Friday, June 26, 2020

যে কারণে বাংলাদেশের কারাগার ব্যবস্থার সংস্কার জরুরী

রাকিবুল হাসান:

নিরাপদ রেখে আলোর পথ দেখানোর প্রতিশ্রুতি দেয় কারাগারগুলো। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিলেও বন্দীদের কতটুকু আলোর পথ দেখাতে পারছে বাংলাদেশের কারাগারগুলো, এই নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। বন্দীদের অভিযোগ নিম্নমানের খাবার, অপরিচ্ছন্ন বাথরুম, ধর্মীয় শিক্ষা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও বিনোদনের অভাব, নতুনদের ওপর পুরাতনদের এবং হাজতি কয়েদিদের সাথে কারারক্ষীদের দুর্ব্যবহার মিলিয়ে অমানবিক এক জগৎ প্রতিটি কারাগারে। বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, এই জগতে প্রবেশের পর শুদ্ধ হবার বদলে মানুষ হয়ে উঠে উগ্র। কারণ কারাগারের পরিবেশ তাকে সংশোধনের পর্যাপ্ত সুযোগ দেয় না। তাই কারাগারগুলোর সংস্কার অতীব জরুরী।

লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ কারাগার সংস্কার প্রসঙ্গে ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের কারাগারগুলো চলছে ১৮৬৪ সালের ব্রিটিশ কোড এবং উপনিবেশিক চিন্তা-ধারায়। ব্রিটিশরা তো কারাগার তৈরি করেছে মানুষকে শাস্তি দেবার জন্য, সংশোধন করার জন্য নয়। স্বাধীনতার পর স্বাধীন বাংলার উপযোগী করে কারাগার সংস্কার করা হয়নি। আশির দশকে কারাগার সংস্কারের কথা উঠেছিল। কিন্তু তারপর আবার সব থমকে গেছে। এখন আর কেউ সংস্কার নিয়ে কথা বলে না। যেমন ছিল, তেমনই আছে। তাই সংশোধনের চিন্তার চেয়ে শাস্তি দেবার মানসিকতা এখানে বেশি। ফলত দেখা যায় দিনদিন কারাগারের নিয়ম কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।’

অপরাধ বিজ্ঞান বলে—কারাগারগুলোর চারটি প্রধান উদ্দেশ্য। উচিত শাস্তি, কারাবরোধ, অপরাধ করায় নিরুৎসাহিতকরণ এবং পুনর্বাসন । উচিত শাস্তির অর্থ কেউ সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ করলে তাকে উচিত শাস্তি দিতে হবে। কারাবরোধের অর্থ হচ্ছে, সমাজ থেকে অপরাধীদের বিদূরিত করা; যাতে করে এরা আর নিরপরাধ সাধারণ কোনো মানুষের ক্ষতি করতে না পারে। নিরুৎসাহিতকরণের অর্থ হচ্ছে- এরা যাতে ভবিষ্যতে অপরাধ না করে তা নিরুৎসাহিত করা। সবশেষ উদ্দেশ্য পুনর্বাসনের অর্থ হচ্ছে, কারাগার কর্তৃপক্ষ সুপরিকল্পিত এমন কিছু কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে, যার মাধ্যমে অপরাধীদের করে তোলা যায় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিক।

কারাগারের উদ্দেশ্যগুলো পূরণ হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘কারাগারের উদ্দেশ্যগুলো পূরণ করার জন্য পুরো কারাগার ব্যবস্থাকেই সংস্কার করতে হবে। সংস্কার না করলে উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। ব্রিটিশ কোড দিয়ে আমরা স্বাধীন দেশের কারাগার চালাচ্ছি। অথচ ব্রিটিশরাও কিন্তু তাদের কারাগার ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। ভারতেও কারাগার ব্যবস্থাপনা সংস্কার হয়েছে। আমাদের রাজনীতিবিদগণ সবাই একবার হলেও কারাগারে গিয়েছেন। কারাগারের অসঙ্গতি তাদের চোখেও ধরা পড়েছে। কিন্তু কারাগার থেকে বের হয়ে, ক্ষমতায় গিয়ে তারাও কেন জানি এ বিষয়টি আর খেয়াল করেন না।’

কারাগারের কোন কোন বিষয়গুলো সবচে বেশি সংস্কার জরুরি জানতে চাইলাম। বিদগ্ধ এই গবেষক বললেন, ‘সবকিছুরই সংস্কার জরুরী। স্পেসিফিকভাবে বললে বন্দীরা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাচ্ছে না, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা পাচ্ছে না। তার ওপর কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ, তিনগুণ বন্দীদের গাদাগাদি করে রাখা হয়। স্বজনদের সঙ্গে বন্দীরা খুব সহজেই দেখা করতে পারে না। এতে তার মানসিক হতাশা তৈরী হয়। এককথায় বন্দীরা তাদের মানবিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত। মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কাউকে তো আর মানবিক করে তোলা যায় না।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে এখন মোট কারাগার আছে ৬৮টি। এর মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার আর ৫৫টি জেলা কারাগার। বর্তমানে কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার ৬৬৪ জন। এর বিপরীতে বন্দি আছেন ৯০ হাজারের বেশি, যা ধারণক্ষমতার দিগুণ। যদিও গত কিছুদিনে করোনা উপলক্ষে এদের অনেকে মুক্তি পেয়েছেন।

গত ৩০ জানুয়ারি দেশের সুপরিচিত একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে ৯০ হাজার কারাবন্দীর মানবেতর জীবনযাপনের দৃশ্য তুলে আনা হয়। তাতে বলা হয়, ‘বন্দী আধিক্যের কারণে অমানবিক এক পরিবেশ বিরাজ করছে দেশের প্রতিটি কারাগারে। এক ব্যক্তির ঘুমানোর জায়গায় ঘুমাচ্ছে দুই থেকে তিনজন। কাঁথা নেই, কম্বল নেই, মশারি নেই। শৌচাগারে দীর্ঘ লাইন। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়েও অমানবিক দুর্ভোগ। মামলায় হাজিরা দিতে গেলে দিনভর থাকতে হয় না খেয়ে। অসুস্থ হলেও চিকিৎসা পেতে পোহাতে হয় ঝক্কি। হাসপাতালে নিতে গেলে প্রহর গুনতে হয়। অ্যাম্বুলেন্স সঙ্কট। নিম্নমানের খাবার, অপরিচ্ছন্ন বাথরুম, চিকিৎসা ও বিনোদনের অভাব, নতুনদের ওপর পুরনোদের এবং হাজতি কয়েদিদের সাথে কারারক্ষীদের দুর্ব্যবহার মিলিয়ে অমানবিক এক জগৎ প্রতিটি কারাগারে।’

কারাগারে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা

একজন অপরাধীকে সবচে বেশী পরিশীলিত এবং পরিমার্জিত করতে পারে ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষা। বাংলাদেশের কারাগারগুলোয় এর নিতান্তই অভাব বলে দাবি করেছেন ইসলামী ঐক্যজোটের সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি সাখাওয়াত রাজি। কারাগারে মসজিদ আছে কিনা, থাকলেও নামাজ পড়ার সুযোগ কতটুকু? এমন প্রশ্নের জবাবে ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরকে তিনি বললেন, ‘কারাগারগুলোতে মসজিদ নেই। তবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মাঝে মসজিদের মতোন একটা জায়গা করে দেয়া আছে। দিন বড় হলে সেখানে যোহর এবং আসর নামাজ পড়া হয়। দিন ছোট হলে আসর পড়ার সুযোগ পাওয়া যায় না ওখানে। কারণ, সন্ধ্যা হলে সবাইকে যার যার লকাপে ঢুকিয়ে দেয়া হয়।’

কারাগারের ভেতর শিক্ষামূলক কর্মসূচি, কর্মদক্ষতা শেখানোর মতো কার্যক্রম আছে। কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষার কোনো কার্যক্রম আছে কিনা জানতে চাইলাম। মুফতি সাখাওয়াত রাজি বললেন, কারাগারে অক্ষরজ্ঞান এবং কর্মদক্ষতা শেখানো হয়। টেকনোলজির জ্ঞান শেখানোরও কিছু কর্মসূচি আছে। কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষার জন্য কোনো কর্মসূচি নেই। খাতা কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই। তবে কোনো কোনো কারাকর্তৃপক্ষ ধর্মীয় মানসিকতার হলে এই ব্যবস্থাটা করে থাকেন। আলেম, হাফেজ বন্দীদের বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ করে দেন আরবি শেখানোর জন্য। এছাড়া ধর্মীয় শিক্ষার কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। অথচ একজন অপরাধীকে পরিমার্জিত করতে ধর্মীয় শিক্ষার বিকল্প নেই। বলা হয় ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’, কিন্তু আলোর পথ দেখানোর কার্যক্রমই নেই কারাগারে। তাই জেল থেকে বের হয়ে চোর হয় ডাকাত, ডাকাত হয় গডফাদার।’

নিজের কারাগারে কাটানো সময়ের স্মৃতিচারণ করে মুফতি সাখাওয়াত রাজি বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে প্রায় দুশো আলেম-শিক্ষক-ছাত্র বন্দী ছিলাম কারাগারে। একদিন সাধারণ ওয়ার্ডের সামনে গিয়ে ঘোষণা দিলাম, যারা কুরআন শিখতে চান, আরবি শিখতে চান, ব্যক্তিগতভাবে এসে আমাদের নিকট শিখতে পারেন। সময় নষ্ট করে লাভ নেই। এই সময়টা কাজে লাগিয়ে কুরআন শিখতে পারেন। তারপর প্রতিদিন যখন আমাদের লকাপ খুলে দেয়া হতো, ওখানে বারান্দার মতো একটা জায়গায় বসে কুরআন শেখাতাম। একসঙ্গে যোহর-আসর আদায় করতাম। সন্ধ্যায় লকাপে ঢুকার পর রুমেই মাগরিব আদায় করতাম। অন্য বন্দীদের নিয়ে ধর্মীয় আলোচনা, যিকির-আযকার করতাম। তারাও আমাদের নিকট বিভিন্ন মাসআলা জানতে চাইতো। যতদিন ছিলাম, আমরা চেষ্টা করেছি বন্দীদেরকে ধর্মীয় শিক্ষাটা দিতে।’

ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য বন্দীরা কতটুকু আগ্রহী থাকে? মুফতি সাখাওয়াত রাজি বলেন, ‘তারা বেশ আগ্রহী থাকে। প্রথমত, তাদের হাতে অখণ্ড অবসর। দ্বিতীয়ত, কারাগারে তাদের মন এমনিতেই নরম থাকে। এই সময় যদি তাদেরকে ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষাটা দেয়া হয়, তাহলে বন্দীরা আলোর দেখাটা খুব সক্রিয়ভাবে পেতো। মানুষকে অপরাধ থেকে ফিরিয়ে আনতে ধর্মীয় শিক্ষা তো অপরিহার্য। সারাদিন বন্দীরা বাইরে ঘুরে বেড়ায়। যদি কারাগারে মসজিদ থাকতো, তাহলে অনেকেই মসজিদে বসে ইবাদাত করতো, যিকির-আযকার করতো।’

সংস্কার আসবে কিভাবে?

কারাগারের এতসব অসঙ্গতি দেখে স্বভাবতই একটি প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়—কর্তা ব্যক্তিরা তো এসব দেখছেন, তবুও কেন সংস্কার করছেন না? প্রতিটি রাজনীতিবিদ কারাগারে কখনো না কখনো গিয়েছেন। তারা কেন এ বিষয়ে নির্লিপ্ত? এই প্রশ্নের একটাই সমাধান দিলেন লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ। তিনি বললেন, ‘আসলে জনগণকে সজাগ হতে হবে। জনগণ যদি চায় কারা ব্যবস্থার সংস্কার জরুরী, তাহলে তাদের জোর দাবি জানাতে হবে রাজনীতিবিদদের কাছে। জনগণ যেহেতু দাবি জানায় না, রাজনীতিবিদগণও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেন না। অথচ স্বাধীন দেশের উপযোগী করে কারা ব্যবস্থার সংস্কার শুধু জরুরীই না, বরং অতীব জরুরী। বিভিন্ন দেশের কারাগারের মডেল দেখতে সরকারি কর্মকর্তাগণ সফরে যান। কিন্তু মডেল দেখে এসে সে অনুযায়ী সংস্কার আর করেন না। তাহলে লোক দেখানো সফর করে তো লাভ নেই। সংস্কারের ইচ্ছে থাকলেই সংস্কার করা যাবে। কারাগার সংস্কার বিষয়ক সব আইডিয়া বইতেই লেখা আছে। এজন্য সফর করতে হয় না।’

এসব সংস্কারের মধ্যে ধর্মীয় দিকটির প্রতিই বেশি গুরুত্ব দিলেন মুফতি সাখাওয়াত রাজি। তার মতে, ধর্মীয়, শিক্ষার জন্য কারাগারে ধর্মীয় শিক্ষক, ইমাম নিয়োগ দেয়া দরকার। ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া কারাগারের উদ্দেশ্যগুলো পূরণ করা সম্ভব না।

The post যে কারণে বাংলাদেশের কারাগার ব্যবস্থার সংস্কার জরুরী appeared first on Fateh24.



from Fateh24 https://ift.tt/2ZaZX9g

No comments:

Post a Comment