Friday, November 27, 2020

উচ্চ আদালতে ঝুলছে ১২ আলোচিত মামলার বিচার

ফাতেহ ডেস্ক:

আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর বেশ কয়েকটি মামলায় বিচারিক আদালতে রায় হলেও উচ্চ আদালতে সেগুলোর শুনানি ও নিষ্পত্তির গতি নেই। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, রমনার বটমূলে বোমা বিস্ফোরণ মামলা, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখার মামলা, হলি আর্টিজান মামলা, ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর বিচারকাজ একপ্রকার থমকে আছে। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ড অনুমোদন) ও আপিলের মামলাও। এছাড়া হাইকোর্টে নিষ্পত্তি হলেও আপিল বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে পিলখানা হত্যা মামলা, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা, পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ হত্যা মামলা, টঙ্গীর আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলা, সিলেটের রাজন হত্যা মামলা, খুলনার রাকিব হত্যা মামলাসহ বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর মামলা।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানান, চলতি বছরের শুরুতে চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেয় সুপ্রিম কোর্ট ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে বছরের শুরু থেকে লম্বা সময় উচ্চ আদালত বন্ধ থাকে। একপর্যায়ে সীমিত পরিসরে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে শুনানি শুরু হলেও চাঞ্চল্যকর মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া যায়নি।

অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন জানান, করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বাভাবিক বিচারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন তিনি। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, ন্যায়বিচারের স্বার্থে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের অন্তত ৭৮৬টি মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদর দপ্তরে সংঘটিত হত্যা মামলায় ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল থাকে। এছাড়া হাইকোর্টের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড পান ১৮৫ আসামি। পাশাপাশি ২০০ আসামিকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড। হাইকোর্টের রায়ের দুই বছরের বেশি সময় পর গত ১৩ জানুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। তবে দেশের ফৌজদারি মামলার বিচারের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আসামির এ মামলার বিচারকাজ আপিল বিভাগে এখনো শুরু হয়নি।

নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের পর ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্ট এক রায়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা সাবেক কাউন্সিলর নুর হোসেন, র‌্যাব-১১-এর বরখাস্ত কর্মকর্তা তারেক সাঈদসহ ১৫ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে। এরপর ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। নিয়ম অনুযায়ী দন্ডপ্রাপ্ত ও পলাতক আসামিরা আপিল বিভাগে আবেদন করেন। কিন্তু তিন বছরের বেশি সময় পার হলেও আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হয়নি।

পুরান ঢাকায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে নিহত দর্জি বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে আটজনের মৃৃত্যুদন্ডের রায় হয়। ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট হাইকোর্ট দুজনের মৃত্যুদন্ড বহাল, চারজনের মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুজনকে খালাস দেয়। এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১৩ জনের মধ্যে যে দুজন আপিল করেন তারাও খালাস পান। ওই বছরের ৩১ অক্টোবর হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে কারাগারে থাকা দন্ডপ্রাপ্তরা আপিল করেন। কিন্তু তিন বছরের বেশি সময়েও এ মামলার শুনানি শুরুর উদ্যোগ নেই।

২১ আগস্ট মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বিচারিক আদালত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদন্ড এবং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় দেয়। ওই বছরের ২৭ নভেম্বর ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পাঠানো হয়। রায়ের বিরুদ্ধে দন্ডপ্রাপ্তরাও (পলাতক ছাড়া) আপিল ও জেল আপিল করেন। কারাগারে থাকা সাজাপ্রাপ্তদের ৪৪টি আপিল ২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট শুনানির জন্য গ্রহণ করে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন গত আগস্টে জানায়, এ মামলায় পেপারবুক প্রস্তুত হয়েছে। তবে দেশ-বিদেশে আলোচিত এ মামলা বিচারিক আদালতে শেষ হলেও দুই বছরেও হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়নি।

২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল সিলেটের শিশু রাজন হত্যা মামলায় প্রধান আসামি কামরুল ইসলামসহ চারজনকে বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রেখে রায় দেয় হাইকোর্ট। ওই বছরের ২৫ জুলাই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া খুলনায় পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে শিশু রাকিবকে হত্যা মামলায় হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল দুই আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন সাজা কারাদ- দেয়। ওই বছর ৩ মে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। কিন্তু সাড়ে তিন বছরেও আলোচিত এ দুটি হত্যা মামলায় আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হয়নি।

গাজীপুরের টঙ্গীতে আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ড পাওয়া ২২ জনের মধ্যে ছয়জনের ফাঁসির দ- ২০১৬ সালের ১৫ জুন এক রায়ে বহাল রাখে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সাতজনের মৃত্যুদন্ড কমে যাবজ্জীবন ও সাতজন খালাস পান। এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ছয়জনের মধ্যে দুজনের সাজা বহাল থাকে। চারজন খালাস পান। ওই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। আপিল বিভাগে এ মামলাটিরও শুনানি অদ্যাবধি শুরু হয়নি।

ফেনীর সোনাগাজীতে স্থানীয় ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় ফেনীর বিচারিক আদালত এক রায়ে ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদন্ড দেয়। নিয়ম অনুযায়ী বিচারিক আদালতের রায়ের পর গত বছর ২৯ অক্টোবর মৃত্যুদন্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স নথি হাইকোর্টে আসে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছিলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ মামলার শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে পেপারবুক প্রস্তুত হলেও শুনানি এখনো শুরু হয়নি।

চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বিচারিক আদালত এক রায়ে ১৪ জনকে মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় দেয়। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য উঠলে ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক এ মামলায় চট্টগ্রামের বিচারিক আদালতে মামলাসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে শুনানি নিয়েছিলেন জানিয়ে এটি শুনতে অপারগতা প্রকাশ করে নতুন বেঞ্চে শুনানির কথা বলেন। কিন্তু পরে আর শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় নারকীয় জঙ্গি হামলা মামলায় গত বছর ২৭ নভেম্বর বিচারিক আদালতের রায়ে সাত জঙ্গিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের কথা বলা হয়। রায়ের মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সাতজনের ডেথ রেফারেন্স বিচারিক আদালত থেকে গত বছর ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠানো হয়। গত ১৮ আগস্ট এ মামলার পেপারবুক বিজি প্রেস থেকে হাইকোর্টে এলেও এখন পর্যন্ত শুনানি শুরু হয়নি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে আদালত এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ভার্চুয়াল এবং নিয়মিত বেঞ্চে বিচারকাজ চলছে। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা এখনো আদালতে আসতে পারছেন না। আদালতও পুরো সময় ধরে হচ্ছে না। এসব নানা সমস্যার কারণে গুরুত্বপূর্ণ মামলারগুলোর শুনানি শুরু করা যাচ্ছে না। তবে আমরা আশা করছি এ অবস্থা অচিরেই কেটে উঠবে এবং তখনই শুনানির উদ্যোগ নেব।’ তিনি বলেন, এটি নিশ্চিত করে বলতে পারি গুরুত্বপূর্ণ এ মামলাগুলো আমাদের নজরে রয়েছে। কোর্টের স্বাভাবিক শুনানি শুরু হলেই আমরা উদ্যোগ নেব।’

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘শুধু এ মামলাগুলোই নয়, অসংখ্য ডেথ রেফারেন্স, যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামির আপিল দীর্ঘদিন ধরে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। যে আসামি মৃত্যুদন্ডের সাজা নিয়ে বছরের পর বছর কারাগারের কনডেম সেলে কাটালেন এবং যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত যে আসামি ইতিমধ্যে কয়েক বছর কারাগারে কাটিয়ে দিলেন এখন সেসব আসামি যদি উচ্চ আদালতের রায়ে খালাস পান তাহলে তার মানসিক অবস্থা কী হয়?’ তিনি বলেন, ‘বিচারপ্রার্থীর দ্রুত বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আমরা চাইব ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’

The post উচ্চ আদালতে ঝুলছে ১২ আলোচিত মামলার বিচার appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/2JgnXn4

No comments:

Post a Comment