রাকিবুল হাসান:
দেখতে দেখতে কেটে গেলো তিনমাস। বয়স বেড়ে যাচ্ছে গৃহবন্দী এই সময়ের। কোলাহলহীন বিষণ্ন এসব দিন বাতাসে তুলছে করুণ এক সুর, বেঁচে থাকার সুতীব্র এক মিনতি। ভাইরাসের দাপটে পুরো বিশ্ব এখন ভয়াবহ সঙ্কটে প্রায় স্থবির হয়ে আছে। চীরচেনা স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে কঠিন এক জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত হচ্ছে মানুষ। নতুন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে দিনরাত কুরআন হাদীসের পাঠে মুখর থাকা কওমি মাদরাসাগুলোও।
গতবছর এই সময়ে ছাত্রদের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ছিল দেশের সবকটি কওমি মাদরাসা। শুরু হয়ে গিয়েছিল তাফসির ক্লাস, হাদীসের দরস। কিন্তু এবার ভর্তি সম্পন্ন হলেও এখনও শুরু হতে পারেনি নিয়মিত কার্যক্রম। ছাত্রদের মতোই এক অস্বস্তিকর সময় পার করছেন কওমি মাদরাসার শিক্ষকগণও। ক্লাসে ফিরতে না পেরে তারাও হাঁসফাঁস করছেন। হতাশার কথা তুলে ধরছেন।
বন্দী এই সময়ে হতাশার ছাপ ফুটে উঠলো জামিয়া আারাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা মুফতি যুবায়ের আহমাদের কণ্ঠে। অকপটেই তিনি বললেন, ‘আমরা যারা কওমি মাদরাসার শিক্ষক, তাদের প্রধান ব্যস্ততাই হলো ছাত্রদের পড়ানো। ছাত্রদের নিয়ে ইলমি মুজাকারা এবং আলোচনা করা। কিন্তু করোনা সঙ্কটের কারণে আমরা এখন ক্লাসে ফিরতে পারছি না। গত মার্চে মাদরাসাগুলো ছুটি হয়। কেন্দ্রীয় পরীক্ষাটাও নিতে পারিনি। ফলে সঙ্কট আরও ঘন হচ্ছে। মনে তো দুঃখ আছেই।’
অনলাইনে ক্লাস শুরু হলে সঙ্কট কাটবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনলাইনে ক্লাস শুরু করাটাই এখন অসম্ভব। কারণ, কওমি মাদরাসার নয় জামাতের মধ্যে চার জামাতেরই কেন্দ্রীয় পরীক্ষা হয়নি। নতুন বছরের ক্লাস শুরু হলে তারা কেন্দ্রীয় পরীক্ষার পড়া পড়বে, নাকি নতুন জামাতের ক্লাস করবে? হিজিবিজি একটা অবস্থা। লকডাউনের শুরুতেই যদি অনুমোদন নিয়ে পরীক্ষা নিয়ে নেয়া হতো, তাহলে সবচে ভালো হতো। এখন ছাত্ররা ক্লাস করতে পারছে না, দ্বীনি ইলম চর্চা করতে পারছে না। সবচে হতাশার বিষয় হলো—দীর্ঘদিন মাদরাসা ছুটি থাকার কারণে নৈতিকভাবে ছাত্ররা পিছিয়ে পড়ছে। আগস্টেও পরিস্থিতি ঠিক হবে কিনা, নিশ্চিত নয়। তখনও পরিস্থিতি ঠিক না হলে, আরও বিরাট ক্ষতি হবে আমাদের।’
তবে এই সময়ে হতাশ না হয়ে দ্বীনি ইলম শেখার বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন দারুল উলুম মাদানীনগর মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা ফয়সাল আহমাদ জালালাবাদী। ক্লাসে ফিরতে না পেরে তারও খারাপ লাগছে, দুঃখ লাগছে। কিন্তু দুঃখকে বিলাসিতায় পরিণত না করে জয় করার তরিকা বলেছেন তিনি। ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরকে তিনি বলেন, ‘এমন দুর্যোগ সঙ্কট আসবেই। অতীতেও এসেছে। হতাশ না হয়ে আমাদের বিকল্প পন্থা বের করতে হবে। কবে মাদরাসা খুলবে, তারও ঠিক নেই। নতুন বছরে পড়ালেখায় যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পুষিয়ে নেবার জন্য কয়েকটি কাজ করতে বলবো ছাত্রদের। এক—ছাত্ররা নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করবে এবং নামাজগুলো আদায় করবে। দুই—নতুন শিক্ষাবর্ষের কিতাবগুলোর প্রাথমিক পড়াশুনা বাড়িতেই শুরু করবে। কোথাও হালকা বুঝতে সমস্যা হলে উসতাদকে ফোন দিয়ে বিষয়টা বুঝে নিতে পারে। শাইখুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া রহ. এভাবেই পড়াশুনা করেছেন। নিজে পড়তেন আগে, তারপর উসতাদের গিয়ে পড়া শুনাতেন। কোথাও ভুল হলে উসতাদ শুধরে দিতেন। তিন—অতীতের দুর্যোগপূর্ণ সময়ে আকাবীরগণ কী কী কাজ করেছেন, কিভাবে সময় কাজে লাগিয়েছেন, তা পড়ে দেখতে হবে। সবসময় একই নিয়মে চলা যায় না। কখনো কখনো বিকল্প নিয়মেরও দরকার হয়।’
দীর্ঘ সময় মাদরাসা বন্ধ থাকার কারণে ছাত্ররাও উদাসীন হয়ে পড়ছে পড়ালেখায়। এ নিয়ে শিক্ষকদের দুঃখবোধ সবচে বেশি। কিভাবে ছাত্রদের সময়টাকে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়েও বিকল্প চিন্তা করছেন অনেকেই। নিজস্ব কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে কেউ কেউ অনলাইনে নির্দিষ্ট করে একটি কিতাবের ক্লাস শুরু করছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম দারুল উলুম রহমানিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা হাসান জামিল। তিনি অনলাইনে শুরু করেছেন তাফসিরে জালালাইন কিতাবের দরস। জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালাম মাদরাসার শিক্ষক মুফতি ইসমাইল বিন ইসহাক শুরু করছেন হেদায়ার ক্লাস। জামিয়া শরইয়্যাহ মালিবাগ মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি আবদুস সালাম শুরু করছেন উসূলুল হাদীসের দরস। জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসার শিক্ষক মুফতি যোবায়ের মহিউদ্দিন শুরু করছেন শামায়েলে তিরমিজির ক্লাস।
ছাত্রদের কাছে ফিরতে অনলাইন ক্লাস বিকল্প মাধ্যম হতে পারে কিনা জানতে চাইলাম। মাওলানা ফয়সাল আহমাদ বললেন, ‘অনলাইন ক্লাস একটা বিকল্প মাধ্যম হতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু মাদরাসাভিত্তিক লাইভ না করে উন্মুক্ত লাইভ ক্লাস করা যেতে পারে। তাহলে মাদরাসার বাইরেরও অনেকে যুক্ত হতে পারবে। শুধু ছাত্ররাই এই লাইভ শুনবে না, বরং অনেক জেনারেল শিক্ষিত মানুষও শুনবে। তাদের জন্যও ক্লাসে কিছু কথা বলতে হবে। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে—যারা অনলাইনে ক্লাস করাবেন, তাদের ভাষাটা যেন শুদ্ধ থাকে।’
কওমি মাদরাসার সব শিক্ষকগণই তাদের প্রিয় ছাত্রদের কাছে ফিরতে চান। কিন্তু যত দীর্ঘ হচ্ছে ছুটি, তত তীব্র হচ্ছে তাদের তাড়না। ফলে অনেকেই শুরু করে দিচ্ছেন অনলাইন ক্লাস। অনেক শিক্ষক বলছেন, অনলাইন ক্লাস হতে পারে ছাত্রদের কাছে ফেরার বিকল্প এক মাধ্যম। তবে তারা এটাও বলছেন, মুরুব্বিরা ব্যাপকভাবে অনুমতি না দিলে অনলাইন ক্লাস কতটুকু ব্যাপক হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
The post অপেক্ষা বাড়ছে মাদরাসায় : ‘আমি ছাত্রদের কাছে ফিরতে চাই’ appeared first on Fateh24.
from Fateh24 https://ift.tt/3dagKhr
No comments:
Post a Comment