লোকমান হাকিম:
বাবা, মাথার উপর বটবৃক্ষের মতো মহীরুহ। কিংবা তপ্ত রোদে এক টুকরো মেঘ। মাথার উপর বিশাল আকাশ। প্রকৃত বন্ধু। কারো কাছে স্বর্গ। কারো কাছে বা পুরো পৃথিবী।
আমরা বাবাকে কতকিছুর সাথেই না তুলনা করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কারো সাথে বাবার কোন তুলনা হয় না। বাবার তুলনা বাবা নিজেই। বাবা তো সংজ্ঞা ও তুলনাহীন এক শব্দ। বাবাকে ভালোবাসার জন্য কোন দিবস বা রজনীর প্রয়োজন নেই। আমার জন্য প্রতিটা দিনই বাবা দিবস।
আমরা সমুদ্রের বিশালতা দেখে বিমূর্ত হই। আকাশের বিশালতা দেখে থ হয়ে যাই। কিন্তু কখনো কি ভেবেছি, বাবার বিশালতা কেমন? মানুষটার বিশালতা এ যেন এক অজানা রহস্য। তাঁর বিশালতা মাপার যন্ত্র এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। আদৌ কি আবিষ্কৃত হবে কখনো? হয়তো কখনোও না।
বাবার হাত ধরে প্রথম হাঁটতে শেখা, প্রথম স্কুলে যাওয়া, চা খেতে শেখা, সাঁতার কাটতে শেখা। বাবার কাছ থেকেই আমার প্রথম অক্ষরজ্ঞান, আলিফ, বা, তা, সা, স্বর অ, স্বর আ। বাবার কাছ থেকে শিখেছি অনুপ্রেরণার গল্প, সাহসের গল্প, জীবনে বড় হওয়ার গল্প, জীবন যুদ্ধে দৃঢ়পদে টিকে থাকার গল্প। বাবা তো শুধু বাবা নই। বাবা যেন আমার এক অনুকরণীয় আদর্শ।
আমরা বদলে যাই। দিনদিন আমাদের চাহিদা বদলাই। কখনো আমাদের বিবেক বুদ্ধি লোপ পাই। আবেগ তাড়িত হয়ে মা বাবার সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল দেখাই।
কিন্তু বাবারা বদলায় না। তাঁরা আবেগ তাড়িত হয় না। জেনে বুঝে তারা তাঁর আদরের সন্তানদের কখনো বিপদে ঠেলে দিতে চান না, বা পারেন না।
সেই ছোট্টবেলায় যে বাবাকে দেখে আসছি আজো ঠিক তেমন বাবাই আমার চোখের সামনে প্রতিদিন স্বর্গের মতো ভেসে ওঠে। সময়ে অসময়ে সেই ঝাঁঝালো রাগ, কঠিন চেহারা, শক্ত চোয়াল, গাম্ভীর্য বাবাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। আবার কখনো শিশুর মতো নরম তুলতুলে স্বভাব, প্রকৃত বন্ধুর মতো কাছে টেনে নিতে পারার সক্ষমতা আজো আমার কাছে সব আশ্চর্য লাগে।
বাইরে তিনি যতটাই কঠিন, ভেতরে ততোটাই কোমল। যা কিছুই করি না কেনো, যত কষ্টই দিই বাবাকে, শুধু একবার বাবা বলে ডাকলেই তাঁর সব কষ্ট মাটি হয়ে যায়। শত ভুলেও বাবা আমাকে কাছে টেনে নেন। আমার ভুলের জন্য নীরবে কাঁদেন। সব বাধাবিপত্তি আর ঝড় থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করেন। শত ভুল করেও বাবার উপর নির্ভর করে পার পেয়ে যাই। আজকাল তো ভুলকে ভুলই মনে হই না, কারণ বাবা আছেন। অশেষ নিরাপত্তার চাদর দিয়ে তিনি সব সামলে নিবেন।
প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ করার পর দুবছর ধরে দ্বীনি খেদমতে আছি। কিন্তু আজো বাবা মোবাইলে টাকা রিচার্জ করে দেন। হাত খরচের টাকা দেন। শ্বশুরবাড়ি গেলে কি নিয়ে যাব না যাব সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলে দেন। বাড়ি থেকে কোথাও যাওয়ার উদ্যেশ্যে বের হলে রাস্তার নিরাপত্তার উদ্যেশ্যে নানা কথা বলেন। আর দোয়া দেন,, “ভালো থাকিস বাবা।”
যখন মিজান জামাতে পড়ি তখন বাবা গাছ থেকে পড়ে কোমরে মারত্মক আঘাত পান। বছর তিনেক কিছুই করতে পারেননি। তখন আমাদের ছয় সদস্যের বেশ বড় সংসার। সবার বড় আমি। তাই বাবার অসুস্থতার কারণে সবাই বলেছিল, “তোমার বড্ডা ছেরারে কাজে দেলাও। নাইলে এত্ত বড় পরিবার নিয়ে কেম্নে চলবা!”
কিন্তু বাবা সব সময় আমাদের মঙ্গলের কথা ভেবেছেন, এখনো ভাবেন। বাবা বলেছিলেন, “আমার জান গ্যালেগাও আমি ওর লেহাপড়া বাদ দিব না। আমি ওরে পড়াইমু। আমার জীবন শেষ না হওয়া পর্যন্ত পড়াইমু”
সেদিন বাবার কথা শুনে কী যে ভালো লেগেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আমার বাবা শুধু ভালো বাবা নন। বরং ভালোর মধ্যেও আরো অনেক ভালো বাবা। আমার জীবনের আয়োজনে-প্রয়োজনে বাবার অবদান অনস্বীকার্য। আজো যখন মনটা ভীষণ খারাপ হই, জীবনের ঘেরাটোপ যখন চারদিক থেকে নিঃস্ব, অসহায় হয়ে পড়ে। বাস্তবতার সামনে জীবন যখন বারবার হোচট খায়, তখন বাবাকে ফোন দিই, “বাবা আমার এ এ অবস্থা।” বাবা সব সমস্যার সহজ সমাধান দিয়ে দেন।
সদা চঞ্চল এ মানুষটা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখনই বাঁধ ভাঙে সকল সুখের। চারদিক থেকে অন্ধকারেরা অন্ধ সাপের মতো কিলবিল করতে করতে তেড়ে আসে। হিংস্র কুকুরেরা অযথা ঘেউঘেউ করতে শুরু করে। শোকের ছায়া নেমে আসে আমাদের পরিবারে। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। নীড়হাড়া পাখির মতো ছটফট করতে থাকি। বাবাহীনা জীবনটা কল্পনা করতেও বড় কষ্ট হয়। বাবার সামান্য অসুখেই সবাই ভেঙে পড়ি। আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। চলতে-ফিরতে বারবার হোচট খাই।
পরিবার নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও ধারাবাহিক অসুস্থতা বাবাকে এ বয়সেই বুড়ো বানিয়ে দিয়েছে। আজকাল বাবার চোখেমুখে সবসময় দেখতে পাই বিষাদের ছাপ। সে ছাপ অদ্ভুত এক অসহায় ভঙ্গিতে বড় করুণভাবে ঝুলে থাকে তাঁর চেহারায়। মাঝে মাঝে তিনি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তন্ময় হয়ে কি যেন ভাবেন। বাবার সে ভাবনার কূল খুঁজে পাই না আমরা। কি এমন ভাবতে পারেন বাবা! যে ভাবনাতে তাঁর চোখের ভাষা, মুখের ভাষা সব ভাষায়ই পরিবর্তন হয়ে যায়।
আমার জীবনে বাবা নামক এ বটবৃক্ষ সবসময় অক্সিজেনের মতো কাজ করতে থাকে। জীবনের সামগ্রিক প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে নিশ্চিন্তে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সাহায্য করে। বাবা আছেন, তাই শত ভুলভ্রান্তির মাঝেও পথ হারাই না, কিংবা ভেঙে পড়ি না। তিনি পথ দেখান। সাহস যোগান। দুঃখ-কষ্টে, সুখ-আনন্দে সবসময় পাশে থাকেন। কঠিন বাস্তবতাও কখনো একা ছেড়ে যান না। একজন সত্যিকারের বাবার মতোই সবসময় পাশে থেকে সকল সমস্যার নিরসন করেন।
আমাদের বাস্তবজীবনের সম্পর্কগুলো যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা সবসময় সম্পর্কের টানাপোড়নে ভুগি। বন্ধুরা শত্রুতে পরিণত হয়। আবার কখনো শক্ররা বন্ধুতে। সম্পর্কের জেরে রূপ নেয় কত শত শত বিবাদ। সামান্য ভুলেই ভেঙে পড়ে বছরের পর বছর ধরে টিকে থাকা সস্পর্কের টান। কিন্তু বাবা! এ যেন চিরশ্বাশত এক সম্পর্ক। ভাষাভেদে বাবা ডাকটি বদলালেও বদলায় না রক্তের টান। এ সম্পর্কের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। এ সম্পর্ক তো টিকে থাকবে ইহকাল ও পরকাল দুজগতেই।
গত পাঁচ, সাত বছর ধরে বাবা থেকে দূরে আছি। দূরে আছি বলতে ছুটি ও বন্ধকালীন সময়ে তো ঠিকই বাড়ি যাওয়া হয়। তবু বাবার জন্য খুব মন পুড়ে। যখন শুনি, বাবার খুব অসুখ। তখন বুকের ভেতরটা ধক্ করে কেঁপে ওঠে। বুকে তড়পড়ানি শুরু হয়। অচেতন রোগীর সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলার মতো একরকম অবস্থা হয়। বুকের ভেতর ভাঙাগড়ার শব্দ টের পাই। দৃষ্টিতে বন্দি পাখির মতো এক ধরনের কাতরতা লেগে থাকে সবসময়। যখন শুনি বাবা ভালো আছেন, সুস্থ আছেন তখনি এক অনাবিল আনন্দ লাভ করি। তৃপ্তির ডেকুর তুলে সকল বিষণ্ণতা থেকে নিজেকে মুক্ত মনে করি।
সেই যে বইপত্র, নকশীকাঁথা, বাক্স আরো নানা প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি নিয়ে লেখাপড়ার জন্য নিজ ভিটেমাটি ছেড়েছিলাম, এরপর আর কখনো স্থায়ীভাবে নিজ গ্রামে ফেরা হয়নি। কবে যাব তাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। করোনাকালীন ছুটিতে দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাবাকে আরো কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বয়সের ভার, অসুস্থতা আর দুশ্চিন্তা তাকে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সেই নুইয়ে দিয়েছে। তবু সমাজ সংসারের কত শত দায়ভার অবলীলায় বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। দেহে কোন ক্লান্তি নেই। কোন বিশ্রাম নেই। কখনো থেমে নেই। ছুটছেন তো ছুটছেনই। গ্রামের এধার থেকে ওধারে। ওধার থেকে এধারে। শহরে, বন্দরে। এক শহর থেকে অন্য শহরে। করোনাকালীন সময়ে সবকিছু থেমে গেলেও এ মানুষটার যেন কোন বিরাম নেই। তার উপর যে সাত-আট সদস্যের বিরাট বোঝা। সবকিছুই সহজভাবে সামলে নিয়ে প্রায় পঁচিশ বছর ধরে খুব সাধারণভাবেই তিনি চলছেন, ফিরছেন। সেই সাধারণতাই বাবাকে দিনদিন পরিণত করছে অসাধারণে।
আজকাল বাবার কষ্ট দেখলে বড্ড মায়া হয়। মন চায়, বাবাকে টাকার পাহাড় এনে দিই! কিন্তু মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষকতার দৈন্যতা প্রচণ্ড রকম টের পাচ্ছি। তবু সুদিনের আশায় একমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভর করে এ দ্বীনি খেদমতে টিকে আছি। আল্লাহই তো একমাত্র রিজিকদাতা এবং তিনিই উত্তম ফায়সালাকারী।
অনেকদিন ধরে বাবা থেকে দূরে আছি। কিন্তু দূরে থাকলেও মনে হয় বাবা সবসময় আমার পাশেই আছেন। এইতো আমার বুকের মধ্যিখানে। প্রতি সকাল, দুপুর বাবার কলের রিংটোন বেজে ওঠে আমার ফোনে। প্রতি রাতে বাবার দরাজ কন্ঠের ডাক আমার কানে রিনরিন করে বাজে।
“কেমন আছিস বাবা? ভালো আছিস তো? তোর দিনকাল কেমন চলছে রে? টাকা পয়সা লাগব নি? তোর শরীরটা ভালো রে? ”
এ এত বড় পৃথিবীতে এত এত সম্পর্কের মাঝে শুধু বাবা নামক এ মহান মানুষটাই এতটা আগ বাড়িয়ে এতকিছু জিজ্ঞাস করতে যান। আর সবাই ‘কেমন আছিস’ ‘কি করিস’ এতটুকু বলেই ক্ষান্ত হয়। এরচে বেশি কেউ-ই জিজ্ঞেস করে না, করতেও চায় না। শুধু শুধু আগ বাড়িয়ে অযথা নিজের বিপদ ডেকে এনে লাভ কী!
পৃথিবীর সবকিছুই তো ধরাছোঁয়ার বাইরে। উপরের আকাশটাও তো অনেক দূর। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরে বেড়াবার সাধ্যিও আমার নাই। কিন্তু বাবা নামক বিশাল আকাশটা, বিশাল পৃথিবীটা আমার পাশেই। আমার মাথার উপর। আমার ধরাছোঁয়ার ভেতর। এটাই বা কম কিসে। বাবাই তো আমার আকাশ, আমার পুরো পৃথিবী।
মাইলের পর মাইলের দূরত্ব ডিঙিয়ে প্রতিদিন হয়তো বাবার মায়াবী মুখ দেখার তৌফিক আমার হয় না। কিন্তু বাবার দেওয়া অনুপ্রেরণা, সৎ সাহস, বুদ্ধি, পরামর্শ নিয়ে দিনগুলো তো আর মন্দ কাটছে না। যত দূরেই থাকি না কেন, যেখানেই থাকি বাবা তোমাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। ভালো থাকুন বাবা। ভালো থাকুক পৃথিবীর সব বাবারা।
The post পৃথিবীর সব বাবারা ভালো থাকুক appeared first on Fateh24.
from Fateh24 https://ift.tt/2U4eWmA
No comments:
Post a Comment