Friday, July 3, 2020

কালো-সাদা-তামাটে: মুসলিম কল্পনায় বর্ণ ও সৌন্দর্য

আবদুল্লাহিল বাকি:

প্রাককথন

ইসলামি কোন বর্ণবাদী প্রকল্প কিংবা বর্ণবৈষম্যের অবকাশ নেই। বিশেষ কোন জাতি গোত্র ও বর্ণ নিয়ে গর্ব করার বিষয়টি নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এজন্যই আল্লাহ কোরআনে বলেছেন— ‘হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।’

বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটা জাতি অন্য আরেকটি জাতি থেকে পৃথক পরিচয় লাভ করে, বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর ফলে। কিছু দিক থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাঝে মিল থাকে যদিও, তবু অনেক বৈশিষ্ট্য এমন থাকে, যা তাকে অন্যের থেকে আলাদাভাবে চিনতে সাহায্য করে।

আল্লাহ যদি সকলের মাঝে অভিন্ন গুণাগুণ প্রদান করতেন তাহলে তাদের পরস্পরের পরিচয়ের উদ্দেশ্য বিঘ্নিত হতো। জাতিগোষ্ঠীকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যেত না।

জাতিগোষ্ঠীকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে, আল্লাহ যেমন তাদের মাঝে দেহের রং ও গড়নের মাধ্যমে বাহ্যিক বিভিন্নতা দান করেছেন, তেমনিভাবে তাদের মাঝে দান করেছেন নৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও গুণাগুণের অভ্যন্তরীণ বিভিন্নতা। মুসলিম তাত্ত্বিক ও সাহিত্যিকগণ যদিও বর্ণ নিয়ে বৈষম্যমূলক আলোচনা করেননি, কিন্তু এসব বর্ণের মাঝে যেই নৃতাত্ত্বিক উপাদানগুলো লুকিয়ে রয়েছে, সেগুলো উন্মোচন করার প্রয়াস চালিয়েছেন। বিভিন্ন অঞ্চল ও বর্ণভেদে মানুষের আচার-আচরণে যে ফারাক তৈরি হয়—সেটা তারা তুলে ধরেছেন।

অঞ্চল ও বর্ণভেদে বৈশিষ্ট্যের বিভিন্নতার বিষয়টি ইবনে খালদুন‌ও তার মুকাদ্দামায় তুলে ধরেছেন। মূলত ভূতত্ত্ববিদরা পৃথিবীকে সাতটি ইকলিম বা অঞ্চলে বিভক্ত করেছেন। প্রতিটি ইকলিম মানুষের স্বভাব চরিত্র, আচার আচরণে যেই গভীর প্রভাব ফেলে তা ইবনে খালদুন বিস্তারিতভাবে আলোচনায় এনেছেন। দাবি প্রমাণের জন্য দলিল হিসেবে অনেক উপমাও পেশ করেছেন। এখান থেকে এই সিদ্ধান্তে তিনি পৌঁছেছেন যে, ভারসাম্যপূর্ণ আবহাওয়ার ইকলিমে বসবাসকারী মানুষ সর্বদিক থেকে উত্তম হয়ে থাকে। কিন্তু প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম ইকলিমে বসবাসকারী মানুষদের মাঝে তেমন উত্তম গুণাবলী পরিদৃষ্ট হয়না। তারা তাদের বসতি নির্মাণ করে থাকে বাস-খড়-মাটি দিয়ে। খাদ্যগ্রহণ করে জারা নামক এক প্রকার নিম্নমানের খাবার, পোকামাকড় ইত্যাদি থেকে। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্ধনগ্ন থাকে, বসন গ্রহণ করলে সাধারণত গাছের লতা পাতাকে বেছে নেয়। কিন্তু তাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন তৃতীয় চতুর্থ ও পঞ্চম ইকলিমের বসবাসকারীগন। আবহ, জলপরিমণ্ডলগত দিক থেকে এই অঞ্চলগুলো ভারসাম্যপূর্ণ। এর প্রভাব প্রতিভাত হয়ে উঠে তাদের চাল-চলন, দৈনন্দিন আদত-অভ্যাস, লালিত সাংস্কৃতিক সক্রিয়তায়। এসব অঞ্চলের লোকজন ভারসাম্যপূর্ণ মেজাজের হয়ে থাকে, ফলে তারা ক্ষেত্রবিশেষে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়। তাদের মাঝেই গড়ে উঠে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, রাষ্ট্র-সংবিধান-সমরকলা। তাদের মাঝেই নবী-রাসুল পয়গম্বর এসেছেন যুগে যুগে হিদায়াতের বাণী নিয়ে। বড় বড় প্রতাপশালী সালতানাত জন্ম নিয়েছে তাদেরই ক্রোড়ে। উন্নত কৃষিসভ্যতা, চাষাবাদ ব্যবস্থা, উপার্জনের আধুনিক উপকরণও তারা ব্যবহারে আনতে পেরেছে। এই উন্নত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে আরব, রোমান, পারস্য, ইজরাইল জাতি, ইউনান, হিন্দ, চীন।

মানবের মধ্যে রুচি-মত-ঝোঁকের বিভিন্নতার কারণ সম্পর্কে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন ইবনে খালদুন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, কি কারণে নিগ্রোদের স্বভাবে লঘুত্ব ও আনন্দপ্রিয়তা বেশি। এ আলোচনায় তার অগ্রজ ছিলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আল মাসঊদী। তিনি মুরুজুজ জাহাব গ্রন্থে তা তুলে ধরেছেন। এ ধরণের স্বভাব প্রবণতা এমনসব জাতিগোষ্ঠির মাঝেই পাওয়া যায়, উষ্ণ আবহের দরুন দৈনন্দিন খাদ্যদ্রব্য যাদের জন্য সহজলভ্য। কিন্তু এর বিপরীতে আছে ঐসব অঞ্চল যেমন উদাহরণত ‘ফেজ’, যেখানে শীতলতার দরুন খাদ্যসরবরাহ সহজ নয়। এর চারোদিকে বেষ্টন করে আছে শীতল তুষারের রাজ্য। মানুষরা সেখানে হাঁটে মাথা নিচু করে, যেন তারা প্রচণ্ড বিষণ্ন। ভবিষ্যত পরিণতি নিয়ে গভীর ভাবনার দরুনই এমন হয়। খাদ্যসংগ্রহের ব্যপারে সচেতনতার মাত্রা তাদের এদ্দূর পৌঁছে গেছে যে, তারা বেশ কয়েকবছর খেতে পারবে, এই পরিমাণ গম জমিয়ে রাখে। এসত্ত্বেও তারা নিয়মিত হাটে-বাজারে গিয়ে দৈনন্দিন খাদ্য সরবরাহ করে। ইবনে খালদুন আরো বলেছেন, খাদ্যের বিচিত্রতার বিভিন্ন প্রভাব মানুষের জীবনে দেখা যায়। কিছু জাতি উর্বরা ভূমিক্ষেত্রে বসবাস করে, ফলে তাদের ভূমিতে ফসল-ফলাদির চাষ উপযোগিতা রাখে। কিছু অঞ্চল আছে, যেখানে এই ধরণের শস্য কম হয়, কিন্তু তারা চারিত পশুর গোশত, দুধ খেয়ে তারা জীবনধারণ করে থাকে। নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায় বলা যায়, তাদের সাথে অন্য রক্তের মিশ্রণ হয় কম। ইবনে খালদুন লিখেছেন, বিভিন্ন রক্তের অবিমিশ্রণ একটা মানবজাতিকে শারীরিক ও বৌদ্ধিক দিক থেকে উৎকর্ষিত করে। এসব জাতির লোকেরা হয় শক্তিশালী, ভাগ্যবান, বুদ্ধি হয় তাদের প্রত্যুৎপন্নমতি, সহজে সঠিক সিদ্ধান্তে তারা পৌঁছতে পারে।

ইবনে খালদুন বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক উপাদানের জাতিগোষ্ঠীর দোষ গুণ কিংবা বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে চেয়েছেন। অন্যান্য মুসলিম কবি সাহিত্যিক ও তাত্ত্বিকগণ‌ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনার দিকটি মাথায় রেখেই আলোচনা করেছেন। বর্ণবৈষম্য তাদের উদ্দেশ্য নয় কোনমতেই।

কিন্তু হ্যাঁ.. আধুনিক যুগে পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী বৈষম্য ও জুলুমের প্রতিক্রিয়ায় পাশ্চাত্যের কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানদের মাঝে একটা বর্ণবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়েছে, যার মূলনীতিগুলো ইসলাম সমর্থন করে না কোন মতেই। সেটা একটা আফ্রিকান আমেরিকান পলিটিকাল মুভমেন্ট। নাম ন্যাশন অফ ইসলাম (NOI)। ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর দিকে সম্বন্ধ করে তারা নিজেদেরকে ‘বেলালিয়ান’ নামেও অভিহিত করে থাকে। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি পাশ্চাত্যের বিদ্বেষের প্রতিক্রিয়ায় যেহেতু তাদের জন্ম, তাই তাদের শুধুমাত্র কর্মধারা নয়, বরং আক্বীদা, বিশ্বাস ও আইডিওলজিতে শ্বেতাঙ্গদের প্রতি বিদ্বেষ বৈশিষ্ট্যগতভাবে বিদ্যমান

তাদের কয়েকটি বিশ্বাস হলো—

১. ইসলাম শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গদের হাত থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের রক্ষা করতে এসেছে এই পৃথিবীতে।
২. কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের থেকে শ্রেষ্ঠ।
৩. ফেরেশতাগণ কৃষ্ণবর্ণের। কিন্তু শয়তান শ্বেত বর্ণের।

এছাড়াও তাদের আরো অনৈসলামিক ধ্যান-ধারণা রয়েছে। মালিক শাবাজ ম্যালকম এক্স, ওয়ারিথ দীন মোহাম্মদসহ সহ আরো অনেকেই সঠিকভাবে ইসলামকে বোঝার পর, এই আন্দোলনের সংস্কার করার চেষ্টা করেন। প্রয়াস চালান বিদ্বেষ থেকে সদস্যদের বের করে বিপ্লবী চেতনা দেয়ার।

বর্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে রচিত কিছু গ্রন্থ

এ বিষয়ে প্রাচীন মুসলিম ঐতিহ্যে বেশ কিছু স্বতন্ত্র আলোচনার দেখা মেলে। জাহিয রচনা করেছেন ‘ফাখরুস সুদান আলাল বিদান’ (শ্বেতাঙ্গদের উপর কৃষ্ণাঙ্গদের গর্ব)। আন্নাশি রচনা করেছেন ‘তাফদিলুস সুদ আলাল বিদ’ (শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব)। ইবনে মারযুবান রচনা করেছেন ‘আসসুদান ওয়া ফাদলুহুম আলাল বিদান’।

অনেকে আছেন, এটা নিয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেন নি, কিন্তু অন্য গ্রন্থের অধীনে এ বিষয়ে স্বতন্ত্র অধ্যায় রচনা করেছেন। যেমন, শায়ালিবী ‘তাহসিনুল কাবিহ ওয়া তাকবিহুল হাসান’ (মন্দের ইতিবাচকতা ও উত্তমের নেতিবাচকতা)। ইবনে কুতাইবার ‘উয়ুনুল আখবার’ গ্রন্থেও এ নিয়ে আলোচনা আছে।

তবে তাদের সকলের চেয়ে ভিন্ন একটি গ্রন্থ রয়েছে জালালুদ্দিন সুয়ুতির। নাম ‘নুযহাতুল উমর ফীত তাফদিলি বাইনাল বীদি ওয়াস সুদি ওয়াস সামর’। এই গ্রন্থে তিনি কালো, সাদা আর তামাটে, সব রঙের মানুষদের সম্পর্কেই আলোচনা এনেছেন। এ বিষয়ে অনেকের লেখায় যা পাওয়া যাওয়া দুষ্কর। কেউ কেউ শুধু শ্বেতাঙ্গের প্রশংসা করেছেন। কেউবা আবার শুধু কৃষ্ণাঙ্গের। কিন্তু জালালুদ্দিন সুয়ুতী সবার দিকই তুলে ধরেছেন ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনার আলোকে।

বর্ণ ও সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ

আরবি সাহিত্যে বর্ণ সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে অনেক বর্ণনা বিদ্যমান। এখানে কিছু তুলে ধরছি।

আয়েশা রা. বলেছেন, ‘শ্বেত রঙ সৌন্দর্যের অর্ধেক’। (মুছান্নাফে ইবনে শাইবা)

খালেদ বিন সাফওয়ান বলেছেন, ‘সৌন্দর্যের খুঁটি হল দীর্ঘতা। সৌন্দর্যের চাদর হল শ্বেত রঙ। আর এর মুকুট হল কালো চুল।’ (ইবনে আসাকির)

সূরা বাকারার ১৩৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমরা আল্লাহর রঙ গ্রহণ করেছি। আল্লাহর রঙের চাইতে উত্তম রং আর কার হতে পারে?’ এর ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, অর্থাৎ সফেদ রং। (আদ্দুররুল মানছুর- ১/ ৩৪১)

এখন তুলে ধরছি প্রাচীন মুসলিম আরব কবিদের কিছু কবিতার উদ্বৃতি। যেখানে তারা শ্বেত রং নিয়ে বোঝাপড়ায় লিপ্ত হয়েছেন।

আবুল ফজল যুহাইর বিন মুহাম্মদ বিন আলী, বাহাউদ্দিন। তিনি একজন বিখ্যাত কবি। তার একটি কবিতাসমগ্র রয়েছে। নাম দিওয়ানুল বাহাই যুহাইর। সেই কবিতাসমগ্রের ১৬১ পৃষ্ঠায় আছে—

‘তামাটে রঙের প্রেমিক হে, শোনো
প্রেমের ক্ষেত্রে তোমার পদাঙ্ক আমার অনুসরণীয় নয়।
শ্বেত রঙের রমণীদের ভালোবাসা
আমার মনে মোহরাঙ্কিত হয়ে গিয়েছে,
প্রত্যেক সত্যই শুভ্র সফেদ
সত্যই সকলের অনুসরণীয়’

তত্ত্বজ্ঞানী বুজুর্গ শেখ শরফুদ্দিন আবুল বারাকাত বিন আল-মুস্তাওফা। তিনি ভাষাবিজ্ঞানী, ব্যাকরণবিদ, মুহাদ্দিস ও একজন ঐতিহাসিক। তার একটা কবিতায় শ্বেত রঙের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন—

‘তোমাকে যেন চকচকে তামাটে রং
ধোকাগ্রস্থ করে না ফেলে কখনই
সুন্দর শুধুই সাদা ও সফেদ বস্তুগুলো।
বর্শা হাতলের সাহায্যে
কেবল খানিক জখম করতে পারে
আর তরবারি নিজের ধার দিয়েই
হত্যা খতম করে ফেলে।’

ইমাম জাইনুদ্দিন বিন আল ওয়ারদি। শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গের তুলনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন—

‘কৃষ্ণাঙ্গ কখনোই শ্বেতাঙ্গের মতো সুন্দর নয়
কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ের সাথে সম্পর্ক করা একটা দোষ
তাদের থেকে দূরে সরে যাও
আর বিয়ের পর যে কৃষ্ণাঙ্গ সন্তান হবে—
সেটার কথা মাথায় রাখো
ফিরে যাও সত্য ও আপন প্রকৃতির দিকে
সূর্যের মাঝে তুমি যা খুঁজে পাবে
শুকতারার মাঝে কখনোই সেটা পাবে না’

গাজী আবুল ফাতাহ মাহমুদ বিন ইসমাইল দিময়াতী হিজরী ষষ্ঠ শতকের প্রথম ভাগের কবি। তিনি বলেছেন—

‘রঙ হিসেবে কৃষ্ণ রঙকে পছন্দ করো না।
কারণ, কৃষ্ণাঙ্গদের গাল কখনোই লাল হয় না
আর সতেজতা থাকেনা তাদের দাড়ি মোছ চুলে’

বুরহান উদ্দিন ইব্রাহিম বিন শারফুদ্দিন বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ আল কিরাতি। হিজরী সপ্তম শতকের কবি তিনি। আপন যুগের আলেমদের পিছনে পড়ে ছিলেন। উৎকর্ষ অর্জন করেছিলেন শিল্প, কবিতা ও ছন্দ রচনায়। তিনি বলেছেন—

‘কেউ যদি শ্বেতাঙ্গ মেয়েকে ভালবেসে
তার পেছনে স্বর্ণ-রৌপ্য‌ও খরচ করে
তাহলে তাকে তার মত থাকতে দাও।
আর যদি কেউ কৃষ্ণাঙ্গ নারীর প্রেমে পড়ে,
পারলে তাকে হাজারখানেক থাপ্পর মারো

যে কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ বলে,
সে তো মূর্খ। তার কথার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই
শ্বেত শুভ্রতার বৈশিষ্ট্য কিভাবে
মানুষের চোখে অস্পষ্ট থাকে?
—অথচ সত্যের রং সাদা’

শামসুদ্দিন মোহাম্মদ বিন হাসান বিন আলী বিন ওসমান আন্নাওয়াজি। সপ্তম শতকের দ্বিতীয় ভাগের কবি তিনি। তিনি একজন আলেম সাহিত্যিক। তার রয়েছে বেশ কিছু নান্দনিক অনবদ্য গ্রন্থ। তিনি বলেছেন—

‘যে অনবদ্য সুন্দর শ্বেতাঙ্গের সাথে তুলনা করে কৃষ্ণাঙ্গের
তার চোখে ছানি পড়ে গিয়েছে
চোখ থেকেই বা তার এই দুনিয়ায় কি উপকার
যদি অন্ধকার আর আলোর পার্থক্য না বুঝতে পারে’

কৃষ্ণাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে উক্তি

মধ্যযুগের আরব সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে শ্বেতাঙ্গের গুনাগুন ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনার চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গের বর্ণনাই বেশি। এদিকটা নিয়েই বেশি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এমনকি জালাল উদ্দিন সুয়ূতীর বইও এই প্রবণতা থেকে মুক্ত নয়।

হয়তো এর কারণ, আরবের বেদুইনরা নিজেদের কালো রং নিয়ে গর্বিত হয়ে থাকে। যেমনটা বলেছেন বিখ্যাত সাহিত্যিক জাহিয। জাহিয তার গ্রন্থ শুরু করেছেন কৃষ্ণাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা দিয়ে। মুসলিম ঐতিহ্যের কৃষ্ণাঙ্গ প্রতীক হিসেবে তিনি নাম নিয়ে এসেছেন, সাঈদ বিন জুবায়ের, বিলাল হাবশি, বদরের প্রথম শহীদ মাহাজ, মিকদাদ বিন আস‌ওয়াদ, ওয়াহসি, কবি হাইকতান, জুলাইবিব, ফারাজ আলহাজ্জাম প্রমুখের নাম।

জাহিয এরপর কৃষ্ণাঙ্গদের গৌরবে কিছু কবিতা তুলে এনেছেন। এছাড়া তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের সৌন্দর্য প্রকাশ করার চেষ্টা করেননি। বরং কৃষ্ণাঙ্গদের সাহসিকতা ও শক্তির দিকটা তিনি তুলে ধরেছেন। বিপরীত দিকে জালাল উদ্দিন সুয়ূতী এমন কবিতা এনেছেন, যেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের সৌন্দর্য প্রকাশ করা হয়েছে।

জাহিয নিগ্রোদের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন—‘নিগ্রোরা হলো উত্তম স্বভাবের। মানুষকে তারা খুব কম‌ই কষ্ট দেয়। তারা সর্বদা হাসিখুশি থাকে। মানুষের সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখে। আর এটাই তো সম্ভ্রান্ততা ও মর্যাদা।’

মানুষ ছাড়া অন্য কিছু বস্তুর মাঝে কৃষ্ণাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। যেমন, গাছ, মাটি, কয়লা, খেজুর ইত্যাদি। এগুলো কৃষ্ণাঙ্গ হলেই সুন্দর। ধূসর কিংবা সাদা হলে মৃত মৃত দেখা যায়। মানুষের চোখের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় গাঢ় কালো ভ্রু থাকলে। মানুষের চেহারায় শক্তির সৌন্দর্য বর্ধনকারী জিনিস হচ্ছে গাঢ় কাল জুলফি। সবচেয়ে ভালো সুরমা হল ইসমিদ সুরমা। আর সেটা কালো। এজন্যই আল্লাহ সকল মুমিনকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যৌবন অবস্থায় উপনীত করে। তার চোখে থাকবে সুরমা।

জাহিয তার গ্রন্থে কৃষ্ণাঙ্গদের বিভক্ত করেছেন বিভিন্ন শ্রেণীতে। যেমন, আবিসিনিয়ান, নিগ্রো, হিন্দুস্তানি, কিবতি প্রভৃতি। এরপর তাদের আলাদা আলাদা কীর্তি ও শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা তুলে ধরেছেন।

জালাল উদ্দিন সুয়ূতী আপন গ্রন্থে কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যাপারে কিছু কবিতা তুলে ধরেছেন। সেখান থেকে কয়েকটি উল্লেখ করছি।

উজির আবুল কাশেম আল মাগরিবী বলেছেন—

‘কত কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েকে আমি ভালোবেসেছি
তাদেরকে ভালোবাসাই উচিত
রাতের মত‌ই তারা ঢেকে দেয়
আমার আগন্ধ পাপ
আমার লঙ্ঘনের সুখ-সিক্ততা’

আবু তাম্মাম বিন রাবাহ বলেছেন—

‘বুদ্ধিমানদের বুদ্ধি কেড়ে নেয়া
সুন্দরী হে রমণী!
এমন কোন রত্ন লুকিয়ে আছে
তোমার সৌন্দর্যের রহস্যে
সৃজিত হয়ে ছিলে তুমি
কর্পূরের মত শুভ্র সাদা
তারপর কৃষ্ণ রূপ ধারণ করলে।
অন্য সকল সাদা মেয়েরা
যদি হয় সুন্দর কান্তি
তাহলে তুমি সেই দেহের
চক্ষু কোটরের ভ্রু’

আবু জাহাম লিখেছেন—

‘তোমার উপমা যেন
আবনুস বৃক্ষের কৃষ্ণ কালো ডাল থেকে
ঝরে পড়া মেশকে আম্বরের টসটসে ফল
তুমি এক সুখময় রাত
রাতের মতো কালো
তোমার পর আমি চাইনা
আর কোন দিবসের আলো’

আলবদর বিন আস-সাহেব বলেছেন—

আমি জড়িয়ে পড়েছি এক কৃষ্ণাঙ্গিনীর সাথে
সেতো বুনো গাভী আর হরিণের
চক্ষু কোটরের মত কালো সুন্দরী
তার প্রতি আমার তীব্র ভালোবাসা
দেখে অবাক হবার কিছু নেই
কারণ
রাতের অন্ধকার‌ই
একজন সাহিত্যিকের দিবস যাপন’

তামাটে বর্ণ প্রসঙ্গে

কালো আর সাদা নিয়ে দ্বন্দ্ব যে পরিমাণে পাওয়া যায়, সে পরিমাণে তামাটে বা শ্যমল বর্ণ নিয়ে পাওয়া যায় না। তবু কিছু কবিতা তুলে ধরছি।

আল বাহা যুহাইর শ্যামল বর্ণের নারীদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন—

‘তুমি তিরস্কার করোনা লাবণ্যময়ী শ্যামলিমাদের
এই দুনিয়ায় তারাই আমার ভাগ্য
সফেদদের থেকে আমি বহুদূরে পালাই
বার্ধক্যের রঙ আমি পছন্দ করি না’

জাইনুদ্দিন মোহাম্মদ বিন হুসাইন আনসারী আল মাকদিসি বলেছেন—

‘তামাটে নারীরাই সবচেয়ে সুন্দর
চোখের শীতলতা
তাদের রয়েছে মিষ্টি চেহারা
বৃক্ষের ডালের মত’

আলাউদ্দিন আহমদ বিন আব্দুল ওয়াহাব বলেছেন—

‘তামাটে রঙের মাঝে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে
যা সাদা রংয়ের মধ্যে নেই
মধুর মত মিষ্টতা স্বাদ আর লাবণ্য
নেই চকচকে সাদা দুধে
বুদ্ধিমানদের বোঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট’

আলী বিন জাহাম আস সামী আল খুরাসানি একজন আব্বাসী যুগের কবি। তিনি বলেছেন—

‘মূর্খতাপ্রসূত যারা নিন্দা করে তামাটে রঙের
আর সাদা রঙকে মনে করে শ্রেষ্ঠ
তাদের উদ্দেশ্যে বলি
কর্পূর কখনোই মেশকে আম্বরের মত
হতে পারে না’

এসব বিষয়ে বিতর্ক, মুসলিম চিন্তার বৈচিত্র প্রমাণ করে। মুসলমানরা অনেক কিছু নিয়েই ভাবতেন তাদের স্বর্ণ যুগে। সাহিত্যে ছিল উন্মুক্ততা। একজন মুফতি কবিতার ক্ষেত্রে ততটাই স্বাধীন ছিলেন, যতটা স্বাধীন ছিলেন একজন পেশাজীবি কবি। তাদের মাধ্যমেই মুসলিম সভ্যতা বহুমাত্রিক রূপ লাভ করেছে।

The post কালো-সাদা-তামাটে: মুসলিম কল্পনায় বর্ণ ও সৌন্দর্য appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/2D6RcFT

No comments:

Post a Comment