মুনশী নাঈম:
প্রতি বছর বাড়ছে হজে যাওয়ার খরচ। বিমান ভাড়াসহ সব খরচ মিলিয়ে চলতি বছর হজ প্যাকেজ ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৭৫ টাকা বেশি। এর মধ্যে গত বছরের চেয়ে চলতি বছর বিমানের ভাড়াই বেড়েছে ৫৮ হাজার টাকা। গত চার বছরে হজ প্যাকেজের মূল্য বেড়েছে ৩ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। আর ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিমান ভাড়া বেড়েছে ৭৯ হাজার ২৬৩ টাকা। এই ভাড়া গত বছরের চেয়ে বেড়েছে ৫৮ হাজার টাকা।
হাব ও হজ এজেন্সিগুলো বলছে, সরকার চাইলে বিমান ভাড়া আরও কমাতে পারতো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হজের ভাড়া কম। দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে তারা ভর্তুকি দেয়। না হলে অন্তত যা খরচ হয় সেই ভাড়া নির্ধারণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন্স বিমান এককভাবে অতিরিক্ত মুনাফায় ভাড়া প্রস্তাব করে। সারা বছর লোকসান কমায় হজের মৌসুমে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। হজ ফ্লাইট থেকে বিমান ৮০-১৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত মুনাফা করে। বিমানের আয়ের ১৫ শতাংশ হয় হজ ফ্লাইট থেকে।
জানা গেছে, চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে হজ করতে যাবেন ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। তাদের বহন করবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, সৌদি আরবের সৌদি ও ফ্লাইনাস এয়ারলাইন্স। বিমান ৫০ শতাংশ যাত্রী বহন করবে। বিমানের প্রস্তাবিত ভাড়ার ভিত্তিতে ভাড়া নির্ধারণ করে ধর্ম মন্ত্রণালয়। চলতি বছর ভাড়া ৭০ হাজার টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বিমান। এর প্রেক্ষিতে ৫৮ হাজার টাকা বৃদ্ধি করে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
বিমান কর্তৃপক্ষের দাবি
বিমান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাধারণ ফ্লাইটের চাইতে হজ ফ্লাইটে খরচ অনেক বেশি হয়। ফ্লাইট এমনভাবে পরিচালনা করা হয় যেখানে সাধারণত অন্যান্য যাত্রীদের নেয়া হয় না। হজ ফ্লাইটে যাত্রীদের সৌদি নামিয়ে খালি ফিরতে হয়, অন্যদিকে আনতে যাওয়ার সময়ও যেতে হয় খালি। তাদের হিসেবে যেহেতু যাত্রীপ্রতি চারবার বিমান উড্ডয়ন করা হচ্ছে সেহেতু ভাড়া সর্বোচ্চ দ্বিগুণ হয়।
তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতে হজের সাধারণ সময়কার সমানই বিমান ভাড়া নেয় হাজিদের থেকে। বাংলাদেশের তুলনায় দেশটি থেকে হজে বেশি সংখ্যক মানুষ যান। ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানেও ভাড়া নেয়া হয় অন্যান্য সময়ের মতোই।
দ্বিগুণ ভাড়া কেন নেয়া হয় জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাকিল মিরাজ এ প্রশ্নের জবাবে ফাতেহকে বলেন, ‘বিমান বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় ভিন্ন। কারণ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং সৌদি এয়ারলাইন্স হাজিদের জন্য সরাসরি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে। এর মানে হলো ফ্লাইটগুলো কোথাও ট্রানজিট নেয় না। তবে ভারতীয় এবং ইন্দোনেশিয়ার হাজিরা এ সুবিধা পান না। যখন কোনো বিমান ট্রানজিট নেয় তখন সেটি গন্তব্যে পৌঁছাতে চার থেকে ছয় ঘণ্টা বেশি সময় নেয়। এটা হাজিদের ভোগান্তিতে ফেলে। আর বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়ার ব্যক্তিরা অন্যান্য দেশের হাজিদের তুলনায় বেশি বয়স্ক থাকেন। এছাড়া চলতি বছর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি তো আছেই। এ কারণেই মূলত এ বছর এত বেশি ভাড়া রাখতে হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘কমানো যেতে পারতো’
এয়ারলাইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানের খরচ অনেকটা কমানো যেতে পারে। কিভাবে কমানো যেতে পারে তা উল্লেখ করে বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক নাফিস উদ্দিন ইমতিয়াজ বলেন, ফ্লাইটগুলোকে এয়ারপোর্টকে টাকা দিতে হয় সেখানে কতজন যাত্রী রয়েছেন তা এবং ওজনের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু হজ ফ্লাইটের চারবার যাত্রার দুইবারেরই যাত্রী থাকছে না। এছাড়া যাত্রীরা টার্মিনাল ব্যবহার করায়ও যে ফি বিমানবন্দরকে দিতে হয় তাও দিতে হচ্ছে না দুইবার। এছাড়া হজ ফ্লাইটগুলো পরিচালনার জন্য বিমানবন্দরে বিমান তেমন হ্যাংগিং অবস্থায় রাখার দরকার না হওয়ায় এক্ষেত্রেও বেশকিছুটা টাকা বেঁচে যায় এয়ারলাইনগুলোর। এতক্ষেত্র থেকে টাকা বেঁচে যাওয়ায় সৌদি কর্তৃপক্ষকে হজ রয়্যালটি ফি দিতে হলেও স্বাভাবিক হিসেবই বলছে বিমান চাইলে যাত্রীপ্রতি অন্তত ২৫ হাজার টাকা কমাতে পারে বিমান কর্তৃপক্ষ।
ট্র্যাভেল এজেন্সিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্র্যাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া লিখিত আবেদনে বলেছেন, হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া এবার অনেক বেশি ধরা হয়েছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রায় প্রত্যেক হজযাত্রীর ব্যয় হবে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা। পাশাপাশি পশু কোরবানির জন্য ন্যূনতম খরচ হবে ২৮ হাজার ৩৯০ টাকা। গত বছর কোরবানির খরচ ছিল ১৯ হাজার ৬৮৩ টাকা। এ বছর বেড়েছে ৮ হাজার ৭০৭ টাকা। ফলে গত বছরের তুলনায় এবার খরচ বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৫৭২ টাকা। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের জন্য সর্বনিম্ন প্যাকেজমূল্য ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা নির্ধারণ করেছে হাব। এর সঙ্গে কোরবানির খরচ যুক্ত হবে। এ বছর হজযাত্রী বিমানভাড়া ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা, যা গত বছর থেকে ৫৭ হাজার ৭৯৭ টাকা বেশি। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে হজের ব্যয় বেড়েছে ৩ লাখ ৩৮ হাজার ১৫ টাকা। যদিও এ বছর সৌদি সরকার হজের আনুষঙ্গিক ব্যয় কমিয়েছে। বিমানভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারিত করা হলে হজযাত্রীদের আর্থিক ও মানসিক চাপ অনেকটাই হ্রাস পাবে।
এ বিষয়ে আটাবের মহাসচিব আব্দুস সালাম আরেফ ফাতেহকে বলেন, এ বছর হজে খরচ অনেক বেশি ধরা হয়েছে। আগে যেখানে প্রিমিয়াম প্যাকেজের যাত্রীরা ৬-৭ লাখ টাকায় যেতেন, এবার সেখানে সাধারণ প্যাকেজেই খরচ পড়বে ৭ লাখ টাকা। বিশেষ করে বিমানভাড়া অত্যধিক বেশি ধরা হয়েছে। এজন্য হজযাত্রীরা অনেকেই মত পরিবর্তন করেছেন। তারা হজে যেতে পারবেন না বুঝতে পেরে এখন ওমরায় যাচ্ছেন। এ জন্য ওমরাহ যাত্রী এখন অনেক বেড়ে গেছে। হজে বিমানভাড়া সর্বোচ্চ ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা হতে পারত। কিন্তু প্রায় ৩৮ হাজার টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। হজে খরচ এত বেশি ধরায় এবার ৩০ হাজারের বেশি হজযাত্রী পাওয়া যাবে না বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম গণমাধ্যমকে বলেছেন, করোনার আগে যারা হজে যাওয়ার আশায় প্রাক-নিবন্ধন করেছিলেন তাদের বাজেটে টান পড়েছে। তারা যে বাজেটে হজে যাওয়ার টার্গেট করে রেখেছিলেন তার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এবারের হজ প্যাকেজ ও বিমানভাড়া। ২০১৯ সালের তুলনায় এই ২০২৩ সালে হজের মাথাপিছু ব্যয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা। সৌদি আরব হজের খরচ না বাড়ালেও টাকার সঙ্গে ডলার ও রিয়ালের বিনিময় হার বেড়েছে। এর চাপ এসে পড়েছে প্যাকেজে। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি বিমানভাড়া কমানোর ব্যবস্থা নেন, তাহলে সংগতি হীন হজযাত্রীদের জন্য হজ করার পথ সুগম হতে পারে। হজযাত্রীরা অনেক উপকৃত হবেন এবং তার জন্য দোয়া করবেন।
The post বাংলাদেশি হাজিদের বিমানভাড়া এত বেশি কেন? appeared first on Fateh24.
from Fateh24 https://ift.tt/tlK2nFg