সাবের চৌধুরী
মাত্র অল্পকয়েকদিনের নোটিশে নভেল করোনা ভাইরাসের মত ক্ষুদ্র একটা জিনিস পুরো পৃথিবীকে হঠাৎ করে বিহ্বল ও বিবশ করে ফেলেছে। যেন পৃথিবীজুড়ে নেমে এসেছে অপার্থিব এক ভীতিকর বিষণ্ন সন্ধ্যা, যা ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে রেকর্ডেড আক্রান্তের সংখ্যা এ পর্যন্ত ৫৩২৯২৬ এবং মৃতের সংখ্যা ২৪০৯৩. সংখ্যাগুলো প্রতিদিনই বাড়ছে চক্রবৃদ্ধি হারে, হু হু করে।
অফিসিয়াল রেকর্ডের বাইরে এই সংখ্যাটি আরো বেশি হবে এতে সন্দেহ নেই। কবে থামবে এই মৃত্যুর মিছিল কেউ জানে না। মানুষ মৃত্যুর ভয়ে ভীত এবং তাদের দৃষ্টির রং পরিবর্তন হয়ে গেছে। করোনা আঘাত করেছে মনুষের জীবনের উপর এবং জীবন ধারণের সকল আয়োজনের উপর। করোনা পূর্ববর্তী ও করোনা পরবর্তী পৃথিবী একরকম হবে না এটা বোঝাই যাচ্ছে। অন্য সকল সেক্টরের মত করোনা ধর্মীয় মহলেও নানা বিতর্ককে সামনে নিয়ে এসেছে।
এর মধ্যে মৌলিকভাবে দুইটি বিষয় রয়েছে ;
এক. ইসলাম সংক্রমণ বা ছোঁয়াচে রোগকে স্বীকার করে কি না?
দুই. করোনার আক্রমণকে ভয় করে এর প্রতিরোধের জন্য বিশেষ রকমের সতর্কতা অবলম্বন করে চলা তকদীর-বিশ্বাসের খেলাফ কি না?
এ দুটোর বাইরে প্রাসঙ্গিক ও শাখাগত তিনটি বিষয় আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো—
১. মসজিদে জামাতের নামাজ ও জুমআ বন্ধ করা যাবে কি না?
২. গণজমায়েত বন্ধ করার বিপরীতে ঈমানি জজবা থেকে দোয়া মাহফিল করা ঠিক না বেঠিক?
৩. করোনা অমুসলিম জালেম রাষ্ট্রগুলোর জন্য এসেছে; মুসলমানদের এতে কিছু হবে না এমন কথাও বলছেন কেউ কেউ।
ইসলাম কি সংক্রমণকে স্বীকার করে?
মৌলিকভাবে এটি আসলে স্বীকার করা না করার বিষয় না। অভিজ্ঞতা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যদি দেখা যায় কোন জীবানু ছড়ায়, তাহলে তা ছড়ায়; এবং কোন জীবানুর ব্যাপারে যদি দেখা যায় তা ছড়ায় না, তাহলে তা ছড়ায় না। কোন রোগ ছড়ায় কি না, এরকম চিকিৎসা বিষয়ক সিদ্ধান্ত দেওয়া ইসলামের মূল কাজের অন্তর্ভুক্তও নয়। এটা সম্পূর্ণই বাস্তবতার যাচাই ও নীরিক্ষার বিষয়।
ইসলাম এখানে যে কাজটি করবে, তা হলো বিশ্বাসকে রক্ষা করবে এবং কোন অপবিশ্বাস থাকলে তা দূর করবে। সেই সাথে কর্মের ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক নীতিমালা দিবে, যা আপনাকে মেনে চলতে হবে। তারপরও কুরআন ও হাদীসে নানান রোগের চিকিৎসা বিষয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যা অত্যন্ত বাস্তব ও কার্যকরী। আলোচ্য বিষয়টিতেও আমরা এরকমটি ঘটতে দেখি।
জাহেলি যুগের ভুল কর্মনীতি ও অপবিশ্বাস
সে সময়ের লোকের সংক্রমণের বিষয়ে দুটি ভুল সিদ্ধান্তে উপনীতি হয়েছিল।
এক. সংক্রমণের ব্যাপারে তারা বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল। যে কোন রোগকে তারা সংক্রামক রোগ বলে মনে করতো, এর কারণে অনেক জুলুম তৈরী হতো। এভাবে তারা নিজেদেরকে একটা সংকীর্ণতার ভেতরে নিয়ে গিয়েছিল।
দুই. তারা মনে করতো সংক্রমণের নিজস্ব শক্তি আছে এবং সে নিজের শক্তি বলেই ছড়ায়। এমনিভাবে এসবের ক্ষেত্রে গ্রহ-নক্ষত্রের নিজস্ব প্রভাব রয়েছে। এটা একটা কুফুরি বিশ্বাস। মুসলমান হিসেবে আমাদের কুরআন-সুন্নাহ সম্মত বিশ্বাস হলো—একটা ধুলোকণাও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয় না আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও নির্দেশ ছাড়া। তাহলে কার্যকারণ সূত্রের ভূমিকা কী, এটা একটা মৌলিক জায়গা, যেখানে কেউ কেউ ভুলের শিকার হন।
কিন্তু বিষয়টি আসলে জটিল কিছু নয়। সত্য এই যে, সকল কিছুর উৎস একমাত্র আল্লাহ তাআলা। ভালো মন্দ সকল ঘটনার কর্মবিধায়কও তিনি। কিন্তু জগত পরিচালনায় তাঁর সাধারণ কিছু নিয়ম আছে। একে বলা হয় সুন্নাতুল্লাহ বা ইউনিভার্সাল ল’। তিনি নানা জিনিসের মধ্যে নানা গুণাগুণ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এগুলো তাঁর নির্দেশমতই একটা নিয়ম মেনে কাজ করে যায়। আমরা যেহেতু এগুলোকে ব্যবহার করি, তাই আমাদেরকে এই গুণাগুণ ও নিয়মগুলো বের করে জিনিসটির ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার নিয়মটি কী, তা আবিস্কার করে তার সে নিয়ম মেনে চলতে হয়।
এ কারণেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধ করেছেন, জীবন যাপনের নানাবিধ কোশল গ্রহণ করেছেন, ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্য গ্রহণ করেছেন এবং সুস্থতার জন্য চিকিৎসা নিয়েছেন। এই যে সকল কিছুর উৎস আল্লাহ তাআলা বলে বিশ্বাস করা এবং উপকরণের ব্যাপারে তার ইউনিভার্সাল ল’ মেনে চলা এ দুইয়ের মধ্যে কোন সংঘর্ষ নেই। একটার কারণে আরেকটাকে ছাড়তে হচ্ছে না।
এ কারণেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিকে জাহেলি যুগের লোকদের বাড়াবাড়ি ও অপবিশ্বাসকে দূর করার জন্য একদিকে বলছেন, সংক্রমণ বলতে কিছু নেই। সাহাবি যখন উটের উদাহরণ এনে বললেন, আমরা তো দেখি একটা অসুস্থ উট থেকে অন্য সুস্থ উটগুলো অসুস্থ হয়, তখন তিনি একে রদ করে বলছেন, বলো তো প্রথম উটটির মধ্যে এই রোগটি এলো কোত্থেকে? এমনিভাবে একজন কুষ্ঠরোগীকে ডেকে এনে নিজের সাথে এক প্লেটে আহারসঙ্গী করেছেন। এটা হলো তাদের অপ ও কুফুরি বিশ্বাসকে রদ করা ও কর্মের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িকে পরিহার করার জন্য নির্দেশনা।
আবার ইউনিভার্সাল ল’ অনুযায়ী নির্দেশ দিয়েছেন কুষ্ঠ রোগী থেকে পালিয়ে থাকো, যেমন করে পালিয়ে থাকো সিংহ থেকে। বলছেন, কোন এলাকায় মহামারী দেখা দিলে সে এলাকায় যেন বাহিরের কেউ প্রবেশ না করে, এবং ভিতরের লোক যেন বাহিরে না যায়। অর্থাৎ লক ডাউন। এবং আমরা দেখি একজন কুষ্ঠ রোগী যখন বাইয়াত গ্রহণ করার জন্য মদীনায় এলেন, তখন তিনি হাতে বাইয়াত গ্রহণ না করে বললেন, আমি তোমার বাইয়াত নিয়ে নিয়েছি, তুমি ফিরে যাও। এটিও বলছেন, অসুস্থ উটগুলোকে যেন সুস্থ উটদের সাথে মিশ্রিত না করা হয়।
এখন, জীবানুর সংস্পর্শে এলে আমার শরীরেও তা ছড়িয়ে পড়াটি কি নিশ্চিত? হয়তো নিশ্চিত, হয়তো নিশ্চিত নয়। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞানও তা নিশ্চিত করে বলতে পারে না। কারণ, সে নিজে নিজে ছড়ায় না। আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা ও নির্দেশের অধীন। ফলে, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা না হলে ছড়াবে না। কিন্তু আমরা তো জানি না কখন আমার এই সংমিশ্রণকে আল্লাহ তাআলা সংক্রমণের কারণ বানাবেন, এবং কখন বানাবেন না। ফলে, আমাদের দায়িত্ব হলো সতর্ক থাকা।
এখানে আরেকটি বিষয় পরিস্কার করা সঙ্গত মনে হচ্ছে—
কোন কোন মানুষ আল্লাহ তাআলার উপর তাওয়াক্কুল (ভরসা ও নির্ভরতা) ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে এতো নিকটবর্তি ও উচ্চমার্গে পৌঁছে যান, ফলে, আসবাব বা উপকরণ গ্রহণ করাটাকে তিনি তার ঈমানের পূর্ণতার জন্য দোষণীয় মনে করতে থাকেন। সেই অবস্থান থেকে তারা সব রকমের চিকিৎসাকে বর্জন করে আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করেন। এঁরা হলেন অত্যন্ত বিশেষ পারসন। অনেক সময় দেখা যায় ই্উনিভার্সাল ল’ তাদের উপর কাজ করে না। এটা হলো আল্লাহ তাআলার বিশেষ কেয়ার।
এখানে যে পরিভাষাটি কাজ করে একে আরবিতে বলা হয় কুদরাতুল্লাহ। মানে, আল্লাহ তাআলা বিশেষ রকমের শক্তি প্রদর্শন করেন। নবীগণের মধ্যে আল্লাহ তআলা এই শক্তিকে বেশি প্রয়োগ করেছেন। অনেক ওলীর ক্ষেত্রেও কারামাত হিসেবে তা প্রকাশিত হয়ে থাকে। সেই অবস্থান থেকে কেউ যদি চিকিৎসা গ্রহণ না করেন, তাহলে তিনি সম্মানিত। এর পুরস্কারও তিনি পাবেন। হাদীসে এসেছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন উম্মতের বিশাল একদল মানুষের ব্যাপারে ব্যাপারে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন, যারা কুলক্ষণ তালাশ করতো না, রুকইয়া করত না এবং কাই এর চিকিৎসা করত না। বরং আল্লাহ তাআলার উপর তাওয়াক্কুল করত। (অথচ, কাই এর চিকিৎসা ইসলামে গ্রহণযোগ্য ও সমর্থিত একটা চিকিৎসা।) তখন উক্কাশা নামে এক সাহাবি এই দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কামনা প্রকাশ করলে নবীজি তাঁর জন্য দোয়া করলেন। এরপর আরেক সাহাবি দাঁড়ালে তিনি বললেন, উক্কাশা তোমার আগে চলে গেছে।
কিন্তু এখানে কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে—
এই অবস্থানটি মানুষ আত্মিক পুতঃপবিত্রতা, আমল ও দোয়ার মাধ্যমে লাভ করে। যে কেউ হুট করে ঘোষণা দিয়ে সে অবস্থানে যেতে পারে না। এই অবস্থানটি গ্রহণ করার নয়; সাধনার মাধ্যমে অর্জন করার। কেউ সে পর্যায়ে গেলে তাকে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘোষণা করতে হবে না। তার স্বাভাবিক জীবনধারাতেই তা আপসে গড়ে উঠবে। এবং এটি শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে নয়, সকল রোগের ব্যাপারেই তা পরিলক্ষিত হবে।
আমি সাধারণ রোগ-শোকের চিকিৎসা নেই, পার্থিব সকল উপায় ও উপকরণ গ্রহণ করে চলি, কিন্তু করোনার ব্যাপারে গিয়ে হঠাৎ করে তাওয়াক্কুলের ঘোষণা দিয়ে বসলাম, এটা হটকারিতা এবং নিজেকে স্বেচ্ছায় বিপদে নিপতিত করা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন ঈমানদারের জন্যে সমীচীন নয় নিজেকে লাঞ্ছিত করা। সাহাবাগণ প্রশ্ন করলেন, তা কীভাবে? তিনি বললেন? নিজেকে এমন দুর্যোগের মুখোমুখি করা, যা সামলানোর ক্ষমতা তার নেই।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে—আপনার তাওয়াক্কুল আপনার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। নিজের তাকওয়া ও তাওয়াক্কুল আরেকজনের উপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। সুতরাং, আমি যদি করোনাকে কেয়ার না করতে চাই, না করতে পারি। কিন্তু সাধারণ আচরণবিধি আমাকে মেনে চলতে হবে। আর না হয়, আমি অন্যের মধ্যে এটিকে ছড়িয়ে দেওয়ার বাহকে পরিণত হবো। আমার তাকওয়ার কারণে আমার কিছু না-ও হতে পারে, কিন্তু আমার পাশের জনের তো সে উচ্চামার্গীয় তাওয়াক্কুল নেই, তার কী হবে?
তৃতীয়ত, আমার অবস্থানটি একটি বিশেষ অবস্থান। সাধারণ ও সকলের জন্য আবশ্যকীয়ভাবে পালনীয় কিছু নয়। সুতরাং এই অবস্থানটিকেই ইসলামের একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে প্রচার করতে থাকা ভুল সিদ্ধান্ত। ব্যাপকভাবে মানুষের জন্য অনুসরণীয় হলো সাধারণ ইউনিভার্সাল ল’। ইসলামকে সে অনুযায়ীই উপস্থাপন করতে হবে। সে বিশেষ অবস্থানের সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করা সত্তেও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণভাবে আমাদেরকে সুন্নাতুল্লাহ অনুযায়ী চলার নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এক হাদীসে আছে, এক সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি উটটি বেঁধে রেখে তাওয়াক্কুল করব, নাকি ছেড়ে রেখে তাওয়াক্কুল করব? তিনি বললেন, আগে বেঁধে রাখো, এরপর তাওয়াক্কুল করো।
অবশ্য, করোনা ইস্যূতে ধর্মীয় মহলে এই বিতর্কের পরিসর খুব সীমিতভাবে দেখা গেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে উলামায়ে কেরাম সংক্রমণের ব্যাপারে ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিটিই তুলে ধরেছেন এবং সে আলোকে নির্দেশনা দিয়েছেন। খুব সীমিত কিছু মানুষের মধ্যে এর ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছে। ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপনের এই সমস্যা শুধু করোনা ইস্যুতে নয়; নানা সময়েই এটা দেখা যায় এবং খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সতর্কতা অবলম্বন করা তকদীর-বিশ্বাসের খেলাফ কি না?
পিছনের আলোচনাতে এ বিষয়টি অনেকটা পরিস্কার হয়ে গেছে। তারপরও সংক্ষেপে তাকদীরের ব্যাপারটি বলা যাক। তাকদীর মানে কী? একজন মুসলিম হিসেবে আমাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, ছোট-বড় সকল বিষয় ও ঘটনা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত। যা হয়েছে, তা হওয়ার ছিল; যা হয়নি, তা হওয়ার ছিল না। যা নির্ধারিত আছে, তা হবে, এবং যা নির্ধারিত নয় তা কখনোই হবে না। কিন্তু আমি জানি না আমার জন্য কী নির্ধারিত আছে, ফলে আমাকে সাধারণ কার্যকারণ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে এবং সবচেয়ে উত্তমটার জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। এবং সুন্নাতুল্লাহ অনুযায়ী এর একটা ফল সাধারণত আমি পেয়ে থাকবো।
এখানে একটা গুঢ় প্রশ্ন জাগবে, এর কোন উত্তর মানুষের জানা নেই। আরবিতে একে বলা হয়—সিররুম মিন আসরারিল্লাহ। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলার একান্ত গোপনীয় বিষয়। ফলে, সেটা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া নিষিদ্ধ। এবং সে বিতর্ক অনর্থকও বটে। ফলে, তকদীর বিশ্বাসের সাথে উপায় অবলম্বনের কোন বিরোধ নেই। তকদীর হলো বিশ্বাসের ব্যাপার এবং উপায় অবলম্বন হলো তদবীর বা বিশ্বাসের ভেতর দিয়ে কর্মের বিষয়। তকদীর ও তদবীর পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়; বরং উভয় মিলেই পূর্ণতার প্রকাশ।
এই তকদীরের প্রশ্নে করোনা ভাইরাসের অবস্থানটি যেমন অন্যান্য রোগের অবস্থানটিও তেমন। আমি যদি অন্য সকল রোগের চিকিৎসা নেই তাহলে করোনার চিকিৎসা নিতে আপত্তি থাকবে কেন? এখন প্রতিটি রোগের চিকিৎসা হলো সে রোগ অনুযায়ী। সুতরাং, করোনার চিকিৎসা যদি হয় সতর্কতা অবলম্বন, তবে সেটাই আমাকে নিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, একটা হলো যৌক্তিক স্বাভাবিক সতর্কতা, আরেকটা হলো ‘অতি সতর্কতা’। পথে চললে একসিডেন্ট হতে পারে, এ জন্য দেখেশুনে ধীরে ড্রাইভ করা হলো স্বাভাবিক সতর্কতা; কিন্তু পথে বের না হয়ে ভয়ে ঘরে বসে থাকা হলো ‘অতি সতর্কতা’। অতি সতর্কতা অবশ্যই তাওয়াক্কুলের খেলাফ এবং তকদীর বিশ্বাস নড়বড়ে হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু স্বাভাবিক সতর্কতা অবশ্যই কাম্য। রোগ বাড়ার আশংকা থাকলে অজু করা মাফ হয়ে তার পরিবর্তে তায়াম্মুমের বিধান দেওয়া হয়েছে এ কারণেই। করোনার ক্ষেত্রে যেহেতু চাক্ষুষ দেখা যাচ্ছে এটি অসতর্ক মেলামেশার কারণে ছড়িয়ে পড়ছে, সে ক্ষেত্রে একে তাওয়াক্কুল ও তকদীরের খেলাফ বলে মনে করা ও প্রচার করা স্পষ্টতই ইসলামের অপব্যাখ্যা। অল্প কিছু মানুষ সঠিক ভাষ্যটি না জেনেই এসব ছড়াচ্ছেন।
মসজিদে জামাত বন্ধ করা যাবে কি না?
মৌলিকভাবে এটি নিয়ে কথা বলবেন বিজ্ঞ আলেম ও মুফতিগণ। বলেছেনও বটে। আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে কয়েকটি দিক সামনে আনতে পারি। আমরা দেখি ইসলামে অক্ষম অবস্থাকে মোকাবেলা করার জন্য মৌলিক কিছু নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালার আলোকে পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত প্রস্তুত হবে। অন্যতম একটি মূলনীতি হলো, কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তিনি বান্দাকে তার সাধ্যের বাইরে কিছু করতে নির্দেশ দেন না। ফলে, যেখানেই সাধ্যের প্রশ্ন আসবে, সেখানেই সুযোগ ও ছাড় তৈরী হবে। সুতরাং, যদি এমন পরিস্থিতি আসে যে, মসজিদগুলোতে জামাত চললে মহামারীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, তাহলে অবশ্যই মসজিদে জামাত বন্ধ করে দিতে শরীয়ত আমাদেরকে নির্দেশ দিবে।
এতে কারো কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু এখানে মূল পয়েন্ট হলো এরকম পরিস্থিতি ঠিক কখন তৈরী হলো এটা বুঝা যাবে কী করে? এখানে দুটো জিনিস লাগবে, এক হলো পরিস্থিতি চেক করার জন্য ধর্মীয় ইনস্টিটিউট এবং দ্বিতীয় বিষয় হলো যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে পর্যাপ্ত অথেনটিক ডাটা সরবরাহ করা। অর্থাৎ, ধর্মীয় ইনস্টিটিউট ও রাষ্ট্র যৌথভাবে এখানে কাজ করতে হবে। দুঃখজনক হলো আমাদের দেশে এ দুয়ের কোনটিই যথাযথভাবে উপস্থিত নেই। ফলে, এখানে যে একটা বিশৃঙ্খলা হবে, তা পূর্ব অনুমিত।
এখানে আপনি নানা পক্ষকে নানা এঙ্গেল থেকে দোষারোপ করতে থাকতে পারেন, এবং আপনার মুখ যদি খারাপ থাকে, তাহলে গালিগালাজও করতে পারেন। কিন্তু আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, এই ইস্যুতে এটা কোন সমাধান না। একটা ধর্মীয় ইনস্টিটিউট গড়ে না উঠার পেছনে এবং অথেনটিক ডাটা সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে আপনারও দায় আছে। ফলে, আমাদের দায়িত্ব হলো এই দূরবস্থাটি কাটিয়ে উঠার জন্য কাজ করে যাওয়া।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন যে সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছে, এটি নিয়ে মন্তব্য করার সাহস আমার নাই। অনেক বড় বড় আলেমগণ একে প্রস্তুত করেছেন। এটি নিশ্চয়ই ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হবে। আমি শুধু একটি কথা সম্মুখে আনতে চাই—আমাদের বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ খুব সুবিধার জিনিস না। প্রচুর অসতর্কতা আছে, বুঝের কমতি আছে, এবং দীনি ক্ষেত্রে নিজের অসম্পূর্ণ বুঝমত আবেগে চালিত হবার প্রবণতা আছে। ফলে, একাডেমিক শর্তটর্ত রক্ষা করে মাসআলা মেনে চলা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
এজন্য পাবলিককে ডিল করার সময় এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই জায়গাটার জন্য ফিকহে একটা কথা আছে—সাদ্দান লিযযারায়ে’। অর্থাৎ, একটি বিষয় মৌলিকভাবে সঠিক হলেও সাধারণ মানুষ একে খুব দ্রুতই বিকৃত করে ফেলবে। এই ভয়ে একটা বিধানকে শর্টকাট করে ফেলা। বাংলাদেশের মানুষ যখন দেখবে মসজিদে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে না, তখন তারা আর বিস্তারিত বিশ্লেষণে যাবে না। এ জন্য আপনি খেয়াল করলে দেখবেন ফাউন্ডেশনের এই ফতোয়া বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে খুব একটা প্রভাব ফেলছে না।
বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের কাছে আমার একটা নিবেদন থাকবে, মসজিদগুলো অবশ্যই খোলা থাকবে। কমিটি বা এলাকার মুরুব্বিগণ একেবারে আশপাশের বাড়িগুলো থেকে দশজন সুস্থ যুবককে ঠিক করে দিবেন। ইমাম মুয়াজ্জিন ও এই দশজন যুবক মিলে জামাত অনুষ্ঠিত হবে। উলামায়ে কেরাম এই সিদ্ধান্ত দিবেন এবং সরকার এই মর্মে আইন জারি করবে। পাকিস্তানে মুফতি তাকি উসমানি সাহেব বলেছেন, সরকার যদি মুসল্লির সংখ্যার উপর নির্দেশনা জারি করে, তাহলে অন্যান্য নামাজিদেরকে মা’যূর বা অক্ষম হিসেবে গণ্য করা হবে।
করোনার ইস্যুতে একটি বিষয় খুব ভালোভাবে পরিস্কার হয়েছে, বাংলাদেশের সরকার, মিডিয়া ও বামপন্থীগণ ইসলামকে যতই ইগনোর করার চেষ্টা করুক, কিন্তু ইসলাম ও উলামায়ে কেরামের নির্দেশনা ছাড়া সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। কারণ, এই দেশে তৃণমূলে ইসলামই একমাত্র শক্তিশালী প্রভাবক । ফলে, ইসলামকে এড়িয়ে এখানে কেউ কিছুই করতে পারবে না। এর বিপরীতে উলামায়ে কেরাম যদি সুসংহতভাবে এই জায়গায়টায় কাজ করতে পারেন, তাহলে এই দেশে অসাধারণ একটি পরিবর্তন সম্ভব। রাষ্ট্র এই জায়গাটা বুঝুক এবং সমস্ত সেক্টরে শরীয়াহ প্রতিনিধি নিশ্চিত করুক – এই কামনা থাকলো।
The post মহামারী নিয়ন্ত্রণ : ধর্মীয় মহলে বিতর্ক appeared first on Fateh24.
from Fateh24 https://ift.tt/3btkeLz