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে ৩০ টি পৌরসভায়। পৌরসভা নির্বাচনে সদরে পেয়েছে ১৬০০ ভোট। বাকি প্রত্যেকটি ইউনিয়নে পেয়েছে ৫০০/৬০০ করে ভোট। তবে নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা শোনালেন শামস আল ইসলাম। তিনি বললেন, ‘এখানে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়-ই না। গত পৌরসভা নির্বাচনে সদরে ৮টি ইউনিয়নে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। সদরে ১৫৫টি ভোটকেন্দ্রের ১২২টিতে এজেন্ট দিয়েছিলাম। বিএনপির ভোট ছিল সাত-সাড়ে সাত হাজারের মতো। কিন্তু আমাদের এজেন্টদের হিসাব অনুযায়ী আমরা ভোট পাই দশ হাজারের অধিক। সেখানে আমরা পেয়েছি মাত্র ২৯৯০ টা। এক ইউনিয়নে এজেন্ট বললো ,ভোট পেয়েছি ৫৭টা। কিন্তু নির্বাচন অফিসে যাবার পর ঘোষণা দিল, আমরা পেয়েছি মাত্র ২২টা।’

এই ব্যবধানটা কেন জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘বিএনপি এজেন্টদের মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। তাদের ভোটারদের মারধর করা হয়। কিন্তু আমাদেরকে তা করে না। বলে এরা তো নিরীহ, এরা থাকুক। ফলে ভোট আমাদের বেশি হয় বিএনপি থেকে। কিন্তু সব জায়গায় আমরা যদি বিএনপি থেকে বেশি পাই, তাহলে সন্দেহ সৃষ্টি হবে। তাই বিএনপির চেয়ে ভোট কমাতে গিয়ে এ কারচুপি করে।’

আগামী বছরের শুরুতেই পৌরসভা নির্বাচন। দলটি এবার ১০০টি ইউনিয়নে প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতি ইউনিয়ন থেকে প্রথমিকভাবে তিনজন দেয়া হয়। এদের মধ্যে একজনকে দেয়া হয় নমিনেশন। এবার প্রতি ইউনিয়নে যুব আন্দোলন থেকেে একজন এবং ইসলামি আন্দোলন থেকে দুজন, এই মোট তিনজন দেয়া হবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে দেয়া হবে নমিনেশন।

ইসলামি ঐক্যজোট

দলটির ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার যুগ্মসম্পাদক মুফতি এনামুল হকের মতে, অন্যান্য জেলার চেয়ে ইসলামি ঐক্যজোটের কার‌্যক্রম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় বেশি সংগঠিত। জেলার কৃতিসন্তান মুফতি ফজলুল হক অমিনি রহ. ছিলেন এ দলটির চেয়ারম্যান। তাই এ জেলার মানুষ দলটিকে ‍ভিন্নচোখে দেখে।

মুফতি এনামুল হক জানালেন, জেলার নয়টি উপজেলাতেই তাদের কমিটি আছে। নয়টি জেলায় মোট ইউনিয়ন ১০০টি। এমধ্যে ৭০ এর অধিক ইউনিয়নে রয়েছে তাদের কমিটি। তবে তারা নির্বাচন করেন কেবল তিনিটি ইউনিয়নে। ১. ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ২. সরাইল ৩. নবীনগর। আগামী পৌরসভা নির্বাচনেও এ তিনটি ইউনিয়নে তারা প্রার্থী দিবে।

করোনার এই সঙ্কটময় সময়ে দলটি জেলার প্রায় ১০ হাজার মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছে। প্রায় চার হাজার মানুষকে দিয়েছে আর্থিক সহায়তা। এছাড়াও সামাজিক বিভিন্ন কাজে তারা যুক্ত থাকে। তাদের মাসিক সভা হয় এবং বিভিন্ন উপলক্ষ্যে আলোচনা অনুষ্ঠান হয়।

খেলাফত মজলিস

দলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখা থেকে এখনো কোন নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তার প্রধান কারণ নেতৃত্ব সংকট। দলটির সাধারণ সম্পাদক এসএম শহীদুল্লাহ বললেন, ‘জামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসা জেলার সুপ্রাচীন মাদরাসা। পুরো জেলাতেই এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। জেলার কৃতিসন্তান মুফতি ফজলুল হক অমিনি রহ. ছিলেন ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান। তিনি এমপি নির্বাচন করেছেন। তার প্রভাব এখনো এ ভূমিতে আছে। বিখ্যাত নন্দিত ওয়ায়েজ মাওলানা যুবায়ের আহমদ আনসারী রহ. ছিলেন নাসিরনগরের সন্তান। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির। তারপর মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীবও এ জেলার অষ্টগ্রামের সন্তান। তিনি জমিয়তের সহসভাপতি। এই এতগুলো ব্যক্তিত্ব দল ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে কাজ করেছে এবং করছে। কিন্তু এদের মতো বড় কোনো ব্যক্তিত্ব খেলাফত মজলিসে নেই, যাকে কেন্দ্র করে দলটি এগিয়ে যাবে। তাই আমরা যারা আছি, নিজেদের গতিতে কাজ করছি।

তিনি আরও বলেন, থানা পর্যায়ে আমাদের নির্বাচনী কার্যক্রম আপাতত নেই। তবে আগামী নির্বাচনে প্রর্থিতা করার মতো সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে। বিশেষ করে নাসিরনগরে আমরা কয়েকটি ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো ইনশাআল্লাহ। আমাদের সম্ভাবনাময় প্রার্থী আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া সাহেব।

জেলার অধিকাংশ থানাতেই দলটির কমিটি আছে। জেলা সভাপতি আলহাজ্ব হাজী এমদাদুল্লাহ সিরাজী জেলা পর্যায়ে আছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি। জেলায় তাদের স্থায়ী কোনো অফিস নেই। অস্থায়ী অফিস হিসেবে ব্যবহার করছে সদরের কাউতলির একটি স্কুল।

তাবলীগ

কথা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা মারকাজ মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা ইজাজুল হকের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘মাওলানা সাদ কান্ধলবির অনুসারীরা মারকাজ ছেড়ে গেলে মারকাজে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। কারণ, যাদের কাজই শুধু তাবলীগ করা, এমন সাথীদের অধিকাংশই সাদ কান্ধলবির অনুসারী। তারাই বয়ান করতো, পরিচালনা করতো। কিন্তু তারা চলে যাবার পর শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসেন উলামায়ে কেরাম। আগে যারা পঠন-পাঠনেই লিপ্ত ছিলেন, তারা এসে যুক্ত হলেন তাবলীগের কাজে। শবগুযারীতে বয়ান করতে লাগলেন আল্লামা সাজেদুর রহমান, মুফতি মুবারকুল্লাহ সাহেবের মতো ব্যক্তিগণ। তারা যুক্ত হবার পর পরিবেশ পালটে গেলো। সাদ অনুসারীদের অনেকে আবার মারকাজে ফিরে এলো।’

কারোনায় দীর্ঘদিন তাআলীগের কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর এখন শুরু হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে তিন-চার জামাত করে বের হচ্ছে। তবে করোনার আগে মাদরাসার ছাত্রদের জামাত বের হলেও এখন বের হচ্ছে না। কারণ, করোনার ছুটির কারণে এমনিতেই সিলেবাস অনেক পিছিয়ে। করোনার আগে প্রতিটি বড় মাদরাসা থেকে প্রতি সপ্তাহে তিন-চার জামাত করে বের হতো। তারা মঙ্গলবার এসে রুখ নিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার মাদরাসা থেকেই রুখে চলে যায়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সব থানাতেই তাবলীগ চলে কিনা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, সব জায়গাতেই চলে। তবে মূল মারকাজে শবগুযারি হয়। এছাড়াও শবগুযারির জন্য পয়েন্ট খোলা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। মারকাজ থেকে আলেমরা গিয়ে বয়ান করেন। তবে বাঞ্চারামপুর আমাদের সঙ্গে তেমন সংযুক্ত নেই। কারণ, থানাটি আমাদের মারকাজ থেকে অনেক দূরে। তাই মারকাজের হয়ে সেখানে শবগুযারি পয়েন্ট খোলা হয়নি।’

এ জেলায় তাবলীগের কাজ করতে বাধা আসে কিনা? মাওলানা ইজাজুল হক বললেন, ‘তেমন বাধা আসে না। তবে কিছু কিছু এলাকায় রেজভি অনুসারী আছে, তারা বাধা দেয়।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তাবলীগ এখন আলেমসম্পৃক্ত। আলেমরা জুড়ে আছেন তাবলীগের কাজে।এই হলো সবচে বড় আশার কথা।

The post ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইসলামি রাজনীতির হাল হাকিকত appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/38VhjgS

No comments:

Post a Comment