মুজাহিদুল ইসলাম :
রোবটের ব্যবহার বিশ্বে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনাযুগে মসজিদের গেটে রোবট মুসল্লিদের তাপমাত্রা পরিমাপ করছে। রাস্তায় মানুষের চলাচল হ্রাসে মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে রোবটিক গাড়ি। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকল্পে চালকবিহীন আকাশযান ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি রোবটের কাছে খোদ মানুষ হেরে যাবে কিনা সেই আশংকাও গবেষকরা প্রকাশ করছেন।
কিছুদিন আগে তো সিরিয়ায় তৎপর পরাশক্তি রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করেছে তুরস্কের রোবটিক প্রযুক্তি ড্রোন। সময়ের আলোচিত রোবটের প্রসঙ্গে ৭৫০ বছর আগের মুসলিম আলেম ও প্রকৌশলী কারাফীর কথাও আনতে হবে।
তাঁর পুরো নাম শিহাবুদ্দিন আল কারাফী। তিনি একাধারে ফকীহ, দার্শনিক, ভাষাতাত্ত্বিক,গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ, পদার্থবিদ ও যন্ত্র প্রকৌশলী ছিলেন। জন্মস্থান নিশ্চিত করা না গেলেও ৬২৬ হিজরীতে তাঁর জন্ম হয়। গণিতে ‘কিতাবুল মানাজির ফির রিয়াদিয়াত’ লিখে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। পদার্থবিদ্যায় ‘আল ইসতিবসার ফী-মা ইদরিকুল আবছার’ রচনা করেন। মৃত্যুর প্রায় আটশত বছর পরেও তাঁর গবেষণাকর্ম ও আবিস্কার মৌলিকত্বের দাবি রাখছে।
মালিকী মাযহাবের তৎকালীন সর্বশেষ ভরসাস্থল ছিলেন কারাফী। তদুপরি জাগতিক বিদ্যার এমন প্রাজ্ঞতা ও পুরোধা ব্যক্তিত্বের কারণ তাঁর বাণীতেই পাওয়া যায়। কারাফী বলেন, ‘গণিত, চিকিৎসা ও প্রকৌশলে অজ্ঞতার কারণে অনেক বিষয়ে ফকীহ ও বিচারকের নিকট সত্য অগোচরে থেকে যায়। তাই যথেষ্ঠ মনোবল থাকলে যথাসম্ভব সবকিছুই অধ্যয়ন করা উচিত।’ ( আয যাখীরা )
মিসরের শাসক কামিল নাসিরুদ্দিনের দরবারের এক নব আবিস্কৃত যন্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে কারাফী বলেন, এটা ছিল কয়েকটি খুটিসমৃদ্ধ তামার কাঠামো। (তৎকালীন শামাদান তথা দ্বিপাধার বলা হতো) কাঠামোর বহি:ভাগে থাকা দরজা প্রতি ঘন্টায় খুলে যেত। এবং একজন ব্যক্তি (পুতুল) বেরিয়ে আসতো।যখন দশ ঘন্টা অর্থাৎ ফজরের সময় হতো, দ্বীপাধারের ঠিক শীর্ষে একটি পুতুল ঊদিত হয়ে বলতো: ‘আল্লাহ সুলতানের ভোরকে সৌভাগ্যময় করুন’। মূলত ভোর হওয়ার জানান দিতেই এই ব্যবস্থা ছিল।(নাফাইসুল উসুল ফি শারহিল মাহসুল)
পরবর্তীতে কারাফী এই নব আবিস্কারে সংযোজন করেন। কিছু সফলতাও তিনি দেখিয়েছেন। কিছু অসামর্থ্যের কথাও স্বীকার করেছেন। কারাফী বলেন, আমি এই দ্বীপাধারে কিছু সংযোজন করেছি; মোমবাতির আলো ঘন্টায় ঘন্টায় পরিবর্তন হতে থাকে। দ্বীপাধারে একটি সিংহ সংযোজন করি। সিংহের চোখের আলো প্রতি ঘন্টায় পরিবর্তন হতো। খুবই কালো থেকে শ্বেতশুভ্র তারপর খুবই লাল হতো। অর্থাৎ প্রতি ঘন্টায় সিংহের চোখের কালার পরিবর্তন হতো। প্রতি ঘন্টায় একজন ব্যক্তি বের হতো আর অন্যজন প্রবেশ করতো। একটি দরজা বন্ধ হতো এবং আরেকটি দরজা খোলা হতো। ফজরের সময় একজন ব্যক্তি দ্বীপাধারের ওপরে উঠতো। মানুষটি কানে হাত রেখে ফজরের আজানের নির্দেশ করতো। (কাতারাতুত দাময়ি ফী-মা ওয়ারাদা ফিশ শাময়ি, ইবনু তুলুন আল হানাফী)
কারাফী আরেকটি উদ্ভাবনের কথা বলেন, ‘আমি এমন একটি প্রাণীর আকৃতি বানিয়েছি। এটা হাটতে জানে। ডানেবামে ফিরতে পারে। হুইসেল দিতে পারে। কিন্তু কথা বলতে পারে না।’ (নাফাইসুল উসুল ফি শারহিল মাহসুল)
হাল যামানার মিসরী আলিম শায়েখ মুহাম্মাদ ইমারাহ প্রতিকৃতির বিষয়ে বলেন, ’সাহাবায়ে কিরাম বিজিত দেশগুলোর উপাস্য নয়, এমন প্রতিকৃতিকে রেখে দিতেন। উমার ইবনুল আস রা. মিসর জয় করেন। কিছু মূর্তি ভেঙ্গে কিছু রেখে দেন। কারণ, ওগুলো উপাস্য ছিল না। এবং মিসরের খ্রিস্টানরা এগুলোর উপাসনা করতো না। এটা মুসলিম সৈন্যবাহিনীর বিশ্বাসের জন্য হুমকি হওয়ার আশংকা ছিল না।’ (আল ইসলাম ওয়াল ফুনুনুল জামিলাহ)
দিমাশকের প্রখ্যাত আলিম শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ কারাফীর ’আল ইহকাম ফী তাময়ীযিল ফাতওয়া আনিল আহকাম’ গ্রন্থের সম্পাদনায় বলেন, ‘ইমাম কারাফীর ব্যপারে এই প্রশ্ন তোলা যায় না যে, তিনি কিভাবে মূর্তি বানালেন, অথচ ইসলামে এটা হারাম। আর তিনি তো এটা ভালোভাবেই জানেন। আসলে তাঁর নির্মিত কাঠামো কিছু যন্ত্রের সুবিন্যস্ত বিন্যাস, যা খুবই সুক্ষভাবে কাজ সম্পন্ন করে। তা ছাড়া কারাফী একজন খোদাভীরু আলিম ও ফকীহ। তিনি অকাট্য হারামের পথে এগুতে পারেন না।‘ ( পৃষ্ঠা ২৬)
একজন উদ্ভাবক এবং প্রকৌশলী ছাড়াও কারাফী একজন সুদক্ষ চিত্রশিল্পীও ছিলেন। পরবর্তী মুসলিম উম্মাহের দায়িত্বশীল শক্তি যদি বৈষয়িক নেতৃত্ব ও জনগনের কল্যাণের স্বার্থে উত্তরসূরীদের কর্মপন্থা বজায় রাখতে সক্ষম হতো, তবে বর্তমান জ্ঞানবিজ্ঞানের পিছিয়ে পড়ার ট্যাগ থেকে মুসলিম উম্মাহ বাঁচতে পারতো।
The post ইমাম কারাফী কি রোবট বানিয়েছিলেন ? appeared first on Fateh24.
from Fateh24 https://ift.tt/34zvQKI
No comments:
Post a Comment